জিপিএ-৫ মান বিতর্ক এবং...
একটি বেসরকারি টেলিভিশন চ্যানেলে প্রচারিত একটা প্রতিবেদন নিয়ে সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমে চলছে ভীষণ হইচই। ওই প্রতিবেদনে এবার মাধ্যমিক পরীক্ষায় জিপিএ-৫ পাওয়া কয়েকজন ছেলেমেয়েকে কিছু প্রশ্ন করা হয়। শিক্ষার্থীরা সেসব প্রশ্নের উত্তর দিতে পারেনি। কখনো বা ভুল উত্তর দিয়েছে। পিথাগোরাস কে ছিলেন, তা তারা বলতে পারেনি। একজন বলেছে, পিথাগোরাস ছিলেন ঔপন্যাসিক। নিউটনের সূত্র কী, তারা কেউই বলতে পারেনি। জাতীয় সংগীতের রচয়িতা কে, এর উত্তরে একজন বলেছে, ‘কাজী নজরুল ইসলাম।’ বাকিরা পারেনি। স্বাধীনতা দিবস বলেছে ‘১৬ ডিসেম্বর’, বিজয় দিবস ‘২৬ ডিসেম্বর।’ বেশ সোজা প্রশ্ন, বেশ বিব্রতকর উত্তর। এই প্রতিবেদন দেখে প্রথমত একটা ধাক্কা লাগে। খানিকক্ষণ স্তব্ধ হয়ে থাকতে হয়। সংবিৎ ফিরে পেলে খ্যাতনামা সাংবাদিক জ. ই. মামুনের মতো প্রতিক্রিয়াও হতে পারে। মামুন ফেসবুক স্ট্যাটাসে বলেছেন, এটা ভালো সাংবাদিকতার উদাহরণ নয়; বরং এটা খারাপ সাংবাদিকতার লক্ষণ। আমার নিজেরও যা প্রতিক্রিয়া হয়েছিল, তা অনেকটা এ রকম: এই ছেলেমেয়ের পরিচয় টেলিভিশনে উন্মোচন করা ঠিক হয়নি। হঠাৎ করে টেলিভিশন ক্যামেরার সামনে আমরা অনেকেই জানা প্রশ্নের উত্তরও ভুলে যাই। মাথা একেবারে ফাঁকা ফাঁকা লাগে। দুই. সাধারণ জ্ঞান আদৌ কোনো জ্ঞানের প্রমাণ নয়; যা গুগল মুখস্থ করে রাখে, তা মনে রাখার কোনো মানে হয় না। আমি অনেক অসাধারণ সাধারণ জ্ঞানীকে জানি, যাঁরা বলে দিতে পারেন, বাংলা সাহিত্যের ‘ভোরের পাখি’ হলেন বিহারীলাল, কিন্তু এঁদের কেউ কোনো দিনও বিহারীলালের কবিতা এক লাইনও পড়ে দেখেননি।
৩ নম্বর যে প্রশ্নটা উঠে এসেছে তা হলো, লক্ষাধিক জিপিএ-৫ পাওয়া ছাত্রছাত্রীর মধ্যে গোটা দশেক বেছে নিয়ে তাদের হঠাৎ হঠাৎ প্রশ্ন করে তার উত্তর না পাওয়াটাই জরিপ হিসেবে নির্ভরযোগ্য কি না। অর্থাৎ এই জরিপের স্যাম্পল সাইজ, স্যাম্পল বেছে নেওয়ার প্রক্রিয়া এবং প্রশ্ন করার পদ্ধতি নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। এবং বলা হচ্ছে, একটা অযথাযথ প্রতিবেদনের মাধ্যমে আমাদের জিপিএ-৫ পাওয়া শিক্ষার্থীরা অকারণ অবমাননার শিকার হচ্ছে কি না। এসব প্রশ্ন মাথায় রেখেও আমরা বলতে পারব, আমাদের শিক্ষার মান পড়ে গেছে। যা বেড়েছে তা পরিমাণগত। কিন্তু গুণগত উৎকর্ষের মাপকাঠিতে আমাদের শিক্ষার মান বেশ খারাপ। তার মানে কিন্তু এই নয়, আগে যতজন মেধাবী ভালো ছাত্র আমরা পেতাম, ততজন এখন আর নেই! তার মানে এই নয়, এই শিক্ষাকাঠামোর ভেতর দিয়ে বেরিয়ে আসা মানুষের মধ্য থেকে আমরা আর এফ আর খানের মতো প্রকৌশলী, আনিসুজ্জামানের মতো অধ্যাপক, এম আর খানের মতো চিকিৎসক আর পাব না! শিক্ষা একটা আশ্চর্য পরশমণি, যা কাঠ বা কয়লাকেও সোনা বানাতে পারে। এই লাখ লাখ ছেলেমেয়ের মধ্য থেকে অনেকেই চূড়া ছুঁতে পারবে। অনেক বড় হিমালয় রেঞ্জ আছে বলেই আমরা এভারেস্ট নামের উচ্চতম চূড়াটা পাই, আমাদের লাখ লাখ শিক্ষার্থীর মধ্য থেকে অবশ্যই আমরা অনেক মানুষ পাব, যারা বিশ্বদরবারে আমাদের মুখ উজ্জ্বল করবে। আমি ড. দীপঙ্কর তালুকদারের উদাহরণ বারবার দেব। তিনি পড়াশোনা শুরু করেছিলেন বরগুনার পাঠশালায়, তারপর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, বরগুনা জিলা স্কুল, বরগুনা সরকারি কলেজ। এরপর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, সেখান থেকে ওয়াশিংটন স্টেট ইউনিভার্সিটি, আর জার্মানির আইনস্টাইন ইনস্টিটিউট। তিনি আমেরিকার সেই বিজ্ঞানী দলের একজন,
যাঁরা অভিকর্ষীয় তরঙ্গ শনাক্ত করতে পেরেছেন। যখন তিনি পড়তেন বরগুনার পাঠশালায়, যখন তাঁদের বাড়িতে খাবার ছিল না বলে তাঁর বড় ভাই স্কুল ছেড়ে রাস্তার ধারে বসে চাল-গম বিক্রি করছিলেন, তখন কে বলতে পারত, এই বালক একদিন যাবে আইনস্টাইন ইনস্টিটিউটে! কিন্তু তাই বলে প্রাথমিক বিদ্যালয় শেষ করে একজন শিক্ষার্থী সংবাদপত্র পাঠ করতে পারবে না, সাধারণ যোগ-বিয়োগ করতে পারবে না, নিজে থেকে এক পৃষ্ঠা লিখতে পারবে না, এটা হয় না। তেমনি বিজ্ঞানে মাধ্যমিক পাস করে একজন ছাত্র যদি বলতে না পারে নিউটনের তিনটা সূত্র কী, সেসব আসলে কী বোঝায়, তাহলে তো মাথায় হাত দেওয়া ছাড়া আর কিছু করার থাকে না। আমরা কি আমাদের শিক্ষার্থীদের নিয়ে বেশি পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে ফেললাম? যেমন সৃজনশীল প্রশ্নপদ্ধতি। নিশ্চয়ই আমাদের বিশেষজ্ঞরা বুঝে-শুনে, বিভিন্ন দেশ ভ্রমণ করে, ব্যাপক যাচাই-বাছাই করেই এই পদ্ধতি প্রবর্তন করেছিলেন। এই পদ্ধতি কি পরীক্ষামূলকভাবে কোথাও চালু করে দেখা হয়েছিল তার ফল কী হয়? নাকি একবারে শিক্ষার্থীদের ওপরই প্রয়োগ করে দেখা হয়েছে? যা-ই হোক না কেন, এই সুন্দর প্রবর্তনটিকে বাংলাদেশের কোচিং সেন্টার, প্রাইভেট টিউটর এবং নোটবই, গাইডবইওয়ালারা মিলে ব্যবসা করার এক অব্যর্থ পদ্ধতিতে পরিণত করতে পেরেছে। সৃজনশীল পদ্ধতির উদ্দেশ্য ছিল যাতে ছাত্রছাত্রীদের অকারণে মুখস্থ করতে না হয়। তারা জিনিসটা বুঝবে। প্রশ্ন তেমনিভাবে করা হবে, যাতে ছেলেমেয়েরা বুঝল কি না, তা যাচাই করা যায়। কিন্তু এটাকে আমরা এক বিভীষিকা বানিয়ে ফেলেছি। বহু শিক্ষক ছাত্রছাত্রীদের হুমকি দিলেন, আমার কাছে পড়তে না এলে তোরা জানবি না যে পরীক্ষায় কী আসবে। শুধু তা-ই নয়, তিনি সৃজনশীল প্রশ্নের উত্তরও তৈরি করে দেন, আর তিনি যা লিখে দিয়েছেন, তা না লিখে শিক্ষার্থীরা যদি নিজের মতো করে অন্য কিছু লেখে, তিনি তাকে আর নম্বর দিতে চান না। গাইডবইগুলোও তা-ই করল। সৃজনশীল প্রশ্নের নমুনা আর তার উত্তর ছাপাতে লাগল। এবং বিস্ময়কর ব্যাপার যে সেসব প্রশ্ন পরীক্ষার প্রশ্নপত্রে কমনও পড়তে লাগল। কোচিং সেন্টারগুলোর পোয়াবারো। কী করে পরীক্ষা নামের বৈতরণি পার হওয়া যাবে, তার উপযুক্ত বটিকা তৈরি করে তা ছাত্রছাত্রীদের খাইয়ে তারা নিজেরা ফুলেফেঁপে উঠতে লাগল। অধ্যাপক আবদুল্লাহ আবু সায়ীদের একটা উক্তি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়েছে। তিনি বলেছেন, সৃজনশীল পদ্ধতি কী,
তা বহু শিক্ষক নিজেরাই জানেন না। এ কথাও সত্যি। এ অবস্থায় গোদের ওপর বিষফোড়ার মতো দেখা দিল আরেক মহামারি। প্রশ্নপত্র ফাঁস হয়ে যাওয়া। ছাত্রছাত্রীরা প্রশ্ন পেয়ে পরীক্ষার আগের দিন সংবাদপত্র অফিসে এবং ড. মুহম্মদ জাফর ইকবালকে পাঠিয়ে দিল। পরের দিন তা মিলে গেলেও কর্তৃপক্ষ স্বীকার করল না যে প্রশ্নপত্র ফাঁস হয়েছে। আমরা তখনই বলেছিলাম, এরপরে আর বাচ্চারা পড়বে কেন। তারা প্রশ্নপত্রের জন্য অপেক্ষা করবে। শুধু কি পাবলিক পরীক্ষার প্রশ্নপত্র? মেডিকেল কলেজের ভর্তি পরীক্ষার প্রশ্নপত্রও ফাঁস হয়েছিল। এসব নিয়ে অভিযান, গ্রেপ্তার ইত্যাদি ঘটনাও ঘটেছে। আমাদের স্বীকার করে নিতে হবে যে, শিক্ষার মান পড়ে গেছে এবং অবস্থা ভয়াবহ। আমরা খাদের কিনারে দাঁড়িয়ে আছি কিংবা খাদে পড়েই গেছি। এ জন্য আমরা কিছুতেই শিক্ষার্থীদের দায়ী করছি না। তারা অসহায় শিকার মাত্র। এ আমার পাপ, এ তোমার পাপ! আমরা, সংবাদমাধ্যমের কর্মীরা কিংবা সমাজকর্মীরা কোনো দিন কি কোনো প্রাথমিক বিদ্যালয়ে গেছি, গিয়ে খোঁজ নেওয়ার চেষ্টা করেছি, সেখানে কী হচ্ছে! শিক্ষকেরা এসেছেন কি না, এলে তাঁরা কী পড়াচ্ছেন, আর বাচ্চারাই বা কী শিখছে। প্রাথমিক বিদ্যালয়ে, মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে শিক্ষক নিয়োগ নিয়ে তুলকালাম হয়েছে। আমরা শুনেছি, শিক্ষক নিয়োগের প্রশ্নপত্র ফাঁস হয়েছে। আমরা শুনেছি, লাখ লাখ টাকা খরচা করে কেউ কেউ শিক্ষক হয়েছেন। এগুলো অনেক নেতা-পাতিনেতার আয়ের প্রধান উৎস হয়ে দাঁড়িয়েছে। আমরা কোনো দিনও ঘটনা তদন্ত করে দেখিনি। যাঁরা হবেন মানুষ গড়ার কারিগর, তাঁরা যদি ঘুষ দিয়ে নিয়োগ পান, তাঁরা কী শেখাবেন? তাঁদের নিজেদেরই বা জানাশোনা-বোঝার পরিধিটা কতটুকুন? দুর্নীতি, স্বজনপ্রীতি, দলবাজি নিয়ে এ দেশে এখন আর কেউ কথা বলে না। এটাকে আমরা এখন খুবই স্বাভাবিক নিয়ম বলে ধরে নিয়েছি। এখন বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য নিয়োগের সময় অনেক ক্ষেত্রে প্রধান বিবেচনা থাকে তিনি আমার দলের লোক কি না। শিক্ষক নিয়োগের সময়ও নিশ্চয়ই এটা অনেক জায়গায় মান্য করা হয়। প্রাথমিক থেকে বিশ্ব—সব বিদ্যালয়ের একটা দিক আছে—ভয়াবহ অন্ধকার। নিশ্চয়ই অনেক আলোকিত দিকও আছে। অন্ধকারে একটা আলোর কথা আমি বলতে পারব। প্রথম আলোর ভাষা প্রতিযোগ,
গণিত অলিম্পিয়াডে যে বাচ্চারা আসে, তারা তো পরীক্ষায় ভালো করে। সেখানে তো প্রশ্নপত্র ফাঁস হয় না, কেউ কারওটা দেখেও লেখে না। আর শিক্ষার্থীরা যে ধরনের প্রশ্ন করে, তাতে তাদের মেধার উৎকর্ষ দেখে সবাই বিস্মিত হয়ে যান। আমি এক ১২-১৩ বছরের কিশোরকে দেখেছিলাম, সে এসেছিল একটা মাদ্রাসা থেকে, বাংলা সাহিত্য ও ভাষা নিয়ে তার যে আগ্রহ, এবং তার যে জানাশোনার পরিধি, তা আমাদের মুগ্ধ করেছিল। গণিত অলিম্পিয়াডে যোগ দিতে এসেছিলেন একজন, কুষ্টিয়া থেকে। কুষ্টিয়াতেই তিনি শেষ করেছিলেন স্কুল ও কলেজ। গণিত অলিম্পিয়াডে ভালো করায় বাংলা মাধ্যমের সেই শিক্ষার্থী সরাসরি ভর্তি হলেন হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে, উচ্চমাধ্যমিকের পরই। সম্প্রতি তিনি গ্র্যাজুয়েশন শেষ করেছেন। তাঁরা কয়েকজন বন্ধু মিলে একটা কোম্পানি দিয়েছেন, ছাত্রাবস্থাতেই, বিল গেটস কিংবা জাকারবার্গের মতোই এবং সান ফ্রান্সিসকোতে তাঁদের কোম্পানি। তাঁরা স্টার্টআপ কোম্পানি দিয়েছেন চলচ্চিত্র বিষয়ে। এটা তথ্যপ্রযুক্তি, অর্থনীতি মিলেমিশে করা একটা ব্যাপার। সেই ছেলেটির নাম তারিক আদনান মুন। তাঁর সাফল্যের গল্প রূপকথাকেও হার মানাবে। তিনিও কিন্তু জিপিএ-৫ পাওয়া। গণিত অলিম্পিয়াডের সাধারণ সম্পাদক মুনির হাসান আমাকে বলেছেন, তাঁদের পরীক্ষায় ছেলেমেয়েরা আগের চেয়ে ভালো করে এবং ভালো করা ছেলেমেয়েদের সংখ্যাও অনেক বেড়েছে। কাজেই বেশি হতাশ হব না। কিন্তু তাই বলে শিক্ষা খাতে বাজেট বাড়ানোর দাবিও ছাড়ছি না। এবং আমরা চাইব, শিক্ষার প্রতিটি স্তরে যাচাই-বাছাই করে দেখা হোক, আমরা কোথায় কোথায় ভুল করেছি, করছি। বোধ হয় খোলনলচে পাল্টানোর সময় হয়েছে। তা করতে হলে বালুতে মুখ গুঁজে থেকে সমস্যা অস্বীকার করা থেকে বিরত থাকতে হবে।
আনিসুল হক: সাহিত্যিক ও সাংবাদিক।
আনিসুল হক: সাহিত্যিক ও সাংবাদিক।
No comments