বিশ্বে প্রতি দশ মিনিটে একজন লোক জলাতঙ্ক রোগে মারা যায়

বিশ্বের কোথাও না কোথাও প্রতি দশ মিনিটে একজন লোক জলাতঙ্ক রোগে মারা যায়। বছরে মারা যায় ৫৫ হাজার মানুষ। জলাতঙ্ক একটি ভয়ঙ্কর মরণব্যাধি। এ রোগে মৃত্যু হার শতভাগ। শতকরা ৯৫ ভাগের বেশি জলাতঙ্ক রোগটি মূলত কুকুরের কামড় বা আচঁড়ের মাধ্যমে ছড়ায়। বাংলাদেশে প্রতিবছর প্রায় ৪ থেকে ৫ লাখ মানুষ কুকুর, বিড়াল, শিয়ালের কামড় বা আচঁড়ের শিকার হয়। যাদের মধ্যে বেশির ভাগই শিশু।  ২৫ হাজার গবাদি প্রাণীও এ রোগের শিকার হয়ে থাকে। দেশে ২০১০ সালের আগে বছরে ২ হাজার মানুষ জলাতঙ্ক রোগে আক্রান্ত হয়ে মারা যেত।
এই অবস্থায় সরকার ২০২২ সালের মধ্যে জলাতঙ্ক মুক্ত বাংলাদেশ গড়ার অঙ্গিকার করেছে। গতকাল রাজধানীর খামারবাড়ির কৃষিবিদ ইনস্টিটিউটের অডিটোরিয়ামে ঢাকা উত্তর ও দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশনের ব্যাপকহারে কুকুরের টিকাদান কার্যক্রমের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে সংশ্লিষ্টরা এই তথ্য জানিয়েছেন। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের রোগ নিয়ন্ত্রণ ও কমিউনিকেবল ডিজিজ কন্ট্রোল (সিডিসি)-এর উদ্যোগে এই অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়। অনুষ্ঠানে জানানো হয়, আগামী ১৪ থেকে ২০শে মে সপ্তাহব্যাপী ঢাকা উত্তর ও দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশনের সকল ওয়ার্ডে ব্যাপকহারে কুকুরের ভ্যাকসিনেশন ক্যাম্পেইন টিকাদান কার্যক্রম পরিচালনা করা হবে।  অনুষ্ঠানে মূল প্রবন্ধে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের পরিচালক (রোগ নিয়ন্ত্রণ) ও লাইন ডাইরেক্টর কমিউনিকেবল ডিজিজ কন্ট্রোল (সিডিসি) অধ্যাপক ডা. সানিয়া তহমিনা ২০২২ সালের মধ্যে জলাতঙ্ক মুক্ত বাংলাদেশ গড়ার অঙ্গিকার করেন। স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের নির্দেশনায় প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তর এবং স্থানীয় সরকার বিভাগের সহযোগীতায় স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের কমিউনিকেবল ডিজিজ কন্ট্রোল প্রোগ্রাম কর্তৃক পরিচালিত জাতীয় জলাতঙ্ক নির্মূল কর্মসূচির বিষয়ে তুলে ধরেন তিনি। যার মাধ্যমে বর্তমানে দেশে এই রোগের আক্রান্তের হার ৫০  ভাগের অধিক কমে এসেছে।
জলাতঙ্ক নির্মূলে ব্যাপকহারে কুকুরের তিন রাউন্ড টিকাদানের প্রয়োজনীয়তা তুলে ধরেন রোগ নিয়ন্ত্রণ পরিচালক। এই কার্যক্রমের আওতায় প্রায় ১২ লাখ ৩৮ হাজার কুকুরকে জলাতঙ্কের প্রতিষেধক টিকা দেয়া হয়েছে। তিনি বলেন, দেশে ১৬ লাখ কুকুর রয়েছে। এর মধ্যে ৮৩ ভাগ কুকুরই রাস্তার। সংশ্লিরা জানান, ২০১৬ সালের মধ্যে জলাতঙ্ক রোগে আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা শতকরা ৯০ ভাগ কমিয়ে আনা এবং ২০২২ সালের মধ্যে বাংলাদেশকে জলাতঙ্ক মুক্ত করার লক্ষ্যে ২০১০ সাল থেকে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়, স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয় এবং প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয় যৌথভাবে জাতীয় জলাতঙ্ক নিয়ন্ত্রণ এবং নির্মূল কর্মসূচি বাস্তবায়ন করে চলছে। এরই অংশ হিসেবে দেশের সকল জেলায় মোট ৬৬টি জলাতঙ্ক নিয়ন্ত্রণ ও নির্মূল কেন্দ্র চালু করা হয়েছে। এসব কেন্দ্র থেকে কুকুরের কামড়ে আক্রান্ত রোগীর আধুনিক ব্যবস্থাপনা এবং জলাতঙ্ক প্রতিরোধী টিকা বিনামূল্যে সরবরাহ করা হচ্ছে। মহাখালীর সংক্রামক ব্যাধি হাসপাতালে প্রতিদিন গড়ে প্রায় ৪০০ থেকে ৫০০ কুকুরের কামড়ে আক্রান্ত  রোগীকে সেবা প্রদান করা হয়। হাসপাতালটির বার্ষিক এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, সারা দেশে ২০১০ থেকে ২০১২ সাল পর্যন্ত জলাতঙ্ক রোগে আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা ২১৪৭ থেকে ১৪৪৫ নেমে এসেছে। হাসপাতালটিতে এই রোগে আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা ৬০ শতাংশ কমেছে।
উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রী জাহিদ মালেক প্রধান অতিথির বক্তব্যে বলেন, জলাতঙ্ক রোগ নির্মূলের কাজে আমাদের যেভাবে এগিয়ে আসতে হবে, সেভাবেই সমাজের ক্ষতিকারক মানুষ, যাদের আচরণ দেখে মনে হয় জলাতঙ্ক রোগে আক্রান্ত, তাদেরও দমন করতে হবে। অনুষ্ঠানে উপস্থিত ডিএনসিসি মেয়রকে উদ্দেশ্য করে স্বাস্থ্যমন্ত্রী বলেন, আমাদের খাদ্যে ভেজাল ও অ্যান্টিবায়োটিক ব্যবহারের বিরুদ্ধে আরও সোচ্চার হতে হবে।
এগুলো যাতে ব্যবহার করা না হয়, সে ব্যাপারে কড়া নজরদারি দিতে হবে। গবাদি পশুর খাবারে ট্যানারির বর্জ্য পদার্থ ব্যবহার করা হয় বলেই, গবাদি পশু থেকে প্রাপ্ত বিভিন্ন খাদ্য দ্রব্যে অ্যান্টিবায়োটিকসহ রাসায়নিক ক্ষতিকর পদার্থের উপস্থিতি পাওয়া যাচ্ছে। এসব খেয়ে মানুষ অসুস্থ হয়ে পড়ছে। এতে করে দেশের কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্য কোনো দিনই অর্জন হবে না। তাই সবাইকে সমন্বিতভাবে এসব সমস্যার বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াতে হবে। এছাড়া রাজধানীতে এখন প্রচুর পরিমাণে শব্দ দূষণ হচ্ছে, এটাও রোধ করতে হবে। পৃথিবীর ভারসাম্য রক্ষার জন্য প্রাণী হত্যা থেকে আমাদের বিরত থাকতে হবে উলেখ করে জাহিদ মালেক বলেন, মানুষ ও প্রাণী আদি কাল থেকে একে অপরের উপর নির্ভরশীল। আর সভ্যতার শুরু থেকেই কুকুর মানুষের বন্ধু। এ কারণে কুকুরকে নির্মূল না করে জলাতঙ্ক প্রতিরোধ করা হচ্ছে।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক অধ্যাপক ডা. আবুল কালাম আজাদের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠানে আরও বক্তব্য রাখেন ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশনের মেয়র আতিকুল ইসলাম, মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ প্রতিমন্ত্রী মো. আশরাফ আলী খান খসরু, শের-ই-বাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি অধ্যাপক ড. কামাল উদ্দিন আহমেদ, প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের মহাপরিচালক ডা. হীরেশ রঞ্জন ভৌমিক, লেখক ও গবেষক সৈয়দ আবুল মকসুদ, অধ্যাপক ডা. বে-নজির আহমেদ, ডা. উম্মে রুমান সিদ্দিকী প্রমুখ। এর আগে সকালে রাজধানীর খামারবাড়ি এলাকায় কুকুরকে ইনজেকশন ও লাল রঙ দিয়ে চিহ্নিত করার মাধ্যমে কুকুরের টিকাদান কর্মসূচির উদ্বোধন করেন স্বাস্থ্যমন্ত্রী ও ডিএনসিসির মেয়র।

No comments

Powered by Blogger.