চিনির দামে অস্থিরতা
আন্তর্জাতিক বাজারে মূল্য বাড়ার অজুহাতে দেশের চিনির বাজার অস্থির হয়ে উঠছে। গত দুই মাসেরও বেশি সময় ধরে চিনির দাম বাড়ছে। আন্তর্জাতিক বাজারে গত মে মাসে ৩৩০ ডলারে বিক্রি হওয়া চিনি এখন ৫১৩ ডলারে উঠে গেছে। এর প্রভাব পড়ছে দেশীয় বাজারে। আবার অনেক ব্যবসায়ী মাত্রাতিরিক্ত মুনাফার লক্ষ্যে বিভিন্ন কৌশলে বাজারে চিনি সরবরাহ নিয়ে জটিলতার সৃষ্টি করছে। এতে পাইকারি বাজারে চাহিদা অনুযায়ী চিনি না পৌঁছলে খুচরা বাজারেও এর নেতিবাচক প্রভাব পড়ে। তবে দেশের গুটিকয়েক উৎপাদক ও আমদানিকারক প্রতিষ্ঠানের কারসাজিতে বাড়ছে চিনির দাম এমন অভিযোগও রয়েছে। পর্যালোচনায় দেখা গেছে, আন্তর্জাতিক বাজারে চিনির মূল্য বেশ বেড়েছে। এ ব্যাপারে ব্যবসায়ী পক্ষ এবং দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণকারী বাণিজ্য মন্ত্রণালয় সংশ্লিষ্টদের বক্তব্য প্রায় অভিন্ন। গত মে মাসে আন্তর্জাতিক বাজারে ৩৩০ ডলারে বিক্রি হওয়া চিনি এখন ৫১৩ ডলারে উঠে গেছে। এছাড়া অন্য যে কোনো মৌসুমের তুলনায় চলতি বছর চিনির আন্তর্জাতিক উৎপাদন কম হয়েছে।
বিশেষ করে বড় সরবরাহকারী দেশ ব্রাজিলে এ বছর উৎপাদন ২০ শতাংশ কম হয়েছে। উৎপাদন কম হওয়ার খবর জেনে চিনির মজুদের বড় একটা অংশ আন্তর্জাতিক মাফিয়ারা কিনে নিয়েছে। এ সুযোগে পণ্যটির দরও আশংকাজনক হারে বাড়তে শুরু করেছে। এছাড়া চিনি আমদানিতে বাংলাদেশের সবচেয়ে কম ব্যয়বহুল দেশ ভারতে এ বছর চাহিদার তুলনায় ঘাটতি পড়েছে ৪০ লাখ টন। সেই সঙ্গে ভারতের প্রধান চিনি উৎপাদনকারী এলাকাগুলোতে খরার কারণে এবার ফলন কম হওয়ার আশংকা রয়েছে। এতে করে পণ্যটির আন্তর্জাতিক দর বেড়ে গত আড়াই বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ পর্যায়ে উঠেছে। এ পরিস্থিতিতে ভারত সরকার চিনি রফতানি নিরুৎসাহিত করতে সম্প্রতি ২০ শতাংশ অতিরিক্ত শুল্ক বসিয়ে দিয়েছে। এসবের প্রভাব পড়ছে দেশীয় বাজারে। ব্যবসায়ীরা জানান, আন্তর্জাতিক বাজার পরিস্থিতিই দেশে চিনির দাম বেড়ে যাওয়ার নেপথ্যে বড় কারণ। তারপরও দেশে চিনির পর্যাপ্ত মজুদ থাকার পরও দাম বাড়ছে। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, দেশে এখনই চিনির দাম এত বেশি বেড়ে যাওয়ার সন্তোষজনক কারণ নেই। আন্তর্জাতিক বাজার থেকে আগে কেনা চিনির যে মজুদ রয়েছে, সেটি দিয়ে অনায়াসেই আগামী অক্টোবর পর্যন্ত চলে যাওয়ার কথা। এসব কোনোভাবেই প্রতি কেজি ৫৫ টাকার বেশি বিক্রি হওয়ার যুক্তিসঙ্গত কোনো কারণ নেই। তবু গত দুই মাসে লাফিয়ে লাফিয়ে বেড়েছে চিনির দাম। ফলে ৪৪-৪৮ টাকার চিনি এখন ৭০-৭৫ টাকায় উঠে গেছে। খোঁজ নিয়ে জানা যায়, ২০১৪-১৫ এবং ২০১৫-১৬ এ দুই অর্থবছরে দেশে চিনি আমদানি হয়েছে মোট ৩৫ লাখ ৩৮ হাজার টন।
প্রতিবছর দেশে চিনির সর্বোচ্চ চাহিদা হচ্ছে ১৫ লাখ টন। সদ্যবিদায়ী অর্থবছরের ৩০ জুন পর্যন্ত এর ভোগব্যয় হয়েছে ৩০ লাখ টন। ফলে চলতি ২০১৬-১৭ অর্থবছরের শুরুতে দেশে চিনির মজুদ ছিল ৫ লাখ ৩৮ হাজার টন। মাসিক ভোগব্যয়ের হিসাব অনুযায়ী সর্বশেষ জুলাইয়ে এ মজুদ থেকে ভোগ হয় আরও ১ লাখ ২৫ হাজার টন। এছাড়া দৈনিক ভোগব্যয় ৪ হাজার টন হিসেবে গত রোববার পর্যন্ত চিনির মজুদ ছিল ৩ লাখ ৮৫ হাজার টন। আন্তর্জাতিক বাজার থেকে বিভিন্ন সময়ে ২৫০ থেকে ৩০০ ডলারে কেনা এসব চিনির দেশীয় মজুদ পরিস্থিতিই বলে দিচ্ছে গত দুই মাসে চিনি থেকে কী পরিমাণ অনৈতিক ব্যবসা করেছে উৎপাদক প্রতিষ্ঠানগুলো। সূত্রমতে, চিনির দৈনিক চাহিদা রয়েছে ৪ হাজার ১০৫ টন। উৎপাদক প্রতিষ্ঠানগুলোর পরিশোধন সক্ষমতা রয়েছে ৭ থেকে ৮ হাজার টন। এখানে সিটি গ্রুপ এককভাবেই ৩ হাজার টন চিনি সরবরাহ দেয়ার ক্ষমতা রাখে। এরপরই আছে মেঘনা গ্রুপ। এছাড়া আরও কয়েকটি উৎপাদক প্রতিষ্ঠান চিনির উৎপাদন, পরিশোধন ও আমদানি করে। কিন্তু এসব প্রতিষ্ঠান এখন তাদের সরবরাহের পরিমাণ সর্বনিু অবস্থায় নামিয়ে এনেছে। এমনকি আন্তর্জাতিক বাজারের দোহাই দিয়ে গত দুই মাসে এলসি খোলার হারও কমিয়ে দিয়েছে। উদ্দেশ্য কম দামে কেনা মজুদ চিনি কয়েকগুণ বেশি দামে বিক্রি করা। যে কারণে ডিও অনুযায়ী চিনির সরবরাহ মিলছে না কারোরই। কনজ্যুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) সভাপতি গোলাম রহমান এ প্রসঙ্গে বলেন,
কয়েকটি প্রতিষ্ঠানের কারসাজির কারণে অসহায় হয়ে পড়েছেন ক্রেতারা। এদের অনৈতিক তৎপরতা বন্ধ করতে হবে। ভেঙে দিতে হবে একচেটিয়া ব্যবসার সিন্ডিকেট। সবার জন্য পরিশোধিত চিনি আমদানি উন্মুক্ত করার পদক্ষেপই হতে পারে এ সমস্যার একমাত্র সমাধান। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, চিনি সরবরাহে কৃত্রিম সংকট, মিলগেটে বেশি দাম রাখাসহ ব্যবসায়ীদের নানা কূটকৌশলের সব ছকই সরকারের জানা। এক্ষেত্রে চুনোপুঁটিদের ভয়-জরিমানা দেখালেও চিহ্নিত রাঘববোয়ালরা অধরাই থেকে গেছে। এদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেয়ার কোনো উদ্যোগ নেই। এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব হেদায়েতুল্লাহ আল মামুন যুগান্তরকে বলেন, চিনির দাম বেড়েছে এটা বৈশ্বিক বাস্তবতা। মুক্তবাজার অর্থনীতিতে আন্তর্জাতিক বাজারের উত্তাপ এ দেশেও কমবেশি লেগেছে। তবে দেখতে হবে সেটি কতটা পড়েছে। তিনি বলেন, সরকার খুব সতর্কভাবে দ্রব্যমূল্য পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ করেছে বলেই রোজার মাসে নিত্যপণ্যের মূল্য স্বাভাবিক ছিল। চিনি পরিস্থিতি নিয়েও সরকার সতর্ক রয়েছে। এরই মধ্যে অনৈতিক তৎপরতার অভিযোগে একটি প্রতিষ্ঠানকে ২০ লাখ টাকা জরিমানাসহ আইনানুগ ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে। বাকিরাও পর্যবেক্ষণে রয়েছে। অনৈতিক তৎপরতার মাধ্যমে ভোক্তা স্বার্থ ক্ষুণ্ণ করা হলে কাউকে ছাড় দেয়া হবে না বলে জানান তিনি।
No comments