সাশ্রয়ে, স্বস্তিতে কৃষক by আনোয়ার হোসেন
নিজের বাড়িতে কেঁচো কম্পোস্ট সার তৈরির কৌশল বলছেন নাসির উদ্দিন l প্রথম আলো |
বেশভূষায়
গ্রামের আর দশজন সাধারণ কৃষকের মতোই। জীবন-যাপনের ধরনেও অন্য কৃষকদের
থেকে আলাদা করা যাবে না তাঁকে। তবে নিজের কাজ দিয়ে নিজেকে অনন্য করেছেন
তিনি।
সমাজবিজ্ঞানে সম্মানসহ স্নাতক ও ইংরেজিতে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি নিয়ে কৃষিকাজকে পেশা হিসেবে নিয়েছেন নওগাঁর পত্নীতলা উপজেলার ফতেপুর গ্রামের নাসির উদ্দীন (৪৭)। পরিবেশবিরোধী ব্যয়বহুল রাসায়নিক সার ও কীটনাশকের বদলে সাশ্রয়ী পরিবেশবান্ধব কেঁচো কম্পোস্ট সার তৈরি করছেন তিনি। তৈরি করছেন জৈব কীটনাশকও। সার ও কীটনাশক তৈরির কৌশল শিখিয়ে তা ব্যবহারে উদ্বুদ্ধ করছেন কৃষকদের। এভাবে চালিয়ে যাচ্ছেন জৈব কৃষি আন্দোলন।
কৃষিকে পেশা হিসেবে নেওয়া প্রসঙ্গে নাসির বলেন, ‘ঢাকায় তৈরি পোশাক কারখানায় চাকরি নিয়েছিলাম। শহরের পরিবেশ, খাওয়া-দাওয়া কিছুই ভালো লাগত না। ১০ থেকে ১২ বছর আগে জন্ডিসে আক্রান্ত হয়ে বাড়ি ফিরে আসি। এই গ্রাম আর কৃষির প্রতি ভালোবাসার টানে কৃষিকেই পেশা হিসেবে নিলাম।’
নাসিরের জৈব কৃষি আন্দোলন শুরুর পেছনে একটা কষ্টের গল্প আছে। সেই গল্পটা শোনালেন তাঁর স্ত্রী আয়েশা খাতুন, ‘প্রায় চার বছর আগে বাড়ির একটি স্বাস্থ্যবান বকনা গরু খেত থেকে চরে এসে অসুস্থ হয়ে পড়ে। গ্রামের মানুষের পরামর্শে গরু জবাই করা হয়। কিন্তু মাংস কাটতে গিয়ে দেখা গেল, মাংস স্বাভাবিক নয়। পরে মাটিতে পুঁতে ফেলা হয়। সবার ধারণা, কীটনাশক স্প্রে করা কোনো খেতের ফসল খেয়ে গরুটির এ দশা। গরুটির মৃত্যুতে আমরা মুষড়ে পড়ি।’ আয়েশা জানালেন, ঠিক তখন থেকে নাসির ভাবতে শুরু করলেন জমিতে রাসায়নিক সার ও কীটনাশক ব্যবহার কীভাবে বন্ধ করা যায়। আর সেই ভাবনা থেকেই তাঁর মাথায় আসে পরিবেশবান্ধব জৈব কৃষির কথা।
এরপর যোগ দিলেন নাসির। জানালেন, বেশ কিছুদিন আগে রাজশাহীতে চিকিৎসার জন্য গিয়ে পরিচয় হয় ঝিনাইদহের কালীগঞ্জ উপজেলার এক লোকের সঙ্গে। ওই লোকের কাছে জানতে পারেন যে কালীগঞ্জের মহেশ্বচন্দ্রা গ্রামের হেলাল উদ্দীন পরিবেশবান্ধব কেঁচো কম্পোস্ট সার তৈরি করেন। ফোন নম্বর সংগ্রহ করে হেলালের সঙ্গে যোগাযোগ করলে তিনি নিজেই কেঁচো নিয়ে এসে নাসিরকে দেন। শেখান সার তৈরির কৌশল। পরে হেলালের বাড়ি গিয়ে এ প্রক্রিয়া দেখে আসেন। নাসির জানান, হেলাল বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা কাউন্সিলের (বিএআরসি) অবসরপ্রাপ্ত পরিচালক (প্রযুক্তি হস্তান্তর) কৃষিবিজ্ঞানী গুল হোসেনের কাছ থেকে কেঁচো সংগ্রহ ও সার তৈরির প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত।
হেলালের কাছ থেকে কেঁচো নিয়ে শুরুর পর গত দুই বছরে নাসির নিজের ইউনিয়ন আকবরপুরসহ আশপাশের প্রায় দুই হাজার কৃষকের কাছে কেঁচো সরবরাহ করেছেন। অনেক কৃষককে শিখিয়েছেন সার তৈরির কৌশল। নাসির জানান, এখন কেঁচো সার ও জৈব কীটনাশক ব্যবহারকারী কৃষকদের নিয়ে একটি সংগঠন গড়ে তোলার চেষ্টা করছেন। সমবায় ভিত্তিতে জৈব পদ্ধতিতে উৎপাদিত ফসলের একটি বাজার সৃষ্টির পরিকল্পনা নিয়েও তাঁরা এগোচ্ছেন।
‘পরিবেশবান্ধব জৈব কৃষি সম্প্রসারণকে আমরা একটি আন্দোলন হিসেবে নিয়েছি। এ আন্দোলন একদিন এ এলাকায় সফলতার মুখ তো দেখবেই, এমনকি আশপাশেও ছড়িয়ে পড়বে বলে আমরা বিশ্বাস করি।’ বললেন, দৃঢ় প্রত্যয়ী নাসির।
ফতেপুর গ্রামে একদিন: সম্প্রতি নাসিরের বাড়িতে গিয়ে দেখা গেল কেঁচো কম্পোস্ট তৈরির আয়োজন। ১০০টি মাটির চাড়িতে সার তৈরি করেন তিনি। নাসির জানালেন, কাঁচা গোবর সংগ্রহ করে দুই দিন মাটির ওপর এবং পরে কয়েক দিন পলিথিনের ওপর রাখি। এরপর প্রতি ৪০ কেজি গোবরের সঙ্গে কলাগাছের এক কেজি পরিমাণ বাকল কুচি কুচি করে কেটে মিশিয়ে পলিথিন দিয়ে দুই সপ্তাহ পর্যন্ত ঢেকে রাখা হয়। এরপর তা মাটির চাড়িতে তোলা হয়। ওই চাড়িতে কমপক্ষে ২৫০টি বিশেষ প্রজাতির কেঁচো ছেড়ে দেওয়া হয়। এই কেঁচো থেকেই প্রজননের মাধ্যমে অসংখ্য কেঁচোর জন্ম হয়। সাধারণত ৪০ থেকে ৪৫ দিনের মধ্যেই সার তৈরি হয়ে যায়। তবে কেঁচোর পরিমাণ বেশি হলে সার তৈরিতে আরও কম সময় লাগে।
নাসির জানালেন, পর্যায়ক্রমে প্রতি চাড়ি থেকে ৪০ থেকে ৪৫ দিন পর ২৫ কেজি করে সার পান। গড়ে প্রতি মাসে ২০ থেকে ২৫ মণ সার বিক্রি করেন ২০ টাকা কেজি দরে। কেঁচো বিক্রি করেন প্রতিটি দুই টাকা করে।
জৈব কীটনাশক তৈরির প্রক্রিয়া প্রসঙ্গে নাসির বলেন, ২৫০ গ্রাম রসুনের নির্যাস ও ২৫০ গ্রাম গরুর মূত্রের সঙ্গে ৪৮ লিটার পানি মিশিয়ে এক বিঘা জমির ফসলে ছিটাতে হয়। জানালেন, বাড়িতে রসুন বাটা ও গরুর মূত্রের ওপর মশা-মাছি বসে না—বিষয়টি খেয়াল করে এগুলো দিয়ে কীটনাশক তৈরির আগ্রহ জন্মে তাঁর। বেগুন খেতে ব্যবহার করে ভালো ফল পান। পরে তা ব্যবহার করতে থাকেন। কৃষকদেরও এ বিষয়ে পরামর্শ দেন।
সার ও কীটনাশকের গুণাগুণ: নাসিরের তৈরি কীটনাশক সম্পর্কে পত্নীতলা উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা আক্তারুজ্জামান বলেন, রসুনের নির্যাস ও গরুর মূত্রের মধ্যে কীট-পতঙ্গবিরোধী উপাদান আছে। এটা কীটনাশক হিসেবে ব্যবহার করা যেতে পারে। কেঁচো কম্পোস্ট সার সম্পর্কে আক্তারুজ্জামানের মূল্যায়ন, এ সার উৎকৃষ্ট মানের। এতে বালাইনাশক উপাদান আছে। এ সার প্রয়োগে মাটির স্বাস্থ্য ভালো হয়।
বিএআরসির সাবেক পরিচালক কৃষিবিজ্ঞানী গুল হোসেন কেঁচো কম্পোস্ট সারের গুণাগুণ সম্পর্কে বলেন, মাটির খাদ্যের জন্য গুরুত্বপূর্ণ উপাদান হলো নাইট্রোজেন, ফসফরাস ও পটাশিয়াম। রাসায়নিক সারের তুলনায় এই সারে নাইট্রোজেন পাঁচ গুণ, ফসফরাস সাত গুণ ও পটাশিয়াম ১১ গুণ বেশি রয়েছে। উদ্ভিদ এই সার খুব সহজেই গ্রহণ করতে পারে।
উপকৃতদের প্রতিক্রিয়া: পত্নীতলার বজরুক মোহাম্মদপুর গ্রামের কৃষক পলাশ চন্দ্র বর্মণ বললেন, ‘প্রতিবছর গড়ে ৩০ বিঘা জমিতে বোরো আবাদ করতে গিয়ে ৮০ থেকে ৯০ হাজার টাকা খরচ হতো কেবল রাসায়নিক সার ও কীটনাশকে। এ বছর কেঁচো কম্পোস্ট সার এবং রসুনের নির্যাস ও গরুর মূত্র দিয়ে তৈরি জৈব কীটনাশক ব্যবহার করেছি। খরচ হয়েছে মাত্র ২৪ হাজার টাকা। ফলনও হয়েছে ভালো।’
নাসিরের গ্রামের কৃষক জয়নাল আবেদিন তাঁর ২০ শতক জমিতে পটোলের চাষ করতে রাসায়নিক সার ও কীটনাশক মিলিয়ে খরচ করেছিলেন সাড়ে চার হাজার থেকে পাঁচ হাজার টাকা। কিন্তু এবার কেঁচো কম্পোস্ট ব্যবহার করেছেন ৬০ কেজি। আর ইউরিয়া সার ব্যবহার করেছেন মাত্র পাঁচ কেজি। জয়নাল বললেন, ‘গতবারের তুলনায় খরচ হয়েছে চার ভাগের এক ভাগ। উৎপাদন বেড়েছে প্রায় দেড় গুণ।’
কাশিপুর এলাকার জোসনা অধিকারী জানান, নাসিরের মাধ্যমে কাশিপুরের দত্তপাড়া, কোলপাড়ায় কেঁচো কম্পোস্ট সার তৈরি হচ্ছে। তিনি নিজেসহ ওই এলাকার কয়েকজন এই সার বিক্রি করে বাড়তি আয়ও করছেন।
স্বীকৃতি: নাসির তাঁর জৈব কৃষি আন্দোলনের স্বীকৃতি পেতেও শুরু করেছেন। জৈব কৃষি সম্প্রসারণে অবদান রাখার জন্য আকবরপুর ইউনিয়ন পরিষদের পক্ষ থেকে গত ৯ মে তাঁকে সম্মাননা দেওয়া হয়। ওই অনুষ্ঠানে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) ও উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা উপস্থিত ছিলেন। তাঁর হাতে সম্মাননা স্মারক তুলে দেন ইউএনও আখতার মামুন।
আকবরপুর ইউপি চেয়ারম্যান আককাস আলী বলেন, নাসির উদ্দীন তাঁর সার তৈরির প্রক্রিয়া কৃষকদের মধ্যে ছড়িয়ে দিয়েছেন। তাঁর এই আন্দোলনে সব ধরনের সহযোগিতা করা হবে।
সমাজবিজ্ঞানে সম্মানসহ স্নাতক ও ইংরেজিতে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি নিয়ে কৃষিকাজকে পেশা হিসেবে নিয়েছেন নওগাঁর পত্নীতলা উপজেলার ফতেপুর গ্রামের নাসির উদ্দীন (৪৭)। পরিবেশবিরোধী ব্যয়বহুল রাসায়নিক সার ও কীটনাশকের বদলে সাশ্রয়ী পরিবেশবান্ধব কেঁচো কম্পোস্ট সার তৈরি করছেন তিনি। তৈরি করছেন জৈব কীটনাশকও। সার ও কীটনাশক তৈরির কৌশল শিখিয়ে তা ব্যবহারে উদ্বুদ্ধ করছেন কৃষকদের। এভাবে চালিয়ে যাচ্ছেন জৈব কৃষি আন্দোলন।
কৃষিকে পেশা হিসেবে নেওয়া প্রসঙ্গে নাসির বলেন, ‘ঢাকায় তৈরি পোশাক কারখানায় চাকরি নিয়েছিলাম। শহরের পরিবেশ, খাওয়া-দাওয়া কিছুই ভালো লাগত না। ১০ থেকে ১২ বছর আগে জন্ডিসে আক্রান্ত হয়ে বাড়ি ফিরে আসি। এই গ্রাম আর কৃষির প্রতি ভালোবাসার টানে কৃষিকেই পেশা হিসেবে নিলাম।’
নাসিরের জৈব কৃষি আন্দোলন শুরুর পেছনে একটা কষ্টের গল্প আছে। সেই গল্পটা শোনালেন তাঁর স্ত্রী আয়েশা খাতুন, ‘প্রায় চার বছর আগে বাড়ির একটি স্বাস্থ্যবান বকনা গরু খেত থেকে চরে এসে অসুস্থ হয়ে পড়ে। গ্রামের মানুষের পরামর্শে গরু জবাই করা হয়। কিন্তু মাংস কাটতে গিয়ে দেখা গেল, মাংস স্বাভাবিক নয়। পরে মাটিতে পুঁতে ফেলা হয়। সবার ধারণা, কীটনাশক স্প্রে করা কোনো খেতের ফসল খেয়ে গরুটির এ দশা। গরুটির মৃত্যুতে আমরা মুষড়ে পড়ি।’ আয়েশা জানালেন, ঠিক তখন থেকে নাসির ভাবতে শুরু করলেন জমিতে রাসায়নিক সার ও কীটনাশক ব্যবহার কীভাবে বন্ধ করা যায়। আর সেই ভাবনা থেকেই তাঁর মাথায় আসে পরিবেশবান্ধব জৈব কৃষির কথা।
এরপর যোগ দিলেন নাসির। জানালেন, বেশ কিছুদিন আগে রাজশাহীতে চিকিৎসার জন্য গিয়ে পরিচয় হয় ঝিনাইদহের কালীগঞ্জ উপজেলার এক লোকের সঙ্গে। ওই লোকের কাছে জানতে পারেন যে কালীগঞ্জের মহেশ্বচন্দ্রা গ্রামের হেলাল উদ্দীন পরিবেশবান্ধব কেঁচো কম্পোস্ট সার তৈরি করেন। ফোন নম্বর সংগ্রহ করে হেলালের সঙ্গে যোগাযোগ করলে তিনি নিজেই কেঁচো নিয়ে এসে নাসিরকে দেন। শেখান সার তৈরির কৌশল। পরে হেলালের বাড়ি গিয়ে এ প্রক্রিয়া দেখে আসেন। নাসির জানান, হেলাল বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা কাউন্সিলের (বিএআরসি) অবসরপ্রাপ্ত পরিচালক (প্রযুক্তি হস্তান্তর) কৃষিবিজ্ঞানী গুল হোসেনের কাছ থেকে কেঁচো সংগ্রহ ও সার তৈরির প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত।
হেলালের কাছ থেকে কেঁচো নিয়ে শুরুর পর গত দুই বছরে নাসির নিজের ইউনিয়ন আকবরপুরসহ আশপাশের প্রায় দুই হাজার কৃষকের কাছে কেঁচো সরবরাহ করেছেন। অনেক কৃষককে শিখিয়েছেন সার তৈরির কৌশল। নাসির জানান, এখন কেঁচো সার ও জৈব কীটনাশক ব্যবহারকারী কৃষকদের নিয়ে একটি সংগঠন গড়ে তোলার চেষ্টা করছেন। সমবায় ভিত্তিতে জৈব পদ্ধতিতে উৎপাদিত ফসলের একটি বাজার সৃষ্টির পরিকল্পনা নিয়েও তাঁরা এগোচ্ছেন।
‘পরিবেশবান্ধব জৈব কৃষি সম্প্রসারণকে আমরা একটি আন্দোলন হিসেবে নিয়েছি। এ আন্দোলন একদিন এ এলাকায় সফলতার মুখ তো দেখবেই, এমনকি আশপাশেও ছড়িয়ে পড়বে বলে আমরা বিশ্বাস করি।’ বললেন, দৃঢ় প্রত্যয়ী নাসির।
ফতেপুর গ্রামে একদিন: সম্প্রতি নাসিরের বাড়িতে গিয়ে দেখা গেল কেঁচো কম্পোস্ট তৈরির আয়োজন। ১০০টি মাটির চাড়িতে সার তৈরি করেন তিনি। নাসির জানালেন, কাঁচা গোবর সংগ্রহ করে দুই দিন মাটির ওপর এবং পরে কয়েক দিন পলিথিনের ওপর রাখি। এরপর প্রতি ৪০ কেজি গোবরের সঙ্গে কলাগাছের এক কেজি পরিমাণ বাকল কুচি কুচি করে কেটে মিশিয়ে পলিথিন দিয়ে দুই সপ্তাহ পর্যন্ত ঢেকে রাখা হয়। এরপর তা মাটির চাড়িতে তোলা হয়। ওই চাড়িতে কমপক্ষে ২৫০টি বিশেষ প্রজাতির কেঁচো ছেড়ে দেওয়া হয়। এই কেঁচো থেকেই প্রজননের মাধ্যমে অসংখ্য কেঁচোর জন্ম হয়। সাধারণত ৪০ থেকে ৪৫ দিনের মধ্যেই সার তৈরি হয়ে যায়। তবে কেঁচোর পরিমাণ বেশি হলে সার তৈরিতে আরও কম সময় লাগে।
নাসির জানালেন, পর্যায়ক্রমে প্রতি চাড়ি থেকে ৪০ থেকে ৪৫ দিন পর ২৫ কেজি করে সার পান। গড়ে প্রতি মাসে ২০ থেকে ২৫ মণ সার বিক্রি করেন ২০ টাকা কেজি দরে। কেঁচো বিক্রি করেন প্রতিটি দুই টাকা করে।
জৈব কীটনাশক তৈরির প্রক্রিয়া প্রসঙ্গে নাসির বলেন, ২৫০ গ্রাম রসুনের নির্যাস ও ২৫০ গ্রাম গরুর মূত্রের সঙ্গে ৪৮ লিটার পানি মিশিয়ে এক বিঘা জমির ফসলে ছিটাতে হয়। জানালেন, বাড়িতে রসুন বাটা ও গরুর মূত্রের ওপর মশা-মাছি বসে না—বিষয়টি খেয়াল করে এগুলো দিয়ে কীটনাশক তৈরির আগ্রহ জন্মে তাঁর। বেগুন খেতে ব্যবহার করে ভালো ফল পান। পরে তা ব্যবহার করতে থাকেন। কৃষকদেরও এ বিষয়ে পরামর্শ দেন।
সার ও কীটনাশকের গুণাগুণ: নাসিরের তৈরি কীটনাশক সম্পর্কে পত্নীতলা উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা আক্তারুজ্জামান বলেন, রসুনের নির্যাস ও গরুর মূত্রের মধ্যে কীট-পতঙ্গবিরোধী উপাদান আছে। এটা কীটনাশক হিসেবে ব্যবহার করা যেতে পারে। কেঁচো কম্পোস্ট সার সম্পর্কে আক্তারুজ্জামানের মূল্যায়ন, এ সার উৎকৃষ্ট মানের। এতে বালাইনাশক উপাদান আছে। এ সার প্রয়োগে মাটির স্বাস্থ্য ভালো হয়।
বিএআরসির সাবেক পরিচালক কৃষিবিজ্ঞানী গুল হোসেন কেঁচো কম্পোস্ট সারের গুণাগুণ সম্পর্কে বলেন, মাটির খাদ্যের জন্য গুরুত্বপূর্ণ উপাদান হলো নাইট্রোজেন, ফসফরাস ও পটাশিয়াম। রাসায়নিক সারের তুলনায় এই সারে নাইট্রোজেন পাঁচ গুণ, ফসফরাস সাত গুণ ও পটাশিয়াম ১১ গুণ বেশি রয়েছে। উদ্ভিদ এই সার খুব সহজেই গ্রহণ করতে পারে।
উপকৃতদের প্রতিক্রিয়া: পত্নীতলার বজরুক মোহাম্মদপুর গ্রামের কৃষক পলাশ চন্দ্র বর্মণ বললেন, ‘প্রতিবছর গড়ে ৩০ বিঘা জমিতে বোরো আবাদ করতে গিয়ে ৮০ থেকে ৯০ হাজার টাকা খরচ হতো কেবল রাসায়নিক সার ও কীটনাশকে। এ বছর কেঁচো কম্পোস্ট সার এবং রসুনের নির্যাস ও গরুর মূত্র দিয়ে তৈরি জৈব কীটনাশক ব্যবহার করেছি। খরচ হয়েছে মাত্র ২৪ হাজার টাকা। ফলনও হয়েছে ভালো।’
নাসিরের গ্রামের কৃষক জয়নাল আবেদিন তাঁর ২০ শতক জমিতে পটোলের চাষ করতে রাসায়নিক সার ও কীটনাশক মিলিয়ে খরচ করেছিলেন সাড়ে চার হাজার থেকে পাঁচ হাজার টাকা। কিন্তু এবার কেঁচো কম্পোস্ট ব্যবহার করেছেন ৬০ কেজি। আর ইউরিয়া সার ব্যবহার করেছেন মাত্র পাঁচ কেজি। জয়নাল বললেন, ‘গতবারের তুলনায় খরচ হয়েছে চার ভাগের এক ভাগ। উৎপাদন বেড়েছে প্রায় দেড় গুণ।’
কাশিপুর এলাকার জোসনা অধিকারী জানান, নাসিরের মাধ্যমে কাশিপুরের দত্তপাড়া, কোলপাড়ায় কেঁচো কম্পোস্ট সার তৈরি হচ্ছে। তিনি নিজেসহ ওই এলাকার কয়েকজন এই সার বিক্রি করে বাড়তি আয়ও করছেন।
স্বীকৃতি: নাসির তাঁর জৈব কৃষি আন্দোলনের স্বীকৃতি পেতেও শুরু করেছেন। জৈব কৃষি সম্প্রসারণে অবদান রাখার জন্য আকবরপুর ইউনিয়ন পরিষদের পক্ষ থেকে গত ৯ মে তাঁকে সম্মাননা দেওয়া হয়। ওই অনুষ্ঠানে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) ও উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা উপস্থিত ছিলেন। তাঁর হাতে সম্মাননা স্মারক তুলে দেন ইউএনও আখতার মামুন।
আকবরপুর ইউপি চেয়ারম্যান আককাস আলী বলেন, নাসির উদ্দীন তাঁর সার তৈরির প্রক্রিয়া কৃষকদের মধ্যে ছড়িয়ে দিয়েছেন। তাঁর এই আন্দোলনে সব ধরনের সহযোগিতা করা হবে।
No comments