বাংলাদেশের নতুন সাবমেরিন ঘাঁটি ভারতের উত্তেজনা ফিরিয়ে আনতে পারে by আরশাদ মাহমুদ
বাংলাদেশ
তিন বছর আগে চীনের কাছ থেকে ২০৩ মিলিয়ন ডলার ব্যয়ে যে দুটি সাবমেরিন
কিনেছিল, সেগুলো রাখা ও রক্ষণাবেক্ষণের জন্য একটি স্থায়ী ঘাঁটি নির্মাণের
ব্যাপারে চীনের সাথে চুক্তি স্বাক্ষরের প্রায় দ্বারপ্রান্তে রয়েছে
বাংলাদেশ।
প্রস্তাবিত ঘাঁটিটি নির্মিত হবে কক্সবাজার জেলার কুতুবদিয়া উপকূলের কাছে পেকুয়াতে। সাবমেরিন কেনার প্রক্রিয়ায় জড়িত ছিলেন নৌবাহিনীর এমন একজন অবসরপ্রাপ্ত কর্মকর্তা বলেন, “দুটো সাবমেরিন রাখা এবং সেগুলোর রক্ষণাবেক্ষণের জন্য আমাদের স্থায়ী একটা ব্যবস্থা দরকার”। এগুলোকে এখন চট্টগ্রামের উপকূলের কাছে অস্থায়ীভাবে রাখা হয়েছে।
তিনি আরও বলেন, “এটা করাটা ছিল যৌক্তিক, কারণ চীন সাবমেরিনগুলো সরবরাহ করেছে এবং তারা প্রযুক্তিগত বিষয়ে অবগত ও ঘাঁটি তৈরির অভিজ্ঞতা তাদের রয়েছে”। পরিচয় প্রকাশ না করার শর্তে তিনি বলেন, “এটা একটা স্পর্শকাতর বিষয়”। এমনিতেও চুক্তিটা করার ব্যাপারে এতটা গোপনীয়তা রক্ষা করা হয়েছে যে, কিছু অভিজ্ঞ প্রতিরক্ষা বিশ্লেষক ও নিরাপত্তা বিশেষজ্ঞ পর্যন্ত অবাক হয়ে গেছেন।
প্রস্তাবিত ঘাঁটিটি নির্মিত হবে কক্সবাজার জেলার কুতুবদিয়া উপকূলের কাছে পেকুয়াতে। সাবমেরিন কেনার প্রক্রিয়ায় জড়িত ছিলেন নৌবাহিনীর এমন একজন অবসরপ্রাপ্ত কর্মকর্তা বলেন, “দুটো সাবমেরিন রাখা এবং সেগুলোর রক্ষণাবেক্ষণের জন্য আমাদের স্থায়ী একটা ব্যবস্থা দরকার”। এগুলোকে এখন চট্টগ্রামের উপকূলের কাছে অস্থায়ীভাবে রাখা হয়েছে।
তিনি আরও বলেন, “এটা করাটা ছিল যৌক্তিক, কারণ চীন সাবমেরিনগুলো সরবরাহ করেছে এবং তারা প্রযুক্তিগত বিষয়ে অবগত ও ঘাঁটি তৈরির অভিজ্ঞতা তাদের রয়েছে”। পরিচয় প্রকাশ না করার শর্তে তিনি বলেন, “এটা একটা স্পর্শকাতর বিষয়”। এমনিতেও চুক্তিটা করার ব্যাপারে এতটা গোপনীয়তা রক্ষা করা হয়েছে যে, কিছু অভিজ্ঞ প্রতিরক্ষা বিশ্লেষক ও নিরাপত্তা বিশেষজ্ঞ পর্যন্ত অবাক হয়ে গেছেন।
চীন থেকে কেনা সাবমেরিন বাংলাদেশ নৌবাহিনীতে আনুষ্ঠানিকভাবে সংযুক্ত করছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা |
বিশিষ্ট
নিরাপত্তা বিশ্লেষক অবসরপ্রাপ্ত এয়ার কমোডর ইশফাক ইলাহি চৌধুরি এশিয়া
টাইমসকে বলেন, “পেকুয়া বা অন্য কোথাও বাংলাদেশ কোন সাবমেরিন ঘাঁটি তৈরি
করছে কি না, সে ব্যাপারে আমার কিছু জানা নেই”। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ২০১৬ সালে
সাবমেরিন কেনার সময় বাংলাদেশ ভারতের কাছ থেকে যে নেতিবাচক প্রতিক্রিয়া
পেয়েছিল, সেই ধরনের প্রতিক্রিয়া এড়ানোর জন্যই এই গোপনীয়তা রক্ষা করা হচ্ছে।
ভারতের উদ্বেগ
বাংলাদেশের সাবমেরিন কেনার সংবাদ প্রকাশিত হওয়া এবং ২০১৬ সালের ৩০ অক্টোবর প্রথম সাবমেরিন হস্তান্তরের মাত্র দুই সপ্তাহ পরেই তৎকালীন ভারতের প্রতিরক্ষামন্ত্রী মনোহর পারিকার ঢাকায় ছুটে আসেন। এর কয়েকদিন পরেই আসেন ভারতের সেনাবাহিনী প্রধান জেনারেল বিপিন রাওয়াত।
ঢাকায় ভারতের শীর্ষ কর্মকর্তাদের ছুটে আসা ছাড়াও ভারতীয় নিরাপত্তা বিশেষজ্ঞরা বাংলাদেশের সাবমেরিন কেনার পদক্ষেপের সমালোচনা করে বলেছিলেন যে, ভারতের বন্ধুপ্রতীম প্রতিবেশী দেশে নিজেদের অবস্থান পোক্ত করতেই চীন এই সাবমেরিন বিক্রি করছে এবং তাদের উদ্দেশ্য হলো ভারতকে চারপাশ থেকে ঘিরে ফেলা। ভারতের এই প্রতিক্রিয়ায় তাদের বন্ধু হিসেবে পরিচিত শেখ হাসিনার সরকার উদ্বিগ্ন হয়ে ওঠে।
হাসিনা প্রশাসন ভারতের উদ্বেগ নিরসনের চেষ্টা করে। তারা জোর দিয়ে জানায় যে, ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় ভারতের ভূমিকার জন্য বাংলাদেশ তাদের প্রতি কৃতজ্ঞ এবং তারা এমন কিছুই করবে না, যেটা ভারতের কৌশলগত স্বার্থের ক্ষতি করতে পারে।
পুরনো মডেল ঢেলে সাজানো
নৌবাহিনীর সাবেক কর্মকর্তা এশিয়া টাইমসকে বলেন, সাবমেরিন নিয়ে ভারত যে প্রতিক্রিয়া দেখিয়েছিল, “সেটা ছিল অতিরঞ্জিত এবং সেগুলোর কোন ভিত্তি ছিল না”।
তিনি আরও জানান, “এগুলো পুরনো মডেল ঘষে মেজে ঠিক করা হয়েছে, এবং এগুলো কেনার প্রধান লক্ষ্য হলো প্রশিক্ষণ এবং এটা নৌবাহিনী মানসিক শক্তি বাড়িয়ে দেয়”। তাছাড়া, যে ৪০টি দেশের সাবমেরিন রয়েছে, তাদের একটি হতে পারাটাও একটা গর্বের বিষয়। গ্লোবালফায়ারপাওয়ারের মতে, বর্তমানে উত্তর কোরিয়ার সর্বোচ্চ ৮৬টি এবং বাংলাদেশের সবচেয়ে কম – দুইটি সাবমেরিন রয়েছে।
সাবেক নৌবাহিনী কর্মকর্তা তার মন্তব্যে বলেন, বিশ্বের সব জায়গাতেই বড় ধরনের সামরিক ক্রয়ের ক্ষেত্রে কিছু স্বার্থবাদী গ্রুপের দুর্নীতি দেখা যায়, যাদের সাথে মূলত ক্ষমতাসীন দলের যোগসাজশ থাকে, এবং সেখানে আসলে কোন কৌশলগত স্বার্থ থাকে না।
ভারত তাদের বিশাখাপত্তম সাবমেরিন একাডেমিতে বাংলাদেশের নৌবাহিনীর জওয়ানদের প্রশিক্ষণ দেয়ার প্রস্তাব দিয়েছে মর্মে যে রিপোর্ট প্রকাশিত হয়েছে, সেটিকেও অবাস্তব হিসেবে বাতিল করে দেন তিনি।
“বাংলাদেশ যেখানে চীনা সাবমেরিন ব্যবহার করছে, সেখানে প্রশিক্ষণের জন্য বাংলাদেশের জওয়ানদের ভারত যাওয়ার কোন অর্থ হয় না”।
চীনা উপস্থিতি বৃদ্ধি
কিন্তু কিছু বিশ্লেষক এখনও স্থায়ী সাবমেরিন ঘাঁটি নির্মাণের যৌক্তিকতা খুঁজে পাচ্ছেন না। নিরাপত্তা বিশ্লেষক এয়ার কমোডর চৌধুরি বলেছেন, “আমি মনে করি না, দুটো মাত্র সাবমেরিনের জন্য একটা সাবমেরিন ঘাঁটি তৈরি করাটা সরঞ্জামের দিক থেকে গ্রহণযোগ্য, যদি না কারো পুরো একটি বহর গড়ে তোলার পরিকল্পনা থাকে”।
তিনি আরও বলেন, বাংলাদেশের এ রকম দু-একটা সাবমেরিনের কারণে ভারত উদ্বিগ্ন হচ্ছে না, “বরং এ অঞ্চলে চীনের সামরিক পদচ্ছাপ বেড়ে যাচ্ছে বলে উদ্বিগ্ন হচ্ছে”।
তিনি বলেন, যেমন ধরুন বঙ্গোপসাগর ও ভারত মহাসাগরে চীনের উপস্থিতি বৃদ্ধি পেয়েছে, যেটাকে ভারত সবসময় নিজেদের অঞ্চল ভেবে এসেছে। মিয়ানমারের সিত্তুইয়ে চীন রয়েছে, শ্রীলংকার হামবানতোতায় তারা রয়েছে, পাকিস্তানের গোয়াদরে তারা রয়েছে, তানজানিয়ার মোম্বাসাতে তারা রয়েছে, জিবুতি ও মরিশাসেও চীনের উপস্থিতি রয়েছে।
ভারতের নিরাপত্তা বিশেষজ্ঞরা এটাকেই বলছে ‘মুক্তার মালা’। যেগুলোর মাধ্যমে ভারতকে ঘিরে ফেলে তাদের সাগর সীমায় অবাধ চলাচলকে চীন ব্যাহত করতে চায়।
‘উসকানিমূলক আচরণ’
এটা কিছু ভারতীয় সামরিক বিশেষজ্ঞ ও বিশ্লেষকদের উদ্বিগ্ন করেছে, যারা তিন বছর আগে সাবমেরিন কেনার খবর প্রকাশের পর গভীর উদ্বেগ জানিয়েছিল। স্থায়ী ঘাঁটি নির্মাণের চুক্তি আবার তাদের উদ্বেগ উসকে দিতে পারে।
২০১৬ সালে বাংলাদেশের সাবমেরিক কেনার খবর প্রকাশের পর ভারতীয় নৌবাহিনীর অবসরপ্রাপ্ত অ্যাডমিরাল ও সাবেক বাহিনী প্রধান অরুণ প্রকাশ ডিফেন্সনিউজকে বলেছিলেন যে, “বাংলাদেশের যে অর্থনৈতিক পরিস্থিতি এবং তারা যেহেতু তিনদিকে ভারত দ্বারা বেষ্টিত, সে ক্ষেত্রে সাবমেরিন কেনাটা তাদের জন্য শুধু অযৌক্তিকই নয়, বরং ভারতের প্রতি একটা উসকানিও বটে”।
প্রকাশ আরও বলেন, “সাবমেরিন আগ্রাসী অস্ত্র এবং তাদের একমাত্র কাজ হলো সাগরে প্রবেশে বাধা সৃষ্টি করা এবং এগুলো ভারতের জন্য হুমকি সৃষ্টি করে তাদের নৌ নিরাপত্তা ব্যবস্থাকে জটিল করে তুলবে। এটা নিশ্চিত যে, ভারতকে তাদের গ্রাহক রাষ্ট্রগুলো দিয়ে ঘিরে ফেলার জন্য চীনা কৌশলের অংশ এটা”।
অতিরঞ্জিত ভয়
বাংলাদেশের পররাষ্ট্র নীতি বিশ্লেষকদের কয়েকজন ভারতের ভয়কে অতিরঞ্জিত মনে করেন, যেগুলোর কোন বাস্তব ভিত্তি নেই।
সিনিয়র পররাষ্ট্র নীতি বিশ্লেষক ও সাবেক কূটনীতিক মহিউদ্দিন আহমেদ এশিয়া টাইমসকে বলেন, “ভারতের নিরাপত্তা স্বার্থের ক্ষতি করবে, এ রকম কোন কিছু করাটা হাসিনা সরকারের জন্য অবিশ্বাস্য”।
তিনি আরও বলেন, “ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ ও ভারতের রাজনৈতিক মহলের মধ্যে যে ঐতিহাসিক সম্পর্ক রয়েছে, সেটা ছাড়াও ভারতের প্রতি শেখ হাসিনার গভীর ব্যক্তিগত ঋণ রয়েছে, কারণ তার সবচেয়ে দুঃসময়ে ভারত তার সাহায্যে এগিয়ে এসেছিল”।
১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট হাসিনার পিতা তৎকালিন প্রেসিডেন্ট শেখ মুজিবুর রহমান সামরিক অভ্যুত্থানের মাধ্যমে নিহত হন। মুজিবের সাথে সাথে তার পরিবারের অধিকাংশ সদস্যও নিহত হয়।
হাসিনা, তার সন্তানেরা এবং তার আরেক বোন শেষ রেহানা সে সময় পশ্চিম জার্মানিতে অবস্থান করার কারণে হত্যাকান্ড থেকে বেঁচে যান।
সে সময় ভারতই একমাত্র তাদের সাহায্যে এগিয়ে এসেছিল। হাসিনা আর তার পরিবারকে আশ্রয় দিয়েছিল নয়াদিল্লী এবং সেখানে ছয় বছর থাকার পর ১৯৮১ সালে নির্বাসন থেকে দেশে ফিরে আসেন হাসিনা।
‘সবচেয়ে বড় সুবিধাভোগী ভারত’
সে সময়টাতে শুধু ভারতের প্রভাবই উল্লেখযোগ্য মাত্রায় হ্রাস পায়নি, বরং আরও উদ্বেগজনক হলো ভারতের প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী পাকিস্তানকেও ভারত-বিরোধী সরকারগুলো খোলামেলা স্বাগত জানিয়েছিল।
১৯৯৬ সালে, হাসিনা যখন ক্ষমতায় আসেন, তখন ভারতের জন্য পরিস্থিতি বদলে যেতে শুরু করে।
এর কিছুকাল পরেই, বড় ধরনের কৌশলগত পদক্ষেপ নিয়ে হাসিনা পার্বত্য চট্টগ্রাম এলাকার সবগুলো জঙ্গি ক্যাম্প ধ্বংসের নির্দেশ দেন, যেখান থেকে ভারতের বিচ্ছিন্নতাবাদীরা মাঝে মাঝেই ভারতের অস্থির উত্তরপূর্বাঞ্চলীয় প্রদেশগুলোতে হামলা চালাতো।
এটা প্রায় সবাই জানতো যে, পাকিস্তানের ইন্টার-সার্ভিসেস ইন্টেলিজেন্স (আইএসআই) ভারতীয় বিদ্রোহীদের প্রশিক্ষণ ও তহবিল দিতো।
সাবেক পররাষ্ট্র সচিব আহমেদ বলেন, “ভারত হাসিনার জন্য যা করেছিল, তার জন্য কৃতজ্ঞতাস্বরূপ হাসিনা এটা করেছিল যাতে বাংলাদেশের সদিচ্ছার ব্যাপারে ভারতের আত্মবিশ্বাস অর্জন করা যায়”।
“ভারতের জন্য এটা একটা দুঃস্বপ্নের মতো হতো যদি তারা পূর্ব পাকিস্তানের আরেকটি উত্থান দেখতো, যেমনটা বাংলাদেশে ১৯৭৫ থেকে ১৯৯৬ সাল পর্যন্ত ঘটেছিল”।
ভারতের উদ্বেগ
বাংলাদেশের সাবমেরিন কেনার সংবাদ প্রকাশিত হওয়া এবং ২০১৬ সালের ৩০ অক্টোবর প্রথম সাবমেরিন হস্তান্তরের মাত্র দুই সপ্তাহ পরেই তৎকালীন ভারতের প্রতিরক্ষামন্ত্রী মনোহর পারিকার ঢাকায় ছুটে আসেন। এর কয়েকদিন পরেই আসেন ভারতের সেনাবাহিনী প্রধান জেনারেল বিপিন রাওয়াত।
ঢাকায় ভারতের শীর্ষ কর্মকর্তাদের ছুটে আসা ছাড়াও ভারতীয় নিরাপত্তা বিশেষজ্ঞরা বাংলাদেশের সাবমেরিন কেনার পদক্ষেপের সমালোচনা করে বলেছিলেন যে, ভারতের বন্ধুপ্রতীম প্রতিবেশী দেশে নিজেদের অবস্থান পোক্ত করতেই চীন এই সাবমেরিন বিক্রি করছে এবং তাদের উদ্দেশ্য হলো ভারতকে চারপাশ থেকে ঘিরে ফেলা। ভারতের এই প্রতিক্রিয়ায় তাদের বন্ধু হিসেবে পরিচিত শেখ হাসিনার সরকার উদ্বিগ্ন হয়ে ওঠে।
হাসিনা প্রশাসন ভারতের উদ্বেগ নিরসনের চেষ্টা করে। তারা জোর দিয়ে জানায় যে, ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় ভারতের ভূমিকার জন্য বাংলাদেশ তাদের প্রতি কৃতজ্ঞ এবং তারা এমন কিছুই করবে না, যেটা ভারতের কৌশলগত স্বার্থের ক্ষতি করতে পারে।
পুরনো মডেল ঢেলে সাজানো
নৌবাহিনীর সাবেক কর্মকর্তা এশিয়া টাইমসকে বলেন, সাবমেরিন নিয়ে ভারত যে প্রতিক্রিয়া দেখিয়েছিল, “সেটা ছিল অতিরঞ্জিত এবং সেগুলোর কোন ভিত্তি ছিল না”।
তিনি আরও জানান, “এগুলো পুরনো মডেল ঘষে মেজে ঠিক করা হয়েছে, এবং এগুলো কেনার প্রধান লক্ষ্য হলো প্রশিক্ষণ এবং এটা নৌবাহিনী মানসিক শক্তি বাড়িয়ে দেয়”। তাছাড়া, যে ৪০টি দেশের সাবমেরিন রয়েছে, তাদের একটি হতে পারাটাও একটা গর্বের বিষয়। গ্লোবালফায়ারপাওয়ারের মতে, বর্তমানে উত্তর কোরিয়ার সর্বোচ্চ ৮৬টি এবং বাংলাদেশের সবচেয়ে কম – দুইটি সাবমেরিন রয়েছে।
সাবেক নৌবাহিনী কর্মকর্তা তার মন্তব্যে বলেন, বিশ্বের সব জায়গাতেই বড় ধরনের সামরিক ক্রয়ের ক্ষেত্রে কিছু স্বার্থবাদী গ্রুপের দুর্নীতি দেখা যায়, যাদের সাথে মূলত ক্ষমতাসীন দলের যোগসাজশ থাকে, এবং সেখানে আসলে কোন কৌশলগত স্বার্থ থাকে না।
ভারত তাদের বিশাখাপত্তম সাবমেরিন একাডেমিতে বাংলাদেশের নৌবাহিনীর জওয়ানদের প্রশিক্ষণ দেয়ার প্রস্তাব দিয়েছে মর্মে যে রিপোর্ট প্রকাশিত হয়েছে, সেটিকেও অবাস্তব হিসেবে বাতিল করে দেন তিনি।
“বাংলাদেশ যেখানে চীনা সাবমেরিন ব্যবহার করছে, সেখানে প্রশিক্ষণের জন্য বাংলাদেশের জওয়ানদের ভারত যাওয়ার কোন অর্থ হয় না”।
চীনা উপস্থিতি বৃদ্ধি
কিন্তু কিছু বিশ্লেষক এখনও স্থায়ী সাবমেরিন ঘাঁটি নির্মাণের যৌক্তিকতা খুঁজে পাচ্ছেন না। নিরাপত্তা বিশ্লেষক এয়ার কমোডর চৌধুরি বলেছেন, “আমি মনে করি না, দুটো মাত্র সাবমেরিনের জন্য একটা সাবমেরিন ঘাঁটি তৈরি করাটা সরঞ্জামের দিক থেকে গ্রহণযোগ্য, যদি না কারো পুরো একটি বহর গড়ে তোলার পরিকল্পনা থাকে”।
তিনি আরও বলেন, বাংলাদেশের এ রকম দু-একটা সাবমেরিনের কারণে ভারত উদ্বিগ্ন হচ্ছে না, “বরং এ অঞ্চলে চীনের সামরিক পদচ্ছাপ বেড়ে যাচ্ছে বলে উদ্বিগ্ন হচ্ছে”।
তিনি বলেন, যেমন ধরুন বঙ্গোপসাগর ও ভারত মহাসাগরে চীনের উপস্থিতি বৃদ্ধি পেয়েছে, যেটাকে ভারত সবসময় নিজেদের অঞ্চল ভেবে এসেছে। মিয়ানমারের সিত্তুইয়ে চীন রয়েছে, শ্রীলংকার হামবানতোতায় তারা রয়েছে, পাকিস্তানের গোয়াদরে তারা রয়েছে, তানজানিয়ার মোম্বাসাতে তারা রয়েছে, জিবুতি ও মরিশাসেও চীনের উপস্থিতি রয়েছে।
ভারতের নিরাপত্তা বিশেষজ্ঞরা এটাকেই বলছে ‘মুক্তার মালা’। যেগুলোর মাধ্যমে ভারতকে ঘিরে ফেলে তাদের সাগর সীমায় অবাধ চলাচলকে চীন ব্যাহত করতে চায়।
‘উসকানিমূলক আচরণ’
এটা কিছু ভারতীয় সামরিক বিশেষজ্ঞ ও বিশ্লেষকদের উদ্বিগ্ন করেছে, যারা তিন বছর আগে সাবমেরিন কেনার খবর প্রকাশের পর গভীর উদ্বেগ জানিয়েছিল। স্থায়ী ঘাঁটি নির্মাণের চুক্তি আবার তাদের উদ্বেগ উসকে দিতে পারে।
২০১৬ সালে বাংলাদেশের সাবমেরিক কেনার খবর প্রকাশের পর ভারতীয় নৌবাহিনীর অবসরপ্রাপ্ত অ্যাডমিরাল ও সাবেক বাহিনী প্রধান অরুণ প্রকাশ ডিফেন্সনিউজকে বলেছিলেন যে, “বাংলাদেশের যে অর্থনৈতিক পরিস্থিতি এবং তারা যেহেতু তিনদিকে ভারত দ্বারা বেষ্টিত, সে ক্ষেত্রে সাবমেরিন কেনাটা তাদের জন্য শুধু অযৌক্তিকই নয়, বরং ভারতের প্রতি একটা উসকানিও বটে”।
প্রকাশ আরও বলেন, “সাবমেরিন আগ্রাসী অস্ত্র এবং তাদের একমাত্র কাজ হলো সাগরে প্রবেশে বাধা সৃষ্টি করা এবং এগুলো ভারতের জন্য হুমকি সৃষ্টি করে তাদের নৌ নিরাপত্তা ব্যবস্থাকে জটিল করে তুলবে। এটা নিশ্চিত যে, ভারতকে তাদের গ্রাহক রাষ্ট্রগুলো দিয়ে ঘিরে ফেলার জন্য চীনা কৌশলের অংশ এটা”।
অতিরঞ্জিত ভয়
বাংলাদেশের পররাষ্ট্র নীতি বিশ্লেষকদের কয়েকজন ভারতের ভয়কে অতিরঞ্জিত মনে করেন, যেগুলোর কোন বাস্তব ভিত্তি নেই।
সিনিয়র পররাষ্ট্র নীতি বিশ্লেষক ও সাবেক কূটনীতিক মহিউদ্দিন আহমেদ এশিয়া টাইমসকে বলেন, “ভারতের নিরাপত্তা স্বার্থের ক্ষতি করবে, এ রকম কোন কিছু করাটা হাসিনা সরকারের জন্য অবিশ্বাস্য”।
তিনি আরও বলেন, “ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ ও ভারতের রাজনৈতিক মহলের মধ্যে যে ঐতিহাসিক সম্পর্ক রয়েছে, সেটা ছাড়াও ভারতের প্রতি শেখ হাসিনার গভীর ব্যক্তিগত ঋণ রয়েছে, কারণ তার সবচেয়ে দুঃসময়ে ভারত তার সাহায্যে এগিয়ে এসেছিল”।
১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট হাসিনার পিতা তৎকালিন প্রেসিডেন্ট শেখ মুজিবুর রহমান সামরিক অভ্যুত্থানের মাধ্যমে নিহত হন। মুজিবের সাথে সাথে তার পরিবারের অধিকাংশ সদস্যও নিহত হয়।
হাসিনা, তার সন্তানেরা এবং তার আরেক বোন শেষ রেহানা সে সময় পশ্চিম জার্মানিতে অবস্থান করার কারণে হত্যাকান্ড থেকে বেঁচে যান।
সে সময় ভারতই একমাত্র তাদের সাহায্যে এগিয়ে এসেছিল। হাসিনা আর তার পরিবারকে আশ্রয় দিয়েছিল নয়াদিল্লী এবং সেখানে ছয় বছর থাকার পর ১৯৮১ সালে নির্বাসন থেকে দেশে ফিরে আসেন হাসিনা।
‘সবচেয়ে বড় সুবিধাভোগী ভারত’
সে সময়টাতে শুধু ভারতের প্রভাবই উল্লেখযোগ্য মাত্রায় হ্রাস পায়নি, বরং আরও উদ্বেগজনক হলো ভারতের প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী পাকিস্তানকেও ভারত-বিরোধী সরকারগুলো খোলামেলা স্বাগত জানিয়েছিল।
১৯৯৬ সালে, হাসিনা যখন ক্ষমতায় আসেন, তখন ভারতের জন্য পরিস্থিতি বদলে যেতে শুরু করে।
এর কিছুকাল পরেই, বড় ধরনের কৌশলগত পদক্ষেপ নিয়ে হাসিনা পার্বত্য চট্টগ্রাম এলাকার সবগুলো জঙ্গি ক্যাম্প ধ্বংসের নির্দেশ দেন, যেখান থেকে ভারতের বিচ্ছিন্নতাবাদীরা মাঝে মাঝেই ভারতের অস্থির উত্তরপূর্বাঞ্চলীয় প্রদেশগুলোতে হামলা চালাতো।
এটা প্রায় সবাই জানতো যে, পাকিস্তানের ইন্টার-সার্ভিসেস ইন্টেলিজেন্স (আইএসআই) ভারতীয় বিদ্রোহীদের প্রশিক্ষণ ও তহবিল দিতো।
সাবেক পররাষ্ট্র সচিব আহমেদ বলেন, “ভারত হাসিনার জন্য যা করেছিল, তার জন্য কৃতজ্ঞতাস্বরূপ হাসিনা এটা করেছিল যাতে বাংলাদেশের সদিচ্ছার ব্যাপারে ভারতের আত্মবিশ্বাস অর্জন করা যায়”।
“ভারতের জন্য এটা একটা দুঃস্বপ্নের মতো হতো যদি তারা পূর্ব পাকিস্তানের আরেকটি উত্থান দেখতো, যেমনটা বাংলাদেশে ১৯৭৫ থেকে ১৯৯৬ সাল পর্যন্ত ঘটেছিল”।
২০১৭ সালের ৮ এপ্রিল নয়াদিল্লিতে এক অনুষ্ঠানে বক্তব্য রাখছেন বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, ছবি: এএফপি |
No comments