রামপাল বনাম ত্রিনকোমালি
শ্রীলঙ্কার পূর্ব উপকূলবর্তী ত্রিনকোমালি শহরের কাছে ত্রিনকোমালি কয়লাবিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপনের পরিকল্পনা নিয়েছিল দেশটির সরকার। কিন্তু পরিবেশবিদদের উদ্বেগ ও আপত্তির কারণে সে দেশের সরকার প্রকল্পটি বাতিল ঘোষণা করে। ইতিমধ্যে প্রকল্পটির নির্মাণকাজ শুরু হয়েছিল। এই প্রকল্প ভারতের ন্যাশনাল থার্মাল পাওয়ার করপোরেশন (এনটিপিসি) ও শ্রীলঙ্কার সিলন ইলেকট্রিক কোম্পানির যৌথ উদ্যোগে (৫০: ৫০ অংশীদারত্ব) গঠিত ত্রিনকোমালি পাওয়ার কোম্পানির অধীনে বাস্তবায়নের উদ্যোগ নেওয়া হয়। প্রথম থেকেই পরিবেশবিদ ও বিজ্ঞানী মহল এই বিদ্যুৎকেন্দ্র চালু হলে তা থেকে নির্গত দূষিত গ্যাস, তরল ও কঠিন বর্জ্য পার্শ্ববর্তী স্থানগুলোর পরিবেশের ওপর যে বিরূপ প্রভাব ফেলবে, তা নিয়ে গভীর উদ্বেগ ও আপত্তি প্রকাশ করে। বিষয়টি আমলে নিয়ে শ্রীলঙ্কা সরকার প্রকল্পটি শেষ পর্যন্ত বাতিল ঘোষণা করে। ভারতীয় সংবাদ সংস্থা প্রেস ট্রাস্ট অব ইন্ডিয়া এবং বহুল প্রচারিত ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস পত্রিকায় প্রকাশিত খবর অনুযায়ী চলতি বছরের ১৬ সেপ্টেম্বর শ্রীলঙ্কার বিদ্যুৎ ও জ্বালানিমন্ত্রী রণজিৎ শ্যামবালাপিটিয়া সাংবাদিকদের জানান যে পরিবেশবিদদের উদ্বেগ ও আপত্তির কারণে কয়লাবিদ্যুৎ প্রকল্পটি বাতিল করা হলো।
বাংলাদেশের দক্ষিণ অঞ্চলে বাগেরহাট জেলার রামপালে একটি কয়লাবিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপনের জন্য ভারতের এনটিপিসি এবং বাংলাদেশের পাওয়ার ডেভেলপমেন্ট বোর্ড যৌথ উদ্যোগে (৫০: ৫০ অংশীদারত্ব) বাংলাদেশ-ভারত ফ্রেন্ডশিপ পাওয়ার কোম্পানি গঠন করে। এই কোম্পানি চলতি বছরের ১২ জুলাই ভারত হেভি ইলেকট্রিক লিমিটেড কোম্পানির সঙ্গে কয়লাবিদ্যুৎকেন্দ্রটির নির্মাণ চুক্তি সম্পন্ন করে। দেশের পরিবেশবিদ ও বিজ্ঞানী মহল রামপাল কয়লাবিদ্যুৎকেন্দ্র চালু হলে তা থেকে নির্গত দূষিত গ্যাস তরল ও কঠিন বর্জ্য মাত্র ১৪ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত সুন্দরবনের পরিবেশের ওপর যে ক্ষতিকর প্রভাব ফেলবে, তা নিয়ে উদ্বেগ ও আপত্তি প্রকাশ করে, যার পক্ষে বিরাট জনগোষ্ঠীর সমর্থন গড়ে ওঠে। বাংলাদেশ সরকার রামপাল প্রকল্পবিরোধীদের উদ্বেগ ও আপত্তি আমলে না নিয়ে প্রকল্প বাস্তবায়নের পথে এগিয়ে যায়। প্রস্তাবিত ত্রিনকোমালি বিদ্যুৎকেন্দ্রটির অবস্থান ছিল ত্রিনকোমালি শহর থেকে প্রায় ১৫ কিলোমিটার দূরে। এটি একটি শুষ্ক, কৃষিজমিবিহীন ও কম বসতিপূর্ণ এলাকা। স্থানটির আশপাশে কোনো সংরক্ষিত বনাঞ্চল নেই, তবে অদূরে অবস্থিত ত্রিনকোমালি উপসাগর এলাকায় প্রাণী ও উদ্ভিদকুলের জীববৈচিত্র্য রয়েছে। পরিবেশবিদেরা আশঙ্কা প্রকাশ করেন যে ওই প্রকল্প বাস্তবায়িত হলে তা থেকে নির্গত দূষক ত্রিনকোমালি উপসাগরের সমৃদ্ধ জীববৈচিত্র্যকে ক্ষতিগ্রস্ত করবে। এখানে গভীর সমুদ্রের ক্ষুদ্র প্রাণিকুল অগভীর উপকূল এলাকায় এসে থাকে এবং এই এলাকায় কোরাল প্রজাতির বাস রয়েছে।
শ্রীলঙ্কা সরকার প্রাথমিকভাবে পরিবেশবিদদের আশঙ্কাকে অমূলক বলে নাকচ করে দিলেও পরবর্তী সময়ে তা গ্রহণযোগ্য মনে করে। রামপাল বিদ্যুৎকেন্দ্র এলাকা খুলনা শহর থেকে প্রায় ২৩ কিলোমিটার দক্ষিণে এবং সুন্দরবন থেকে ১৪ কিলোমিটার উত্তরে অবস্থিত। সুন্দরবন অতি সংবেদনশীল জীববৈচিত্র্যবহুল সংরক্ষিত বনাঞ্চল, যার অনন্য প্রকৃতি তাকে জাতিসংঘের ইউনেসকো হেরিটেজ সাইট হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছে। সুন্দরবনের ভেতর দিয়ে প্রবাহিত ও জালের মতো ছড়িয়ে থাকা অসংখ্য নদনদী ও শাখানদী তার মূল ‘শ্বাসযন্ত্র’ বটে। এর একটি পশুর নদের রামপাল কয়লাবিদ্যুৎকেন্দ্রে কয়লা সরবরাহের পথ হিসেবে ব্যবহৃত হবে। পরিবেশবিদ ও বিজ্ঞানী মহল আশঙ্কা প্রকাশ করে যে রামপাল বিদ্যুৎকেন্দ্র চালু হলে এটি থেকে নির্গত দূষিত বায়ু, পানি ও ছাই অদূরে অবস্থিত সুন্দরবনকে ক্ষতিগ্রস্ত করবে। ত্রিনকোমালি বিদ্যুৎকেন্দ্র ৫০০ মেগাওয়াট ক্ষমতাসম্পন্ন হওয়ার কথা ছিল। এর জন্য প্রতিদিন প্রায় পাঁচ হাজার টন কয়লা জ্বালানির প্রয়োজন হতো। বিদ্যুৎকেন্দ্রটির ঠান্ডা পানির চাহিদা পার্শ্ববর্তী সমুদ্র উপকূল থেকে নেওয়া হতো এবং ব্যবহারের পর অবশিষ্ট পানি এখানে ফেলা হতো। পরিবেশবিদেরা দূষিত গ্যাস ও ছাইয়ের দূষণ ছাড়াও কেন্দ্রটিতে ব্যবহারের জন্য সাগরের পানি নেওয়া ও ব্যবহারের পর অবশিষ্ট পানি এখানে ফেলে দেওয়াকে দূষণ হওয়ার অপর বড় উপাদান হিসেবে গণ্য করেন। রামপাল বিদ্যুৎকেন্দ্রটি পরিকল্পনা অনুযায়ী ১ হাজার ৩২০ মেগাওয়াট ক্ষমতাসম্পন্ন হবে।
এর জন্য প্রতিদিন ১২ হাজার টন কয়লা জ্বালানির প্রয়োজন হবে। সুন্দরবনের ভেতর দিয়ে প্রবাহিত পশুর নদ দিয়ে গড়ে প্রতিদিন ১০ থেকে ১২ হাজার টন কয়লা পরিবহন পরিবেশদূষণের অপর কারণ ঘটবে। বিদ্যুৎকেন্দ্রটির ঠান্ডা পানির চাহিদা পার্শ্ববর্তী পশুর নদ থেকে নেওয়া হবে এবং ব্যবহারের পর অবশিষ্ট পানি এখানে ফেলা হবে, যা কিনা পশুর নদের দূষণ ঘটাবে বলে পরিবেশবিদেরা দাবি করেন। ত্রিনকোমালি প্রকল্পের জন্য পরিবেশ-প্রভাব সমীক্ষা বা ইআইএ রিপোর্ট প্রণীত হয় ২০১৫ সালের জানুয়ারিতে আর রামপালের জন্য ২০১৩ সালের জুলাইয়ে। উভয় ক্ষেত্রেই বায়ুদূষণ কমানোর লক্ষ্যে ফ্লু গ্যাস ডিসালফারাইজেশন (এফজিডি) পদ্ধতি, ছাই ধরে রাখার জন্য উন্নত মানের ইলেকট্রোস্ট্যাটিক প্রেসিপিটেটর (ইএসপি) ইত্যাদি ব্যবস্থাপনার কথা উল্লেখ করা হয়। উভয় ক্ষেত্রেই ছাই শুষ্ক অবস্থায় ধরে রেখে তা বাইরে সিমেন্ট ফ্যাক্টরি, ইট তৈরির স্থাপনায় সরবরাহের কথা বলা হয়। অব্যবহৃত ছাই রাখার জন্য ছাই-পুকুর তৈরির কথা বলা হয়, যেখানে ছাই পানিমিশ্রিত অবস্থায় জমা থাকবে। রামপালের ক্ষেত্রে প্রকল্প এলাকা ভরাট করার জন্যও ছাই ব্যবহারের কথা বলা হয়। ত্রিনকোমালি প্রকল্পের ইআইএ পরিবেশবিদদের সমালোচনার মুখে পড়ে। তাঁদের দাবি যে এ রিপোর্ট পরিবেশবিদদের চিহ্নিত প্রকল্পের ক্ষতিকর বিষয়গুলো পাশ কাটিয়ে গেছে। একইভাবে রামপাল ইআইএ রিপোর্টকে পরিবেশবিদ ও বিজ্ঞানী মহল ভ্রান্তিপূর্ণ ও অনিরপেক্ষ দাবি করে তার গ্রহণযোগ্যতা নিয়ে প্রশ্ন তোলে।
ইউনেসকো ইতিপূর্বে রামপাল বিদ্যুৎকেন্দ্রের কারণে সুন্দরবনের ক্ষতির আশঙ্কায় উদ্বেগ প্রকাশ করে। পুরোপুরি দূষণমুক্ত কয়লাবিদ্যুৎকেন্দ্র পৃথিবীর কোথাও নেই বা তা কোনো প্রযুক্তিতেই সম্ভব নয়। রামপালে উন্নততর টেকনোলজি ব্যবহার করে এর দূষণ তুলনামূলকভাবে কমানোর কথা বলা হয়। কিন্তু তা করতে গিয়ে যে বাড়তি কারিগরি ব্যবস্থাপনা প্রয়োজন হবে, তা উৎপাদিত বিদ্যুতের দাম অনেক বাড়িয়ে দেবে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক আন্তর্জাতিক জ্বালানি অর্থনীতি সমীক্ষা সংস্থা আইইইএফএ কর্তৃক এক জরিপ অনুযায়ী রামপালে উত্পাদিত বিদ্যুতের দাম প্রতি ইউনিট নয় টাকা করে পড়বে, যা কিনা বাংলাদেশে উৎপাদিত বিদ্যুতের তুলনায় অনেক বেশি। কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ উৎপাদনের একটি উদ্দেশ্য তুলনামূলক সাশ্রয়ী বিদ্যুৎ উৎপাদন, কিন্তু বাড়তি খরচ জোগান দিয়ে হলেও সুন্দরবনের কাছে রামপালেই কয়লাবিদ্যুৎকেন্দ্র করতে হবে, এ যুক্তি কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য নয়। রামপাল ও ত্রিনকোমালি কয়লাবিদ্যুৎ প্রকল্প দুটিকে তুলনায় আনলে দুটি বিষয় প্রাধান্য পায়। প্রথমত, রামপাল বিদ্যুৎকেন্দ্রের আকার (মেগাওয়াট) ত্রিনকোমালি বাতিল-ঘোষিত বিদ্যুৎকেন্দ্রের দ্বিগুণেরও বড়। সে হিসেবে রামপালে প্রতিদিন কয়লা পোড়ানো হবে অপরটির তুলনায় দ্বিগুণের বেশি এবং কয়লা পোড়ানোর ফলে নির্গত দূষকের পরিমাণও হবে অপরটির তুলনায় দ্বিগুণের বেশি। দ্বিতীয়ত, রামপালের খুব কাছে বিশ্বের সর্ববৃহৎ ম্যানগ্রোভ বনাঞ্চল অবস্থিত, যা কিনা অনন্যভাবে অতি সংবেদনশীল জীববৈচিত্র্যকে ধারণ করে ইতিমধ্যেই বিশ্বনন্দিত। ত্রিনকোমালির বাতিল-ঘোষিত কয়লাবিদ্্যুৎেকন্দ্রের নিকটবর্তী কোনো সংরক্ষিত বনাঞ্চল নেই বা সুন্দরবনের মতো কোনো সংবেদনশীল জীববৈচিত্র্যের আবাস নেই। তারপরও শ্রীলঙ্কা সরকার সে দেশের পরিবেশবিদ ও বিজ্ঞানী মহলের উদ্বেগ ও আপত্তি আমলে নিয়ে ত্রিনকোমালি কয়লা প্রকল্প বাতিল করেছে। তুলনায় বাংলাদেশ সরকার পরিবেশবিদ ও বিজ্ঞানী মহলের সব আপত্তি অগ্রাহ্য করে অনঢ়, একগুঁয়ে ও অযৌক্তিক অবস্থান নিয়ে স্থির।
এমনকি ইউনেসকোসহ অন্য আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোর উদ্বেগও সরকারকে তার একগুঁয়ে মনোভাব থেকে সরাতে পারেনি। প্রশ্ন হলো, কেন বাংলাদেশ সরকার রামপালের ব্যাপারে এতটা অনড়? অনেকে মনে করেন, সরকারের আস্থাভাজনদের কেউ কেউ হয়তো তাঁদের নিজস্ব স্বার্থে (রাজনৈতিক বা অর্থনৈতিক) সরকারপ্রধানকে সুন্দরবনের ওপর রামপালের ক্ষতিকর প্রভাবের তথ্যগুলো লঘু করে তার বিপরীতে রামপাল সুন্দরবনের কোনো ক্ষতি করবে না, এই চিত্র উপস্থাপন করতে সক্ষম হয়েছেন। এর সঙ্গে যোগ হয়েছে একশ্রেণির চাটুকার ব্যক্তি, যাঁদের প্রধান লক্ষ্য সরকারপ্রধানের যেকোনো মতকে নগ্নভাবে প্রশংসা করে তাঁর সুনজরে আসা, যদিও সে মত দীর্ঘ মেয়াদে সরকারের জন্য নেতিবাচক অবস্থার সৃষ্টি করতে পারে। আবার কোনো কোনো মহলের মতে, রামপাল বাস্তবায়নের পক্ষে সরকারের ওপর ভারতীয় চাপ আছে। এ পক্ষ মনে করে যে শ্রীলঙ্কায় ত্রিনকোমালি কয়লাবিদ্যুৎ প্রকল্প বাস্তবায়নের পক্ষে ভারতীয় চাপ ছিল। বিষয়টি বোঝা যায় তখনই যখন শ্রীলঙ্কা সরকার ত্রিনকোমালি কয়লাবিদ্যুৎ প্রকল্প বাতিল করার পর জানায় যে শ্রীলঙ্কা ভারতের সঙ্গে কোনো বিরোধপূর্ণ সম্পর্ক সৃষ্টি করতে চায় না, বরং কয়লাবিদ্যুৎ প্রকল্পের পরিবর্তে সেখানে ভারতের সহযোগিতায় পরিবেশবান্ধব এলএনজি-ভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপন করতে চায়। অনেকে মনে করেন, শ্রীলঙ্কার উদাহরণ বাংলাদেশের জন্যও গ্রহণযোগ্য পন্থা হতে পারে।
ড. বদরূল ইমাম: অধ্যাপক, ভূতত্ত্ব বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।
ড. বদরূল ইমাম: অধ্যাপক, ভূতত্ত্ব বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।
No comments