ভাঙলেও মচকাচ্ছে না সরকার

উপমা অনেক রকম দেওয়া যায়। সাপের ছুঁচো গেলা কিংবা চেরা বাঁশে বাঁদরের লেজ আটকে যাওয়া। ইংরেজিতে বলে ‘ক্যাচ টোয়েন্টি টু’ অবস্থা। ভারত সরকারের এই মুহূর্তের অবস্থা এই তিনটির সঙ্গেই তুলনীয়। বিশেষ করে সর্বদলীয় প্রতিনিধিদলের পক্ষ থেকে সর্বসম্মতভাবে যে প্রস্তাবটি সরকারের কাছে পেশ করা হয়েছে, সেটি হাতে পাওয়ার পর। প্রস্তাবটি এবং সরকারের হাল বর্ণনার আগে সামান্য ভূমিকার প্রয়োজন রয়েছে। কাশ্মীর উপত্যকার ভূমিপুত্র হিজবুল মুজাহিদীন নেতা ২২ বছরের সুদর্শন যুবক বুরহান ওয়ানি জুলাই মাসের গোড়ার দিকে পুলিশের সঙ্গে সংঘর্ষে নিহত হন। ছেলেটি ভারত রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করেছিলেন। সরকারের চোখে তিনি ছিলেন বিচ্ছিন্নতাবাদী সশস্ত্র জঙ্গি, উপত্যকার মানুষের চোখে স্বাধীনতাসংগ্রামী। বছর খানেক যাবৎ বুরহানই হয়ে উঠেছিলেন কাশ্মীর জঙ্গিদের ‘পোস্টার বয়’। তাঁর মৃত্যুর পর থেকে উপত্যকায় সেই যে অশান্তি শুরু হলো, আজও তা অব্যাহত। দুই মাস ধরে কারফিউ চলছে তো চলছেই। বন্ধ রয়েছে স্কুল-কলেজ ও সরকারি অফিস। থানাগুলোতে থরহরিকম্প অবস্থা। পুলিশ ও আধা সামরিক বাহিনীর সঙ্গে জনতার লড়াই নিত্যদিনের ঘটনা। মাঝেমধ্যেই গজরাচ্ছে পুলিশের বন্দুক। বুলেটের জায়গা নিয়েছে পেলেট। তার ছররায় মানুষ মরছে যেমন, অন্ধও হচ্ছে তেমনই। ইতিমধ্যেই তিন শতাধিক মানুষ পেলেটের ছররায় দৃষ্টি হারিয়েছে। এখন ঠিক হয়েছে, পুলিশ আর পেলেট ছুড়বে না। হুট করে গুলিও না।
তবু পরিস্থিতি যে তিমিরে ছিল, সেখানেই রয়েছে। সাংবাদিক হিসেবে উপত্যকায় যাচ্ছি সেই ১৯৮৪ সাল থেকে, ফারুক আবদুল্লার ঘর ভেঙে তাঁর জামাইবাবু গুল মহম্মদ শাহকে দিয়ে দলে ভাঙন ধরিয়ে ইন্দিরা গান্ধী যখন রাজ্যে বিকল্প সরকার গঠন করালেন। নব্বইয়ের দশকের গোড়ায় উপত্যকায় যখন প্রথম কালাশনিকভের গর্জন শোনা গেল এবং ক্রমে ক্রমে তা হয়ে গেল জলভাত, রক্তহোলি হয়ে দাঁড়াল নিত্যদিনের ঘটনা, সেই কঠিন দশকেও এই উপত্যকা কখনো টানা দুই মাস অচল থাকেনি। সাত থেকে দশ দিনের একেকটা পর্যায় গেছে, ফের কিছুদিনের জন্য স্বাভাবিক হয়েছে জনজীবন। এই প্রথম এত দীর্ঘ সময় ধরে গোটা উপত্যকা জ্বলেই চলেছে। ৩০ বছর আগে প্রশাসন যেভাবে পরিস্থিতির সামাল দিত, আইনশৃঙ্খলার দৃষ্টি নিয়ে, আজও সেভাবেই মোকাবিলার চেষ্টা করছে। সেই থোড় বড়ি খাঁড়া, খাঁড়া বড়ি থোড়। ভারতীয় সংসদের বাদল অধিবেশনের শেষ দিকে কাশ্মীর নিয়ে বিরোধীরা তুমুল হট্টগোল করায় প্রধানমন্ত্রী সর্বদলীয় সভা ডাকেন। বিরোধীরা সংসদীয় দল পাঠানোর প্রস্তাব রাখে। সরকার তা খারিজ করে দেয়। পরিস্থিতি অপরিবর্তিত থাকায় শেষ পর্যন্ত ২৬ জনের এক সংসদীয় দল দুই দিনের সফরে যায়। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী রাজনাথ সিং ছিলেন সেই দলের নেতা। সর্বদলীয় সেই সফরের নির্যাস এককথায় বহ্বারম্ভে লঘুক্রিয়া। সরকার জানিয়ে দিয়েছিল, প্রতিনিধিদল উপত্যকার বিচ্ছিন্নতাবাদী নেতাদের সঙ্গে দেখা করবে না। কিন্তু সিপিএমের সীতারাম ইয়েচুরি, সিপিআইয়ের ডি রাজা, সংযুক্ত জনতা দলের শরদ যাদব ও রাষ্ট্রীয় জনতা দলের জয়প্রকাশ নারায়ণ বিচ্ছিন্নতাবাদী নেতাদের সঙ্গে কথা বলার উদ্যোগ নেন।
নেতাদের মধ্যে সবচেয়ে কট্টরপন্থী যিনি, গৃহবন্দী সেই সৈয়দ আলি শাহ গিলানি তাঁর বাড়ির ফটকই খুললেন না। আগেই তিনি জানিয়েছিলেন, এই নেতাদের সঙ্গে কথা বলে কোনো লাভ নেই। তাঁরা ঠুঁটো জগন্নাথ। উপত্যকায় এসেছেন স্রেফ ফটো তুলতে। বাকি জেলবন্দী নেতাদের কেউ কেউ দেখা করলেও কেউই আলোচনায় আগ্রহ দেখাননি। মুখ্যমন্ত্রী মেহবুবা মুফতিও একটা চিঠি লিখে হুরিয়ত নেতাদের আলোচনায় বসার অনুরোধ জানান। বিজেপির নেতা ও সরকারের কাছে তা আবার বিশেষ বিড়ম্বনার কারণ হয়ে দাঁড়ায়, যেহেতু মেহবুবার দল পিপলস ডেমোক্রেটিক পার্টি (পিডিপি) সরকারের শরিক। কাশ্মীরে বসেই রাজনাথ সিং তাই সরকারের ভূমিকাটা খোলাসা করে দেন। বলেন, যাঁরা হুরিয়ত নেতাদের সঙ্গে দেখা করেছেন, তাঁরা তা করেছেন ব্যক্তিগত উদ্যোগে, আর মেহবুবা হুরিয়ত নেতাদের আমন্ত্রণ জানিয়েছেন তাঁর দল পিডিপির সভানেত্রী হিসেবে, মুখ্যমন্ত্রী হিসেবে নয়। কাশ্মীরে বসেই রাজনাথ জানিয়ে দেন, কাশ্মীর ভারতের অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ। সাংবিধানিক কাঠামোর মধ্যে সমাধানের সব রকম চেষ্টায় সরকার প্রস্তুত। তবে জঙ্গিদের হিংসাত্মক কাজকর্ম রেয়াত করা হবে না। দিল্লি ফিরে সর্বদলীয় প্রতিনিধিদের সঙ্গে সরকারের আরও এক প্রস্থ বৈঠক হয়। সেই বৈঠকে তাঁরা সর্বসম্মতভাবে গৃহীত যে প্রস্তাব সরকারকে জমা দেন, সেটাই হয়ে দাঁড়িয়েছে সরকারের বিড়ম্বনা। কেননা, প্রস্তাবে বলা হয়েছে, পরিস্থিতির উন্নতিতে সরকারের উচিত উপত্যকার ভালো-মন্দের সঙ্গে যাঁদের ভাগ্য জড়িত, তাঁদের সবার সঙ্গে কথা বলা। সহজ কথায়, হুরিয়ত নেতাদের ব্রাত্য না রেখে তাঁদেরও আলোচনায় ডাকা হোক।
কারণ, তাঁদের আড়ালে রেখে পরিস্থিতির মোকাবিলা করা সম্ভব নয়। সরকারের মুশকিল এটাই। পাকিস্তান হুরিয়ত নেতাদের সঙ্গে কথা বলায় ক্ষুব্ধ ভারত দ্বিপক্ষীয় আলোচনা ভেস্তে দিয়েছিল। বন্ধ থাকা সেই আলোচনা আজও শুরুই করা যায়নি। হুরিয়ত নেতাদের কল্কে না-দেওয়ার যে নীতি নরেন্দ্র মোদির সরকার আঁকড়ে রয়েছে, শান্তি ফেরাতে তাঁদের আলোচনায় ডাকলে এটাই প্রমাণ হবে, হুরিয়ত সম্পর্কে সরকারের আগের নীতি ভুল ছিল। তাহলে কী করবে সরকার? কিল খেয়ে কিল হজম? নাকি নিজের গোঁয়ে অটল থাকা? সন্দেহ নেই, এ ঠিক সাপের ছুঁচো গেলার পরিস্থিতি। কাশ্মীর পরিস্থিতির সামাল দিতে বিজেপি যাঁদের ওপর নির্ভর করছে, তাঁদের প্রধান হলেন রাম মাধব। রাষ্ট্রীয় স্বয়ং সেবক সংঘের আস্থাভাজন বিজেপির এই শীর্ষ নেতা সম্প্রতি এক সাক্ষাৎকারে বলেছেন, সংবিধানের চার দেয়ালের মধ্য থেকে হাতে চাঁদ পাওয়ার অধিকার কাশ্মীরি জনতার রয়েছে। রাজনাথ সিংও সাংবিধানিক কাঠামোর কথা শুনিয়ে রেখেছেন। এর অর্থ একটাই, সংবিধান ও ভারতীয় সার্বভৌমত্বকে মেনে কাশ্মীর সমস্যার স্থায়ী সমাধানে ভারত আলোচনায় প্রস্তুত। তা যদি হয়, তাহলে কী হতে পারে? ইতিহাস বলছে, ভারতভুক্তির সময় কাশ্মীর মাত্র তিনটি বিষয় ভারতের ওপর ছেড়ে দিয়েছিল। প্রতিরক্ষা, পররাষ্ট্রনীতি ও যোগাযোগ। বাকি প্রতিটি ক্ষেত্রে সিদ্ধান্ত গ্রহণের আগে কাশ্মীরি জনগণের সঙ্গে আলোচনা ছিল বাধ্যতামূলক। ভারতীয় সংবিধানের ৩৭০ ধারা এটাই। এটাই কাশ্মীরিদের বিশেষ অধিকার। সেই অধিকার ধীরে ধীরে তারা খুইতে থাকে। বিভিন্ন ভারতীয় আইনকানুন ও সাংবিধানিক ধারা সেই ১৯৫৩ সাল থেকে কাশ্মীরি সংবিধানে অন্তর্ভুক্ত হয়েছে। এই অন্তর্ভুক্তি কি তাহলে অসাংবিধানিক?
ভারতের সুপ্রিম কোর্টে এ নিয়ে তিন–তিনটি মামলা হয়েছিল। কিন্তু প্রশ্নটির মীমাংসা হয়নি। ১৯৭৫ সালে শেখ আবদুল্লা-ইন্দিরা গান্ধীর চুক্তি আজও বলবৎ হয়নি। জম্মু ও লাদাখের ক্ষমতার বিকেন্দ্রীকরণের জন্য তিন–তিনটি কমিশন গঠিত হয়েছিল। তাদের সুপারিশও আজ পর্যন্ত মানা হয়নি। এসব কারণে ভারত সম্পর্কে কাশ্মীরি জনগণের মনে ক্রমেই একটা স্বাভাবিক অনাস্থা জন্ম নিয়েছে। এই ‘ট্রাস্ট ডেফিসিট’ বা বিশ্বাসের ঘাটতি আজ এমন মারাত্মক এক জায়গায় পৌঁছেছে, যেখান থেকে কাশ্মীরিদের তরি বিশ্বাসের ঘাটে ফেরানো চাট্টিখানি কথা নয়। কাশ্মীরকে স্বাভাবিক করে তুলতে কাশ্মীরি জনগণকে আলোচনার টেবিলে ডাকলে যদি ৩৭০ ধারার খোয়া যাওয়া মর্যাদা ফেরানোর প্রশ্ন বড় হয়ে ওঠে, যা কিনা স্বশাসন, কী অবস্থান নেবে দিল্লি? আপাতত ভাঙলেও দিল্লি কিন্তু একটুও মচকাতে চাইছে না। কেননা, সরকারের বিভিন্ন সূত্র স্পষ্ট করেই জানাচ্ছে, কাশ্মীরের আগের অশান্তির সঙ্গে এবারেরটার তফাত বিস্তর। এই প্রথম কাশ্মীরে ‘সুফিবাদের বদলে কট্টর ওয়াহাবিবাদ প্রবর্তনের চেষ্টা চলছে’। তাদের প্রথম লক্ষ্য নির্বাচিত সরকারের পতন ঘটানো। এই অপচেষ্টায় যারা জড়িত, তাদের সমূলে উৎপাটন না করে কোনো আলোচনা নয়। সূত্রগুলোর মতে, হুরিয়ত এখনো প্রাসঙ্গিক নয়। এই অনাসৃষ্টি তাদের উসকানিতে হচ্ছে না। তাই তাদের সঙ্গে এখনই কোনো কথাও নয়। সবচেয়ে বড় যে কথাটা সরকারি সূত্রগুলো জানাচ্ছে, তা ঠিক হলে উপত্যকা থেকে সেনাবাহিনীর বিশেষ ক্ষমতা বা ‘আফস্পা’ আইন আংশিকভাবে হলেও প্রত্যাহার হচ্ছে না, বরং দক্ষিণ কাশ্মীরে সেনা উপস্থিতি আরও বাড়ানো হবে।
সর্বদলীয় বৈঠকে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি কবুল করেছেন, শুধু উন্নয়নে চিড়ে ভিজবে না। খুবই সত্যি কথা। একই রকম সত্য, সমস্যাকে আইনশৃঙ্খলার দৃষ্টিতে দেখেও স্রেফ পাকিস্তান-পাকিস্তান করে কোনো লাভ নেই। ক্ষতের একমাত্র প্রলেপ বিশ্বাসের ঘাটতি কমিয়ে আনা। সর্বদলীয় প্রতিনিধিদের কাশ্মীরি জনগণ সোজাসাপ্টাই জানিয়েছেন, অটল বিহারি বাজপেয়ির আন্তরিকতায় তাঁরা ভরসা করেছিলেন, কিন্তু নরেন্দ্র মোদির আন্তরিকতার কোনো প্রমাণ এখনো তাঁরা পাননি। বরং পিডিপির সঙ্গে জোট বেঁধে এই প্রথম সরকারে আসায় উপত্যকার মানুষ অনেক বেশি সন্দিহান ও সংশয়ী। আস্থার অভাবের ফাটল তাই বেড়েই চলেছে। ডিম আগে না মুরগি আগের মতো অভ্যন্তরীণ বিতর্ক চলছেই। সরকার চাইছে আগে শান্তি ফিরুক, তারপর আলোচনা। বিরোধীরা বলছে, আলোচনায় না-বসলে শান্তির দিশা মেলা ভার। সরকারকে নতুনভাবে ভাবতেই হবে। সর্বদলীয় প্রতিনিধিদল পাঠিয়ে লাভ নেই। বিশ্বাসের ঘাটতি তারা মেটাতে পারবে না। তারা যাবে, গুচ্ছের ছবি তুলবে ও নেতাদের বন্ধ ফটকে মাথা কুটে ফিরে আসবে।
সৌম্য বন্দ্যোপাধ্যায়: প্রথম আলোর নয়াদিল্লি প্রতিনিধি।

No comments

Powered by Blogger.