জঙ্গিবাদ মোকাবিলা দীর্ঘমেয়াদি বিষয়

৭ সেপ্টেম্বর প্রথম আলো এক গোলটেবিল আলোচনার আয়োজন করেছিল। আলোচনার শিরোনাম ছিল ‘জঙ্গিবাদের বিপদ ও উত্তরণের উপায়’। গোলটেবিলের প্রধান অতিথি ছিলেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল। তিনি প্রাথমিক বক্তব্যে তুলে ধরেছেন জঙ্গিবিরোধী অভিযানে সরকারের অবস্থান এবং বিভিন্ন পরিকল্পনার কথা। তিনি পুরো সময় ধৈর্যসহকারে সবার মন্তব্য শুনেছেন এবং তাঁর মতামতও তুলে ধরেন। তিনি কয়েকটি নতুন ও যৌক্তিক বিষয় বিবেচনায় নেবেন বলে আশ্বাস দেন। তিনি গোলটেবিল বৈঠকের পুরো সময় বসে আমার, সুলতানা কামাল, শাহদীন মালিক, ইশফাক ইলাহী, মুনিরুজ্জামানসহ অন্যদের কথা শুনেছেন। এ ধরনের বৈঠকে মন্ত্রীরা সাধারণত অন্যদের কথা না শুনে নিজের বক্তব্য দিয়ে চলে যান। সন্দেহ নেই যে হলি আর্টিজানে হামলার ঘটনায় কিছু করতে না পারলেও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী কল্যাণপুর, মিরপুর আর নারায়ণগঞ্জে অভিযান চালিয়ে কথিত নব্য জেএমবির শীর্ষস্থানীয় ব্যক্তিদের মারতে সক্ষম হয়েছে। এতে জনমনে কিছুটা স্বস্তি এনে দিলেও এই তৎপরতার মাধ্যমে বাংলাদেশে জঙ্গি বিস্তার রোধ হয়েছে, তা বলার সময় এখনো আসেনি। যদিও শীর্ষস্থানীয় জঙ্গিরা সহজে ধরা দেয় না, কিন্তু জঙ্গিনেতাদের জীবিত ধরতে পারাটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। তামিম চৌধুরী ও মেজর (অব.) জাহিদুলের মৃত্যুর সঙ্গে বহু অজানা তথ্যের দ্বার বন্ধ হয়ে গেছে, এ কথা স্বীকার করতে হবে। কাজেই শুধু ধরা নয়, এঁদের বিচারের মুখোমুখি দাঁড় করানো গেলে আইনের শাসনের জোরটি তাঁদের সামনে তুলে ধরার সুযোগ পাওয়া যেত। আগেই বলেছি এবং আবার বলছি,
এ ধরনের ধর্মভিত্তিক মতাদর্শের সদস্যরা এ ধরনের মৃত্যুর মধ্য দিয়ে তাঁদের অনুসারীদের আরও উদ্বুদ্ধ করেন। এ দুজনের কেউই আত্মহত্যার পথ বেছে নেননি। কারণ, তাঁরা তাঁদের মতে, ‘শহীদ’ হওয়ার অপেক্ষায় ছিলেন, যেমনটা হলি আর্টিজানের হামলাকারী তরুণেরা মন্তব্য করেছিলেন।তাঁদের মৃত্যুতে অনেক বিষয়ই হয়তো অজানা রয়ে গেছে। যার মধ্যে প্রধানত যে তথ্য আমাদের জানার ছিল তা হলো তরুণদের, বিশেষ করে এ ধরনের আধুনিক শিক্ষায় শিক্ষিত মধ্যবিত্ত ও উচ্চমধ্যবিত্ত পরিবারের সন্তানদের কীভাবে বা কী উপায়ে এমনভাবে ধর্মীয় উগ্রপন্থায় নিয়ে যাওয়া হয়। ধারণা করা হয়েছিল, এই উন্মাদনার কারণ হয়তো বিভিন্ন ধরনের মাদকজাতীয় দ্রব্য, যা সেবনের পর তাঁরা হলি আর্টিজানে হামলা চালিয়ে থাকতে পারেন। কিন্তু তেমনটা প্রমাণিত না হওয়ায় এ তত্ত্ব অন্তত বাংলাদেশে হালে পানি পায়নি। কীভাবে এই ধর্মীয় উগ্রবাদতত্ত্ব ব্যবহার করা হয়, তার কোনো তাত্ত্বিক ধারণা গবেষকেরা এখন পর্যন্ত করতে পারেননি। যেসব দেশে ও অঞ্চলে ধর্মীয় উগ্রপন্থার বিস্তার ঘটেছে, তার কারণ অভিন্ন নয়। কাজেই বাংলাদেশের মতো মুসলিমপ্রধান দেশ, যেখানে ৯০ শতাংশ মুসলমান এবং এর ৯৯ শতাংশ সুন্নি মুসলমান, সরকারও ধর্মবান্ধব, সেখানে এই উগ্রপন্থার এত বিস্তার কেন এবং কীভাবে ঘটল, তার উত্তর এখনো পাওয়া যায়নি, যাবে কি না তা নিয়েও সন্দেহ রয়েছে। আমার মনে হয়েছে, কথিত নব্য জেএমবির দুই শীর্ষস্থানীয় নেতৃত্বদানকারীর মৃত্যুর সঙ্গে আমরা সে তথ্য পাওয়ার সুযোগ হারিয়েছি। এখন যে তথ্য পাওয়া যাচ্ছে তার সত্যতা নিয়ে প্রশ্ন থেকে যায়।
দ্বিতীয় যে বিষয়ে আমরা এখনো অন্ধকারে তা হলো এই জঙ্গিবাদের অর্থের জোগান কীভাবে, কোন পথে হয়ে থাকে? যাঁরা এ বিষয়ে প্রায়ই মন্তব্য করেন, তাঁদের এসব মন্তব্য ধারণাপ্রসূত কোনো তথ্য-উপাত্তের ওপর ভিত্তি করে নয়। যে ধরনের জঙ্গি তৎপরতা আমাদের দেশে এ পর্যন্ত প্রত্যক্ষ করা গেছে, সেখানে বড় ধরনের অর্থের প্রয়োজন হয়নি। এমনকি সংগঠন চালাতেও তেমন অর্থের প্রয়োজন হয় বলে মনে হয় না। খুব অল্প খরচে যে ধরনের সন্ত্রাসী হামলা বিশ্বে ঘটে চলেছে এবং তার বিপরীতে বিভিন্ন দেশের সন্ত্রাসবিরোধী অভিযানের ক্রমবর্ধমান খরচ লক্ষণীয়। ৯/১১-এ টুইন টাওয়ারসহ অন্যান্য জায়গায় হামলায় আল-কায়েদা ৫০ লাখ মার্কিন ডলার খরচ করেছিল বলে বিভিন্ন সূত্রে জানা যায়। তার বিপরীতে সন্ত্রাসবিরোধী অভিযানে শুধু যুক্তরাষ্ট্রেরই খরচ হয়েছে ৩ দশমিক ৩ ট্রিলিয়ন ডলার। এ পর্যন্ত যুক্তরাষ্ট্রের অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে খরচ হয়েছে ১৭ ট্রিলিয়ন ডলার এবং এ খরচ চলমান। এ ধরনের পরিসংখ্যান আমাদের দেশের প্রেক্ষাপটে পাওয়া যাবে কি না অথবা গবেষণা হবে কি না, নিশ্চিত নই। অনেকেই মন্তব্য করে থাকেন যে স্বাধীনতাবিরোধী অথবা যুদ্ধাপরাধীদের কাছ থেকে জঙ্গিদের অর্থ জোগান দেওয়া হয়। এমন মন্তব্যের সত্যতাও নিশ্চিত করা যায়নি। কারণ, অর্থায়নের যেসব খাত রয়েছে, সেখান থেকে প্রচুর অর্থ জঙ্গিদের হাতে যায়, তা একরকম বিশ্বব্যাপী প্রমাণিত। আমাদের দেশে ঈদ পার্বণে যে ধরনের ব্যাপক চাঁদাবাজি হয় রাজনৈতিক দল ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কিছু সদস্যের নামে, তা গোপন বিষয় নয়। জঙ্গিগোষ্ঠী এ ধরনের চাঁদাবাজি ও অপহরণের সঙ্গে যুক্ত থাকতে পারে বলে অনেকেই মনে করেন। ইতিমধ্যেই আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী বেশ তৎপরতা ও সাফল্য দেখিয়েছে। জনগণ সোচ্চার হয়েছে, তবে এ ধরনের বজ্র আঁটুনি কত দিন বজায় রাখা যায়, তা দেখার বিষয়।
কারণ, অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তা বাড়ানোর সঙ্গে জড়িত রয়েছে বড় অঙ্কের অর্থ, যা সরকারকে বহন করতে হবে। যার জ্বলন্ত উদাহরণ গুলশান-বারিধারার বর্তমান অবস্থা। হলি আর্টিজানের হামলার পর নিরাপত্তা দৃশ্যমান করতে গিয়ে যেসব ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে, তাতে তাৎক্ষণিক স্বস্তি পেলেও ওই অঞ্চলের অর্থনৈতিক যে ক্ষতি হয়েছে এবং হচ্ছে তার বিবরণ হয়তো অনুমানভিত্তিক হবে। প্রয়োজন সঠিক তথ্যের। অনেক খেটে-খাওয়া মানুষের রুটিরুজি ব্যাহত হচ্ছে। অবস্থাদৃষ্টে মনে হয় অতি নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে গিয়ে বহুবিধ আঙ্গিকে জনজীবন অনিরাপদ হচ্ছে। ওই অঞ্চলের মানুষের আতঙ্ক এখনো কাটেনি। ফিরে আসেনি আগের প্রাণচাঞ্চল্য। আমরা জঙ্গিদের নেতিবাচকভাবে জিততে দিচ্ছি কি না, তা ভেবে দেখার বিষয়। আমরা বিপদে আছি। এ বিপদ সহজে দূর হওয়ার নয়। সাময়িক স্বস্তিতে থাকলেও ইতিমধ্যেই এর বিস্তারের যে চিত্র ফুটে উঠছে, তা অবশ্যই চিন্তার বিষয়। ভবিষ্যতে এদের কৌশল কী হবে তা কারও জানা আছে কি না জানি না, যদিও আমাদের গোয়েন্দা বাহিনীকে আগের চেয়ে বেশি তৎপর বলে ধারণা করা হয়। আমাদের আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে অনেক বিষয়ে সংবেদনশীল হতে হবে। এ বিষয়টি আলোচিত হয়েছে ওই গোলটেবিল বৈঠকে। আমাদের দেশের আপামর মানুষ ধর্মভীরু, তবে ধর্মান্ধ নয়। কাজেই তাদের ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত দিয়ে সুদূরপ্রসারী পরিকল্পনা সম্ভব নয়। ‘জিহাদি’ বইয়ের সংজ্ঞা কী, আজ পর্যন্ত খোলাসা করা হয়নি। অনেকেই আমাকে বলেছেন, যেকোনো ধরনের ধর্মীয় পুস্তক বহন করতেও অনেকে আতঙ্কিত হন। এ আতঙ্ক জঙ্গি দমনে সহায়ক নয়।
এসব বিতর্ক এড়াতে হলে আমাদের আরও সংবেদনশীল হতে হবে। যেকোনো ঘটনার পর এবং বিভিন্ন তৎপরতায় আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর বিভিন্ন উচ্চপর্যায়ের কর্মকর্তাদের পরস্পর বিপরীত বক্তব্য পাওয়া যায়, যার কারণে অনেক অভিযান নিয়ে অহেতুক মানুষের মনে সন্দেহ জন্মে। সমন্বয়হীনতা জঙ্গি দমনে সহায়ক নয়। প্রয়োজন সমন্বয় করা এবং নির্ধারিত সময় নির্ধারিত ব্যক্তির মাধ্যমে ব্যাখ্যা দেওয়া। অনেক সরকারি কর্মকর্তাকে রাজনীতিবিদদের মতো বক্তব্য দিতে দেখা যায়, যা এই বিপদ থেকে উত্তরণে সহায়ক নয়। ভবিষ্যতে করণীয় নিয়ে সরকারের চিন্তাধারা সঠিক দিকনির্দেশনা দিলেও অনেক ক্ষেত্র রয়েছে, যেদিকে দৃষ্টি দেওয়া উচিত। গোলটেবিল বৈঠকে সুলতানা কামাল অনেক কারণের মধ্যে সুশাসনের কথা বলেছেন। শাহদীন মালিক সংবিধান প্রতিপালনের কথা বলেছেন। এসব বক্তব্য ও মন্তব্য ফুৎকার দিয়ে উড়িয়ে দেওয়ার মতো নয়। সুশাসন, উদার গণতন্ত্রের অভাব এবং আইন ও সংবিধানের শাসন—এসবই জঙ্গিবিরোধী উপাদান। জনগণ সচেতন রয়েছে, সরকারেরও সদিচ্ছা প্রতিফলিত। তবে এ সমস্যার যেমন সহজ সমাধান নেই, তেমনি অতি রাজনৈতিকীকরণেও সমস্যার সমাধান পাওয়া যাবে না। আমাদের মনে রাখা উচিত যে আমরা একটা সুদূরপ্রসারী বিপদের মধ্যে রয়েছি, যার সঙ্গে যুক্ত হয়েছে একধরনের শ্রেণিবিন্যাস। আমরা তখন সোচ্চার হয়েছি,
যখন মধ্যবিত্তদের সন্তানেরা এই জঙ্গিবাদের সঙ্গে যুক্ত হয়েছে। তার আগে গ্রামের গরিব কৃষক অথবা মজুরদের সন্তান, যাদের মাদ্রাসা শিক্ষা ছাড়া অন্য ধরনের শিক্ষা জোটে না, তাদের নিয়ে অনেকটা উদাসীন ছিলাম। এখন সে অবস্থার পরিবর্তনে আমরা সোচ্চার হয়েছি। তবে জঙ্গিগোষ্ঠীগুলো এই দুই প্রান্তিকের যুবকদের যেভাবে একত্র করতে পেরেছে, সে বিষয়টিও লক্ষণীয়। এই গভীর তত্ত্বও আমাদের জানা নেই। ব্যাপক গবেষণার প্রয়োজন রয়েছে। যা-ই হোক, পরিশেষে প্রথম আলোকে ধন্যবাদ এমন বিষয়ে একটি কার্যকর গোলটেবিল বৈঠকের আয়োজন করার জন্য। আরও ধন্যবাদ স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী মহোদয়কে, যিনি পুরো সময়টা উপস্থিত ছিলেন। আমরা যাঁরা এখন প্রবীণ, তিন মাথাওয়ালা মানুষের মতো, চাইলে উপদেশ বা অনুরোধ করতে পারি, তা ধর্তব্যে আনা না-আনা দায়িত্বশীল ব্যক্তিদের ব্যাপার। তবে আলোচনার মাধ্যমে পথের খোঁজ পাওয়া যায়। সমালোচনা বিরোধিতা নয়, সমালোচনা সমালোচিতের সঙ্গে সহযোগিতা করা। তবে অবশ্যই সমালোচনা হতে হবে গঠনমূলক। আমাদের সমাজকে এই জঙ্গিবাদের মোকাবিলা করতে হবে দীর্ঘদিনের জন্য। তাই প্রয়োজন দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনার। আর সে কারণেই এ ধরনের গোলটেবিল অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
এম সাখাওয়াত হোসেন: অবসরপ্রাপ্ত ব্রিগেডিয়ার জেনারেল, সাবেক নির্বাচন কমিশনার ও কলাম লেখক৷
hhintlbd@yahoo.com

No comments

Powered by Blogger.