কয়েকজন অপঘাতক by নাসিমা আনিস
ভোর ছয়টা তখনো বাজেনি, জীবন্ত রেললাইনের লোহার পাতগুলো টপকে টপকে মৃত লাইনের ওপর বসা বাজারটার দিকে তাক করে হাঁটতে থাকে সে। সেখানে এলোমেলো ছড়ানো-ছিটানো নানা পদের কবুতরের ঝুড়ি ও খাঁচা। ঝুড়ির মালিকেরাও নানা বয়সের, নানা শ্রেণির। বাসিমুখে ক্রেতা-বিক্রেতার সরব দরাদরিতে সকালের মসৃণ হাওয়া কেটে কেটে যায়। কিশোর এক বিক্রেতা আটটা গিরিবাজ নিয়ে বোকার মতো দাঁড়িয়ে আছে ভোর থেকে। তার একটা হাত না থাকায় শার্টের হাতাটা সকালের বাতাসে উড়তে থাকে কিংবা কাঁপে থরথর। সে জানে না, কী দাম চাইতে হয় গিরিবাজের—খদ্দের দাম জিজ্ঞাসা করলে তাকিয়ে থাকে ফ্যালফ্যাল করে। খদ্দেরের সময় নেই তার ভাবালুতায় সময় দেওয়ার। ফড়িয়ারা দুমদাম করে দাম করে করে বাচ্চা কবুতরগুলো ঝুড়িতে তুলতে থাকলে সাধারণ ক্রেতারা হিমশিম খায়, দরাদরিতে কুলিয়ে উঠতে পারে না তারা। আর সাধারণ বিক্রেতারাও জানে, খুচরো ক্রেতাদের ওপর ভরসা করলে গেরস্ত বিক্রেতার মাঝদুপুর পর্যন্ত কবুতর নিয়ে এখানেই বসে থাকতে হবে। ভরসা ঢাকার পার্টি—ফড়িয়া। পার্টিও বেশ, ভাব এমন, ওই তো গাড়ি দাঁড়িয়ে কোচ-স্টেশনে, কিনব আর কোচের ছাদে খাঁচা চাপাব, বেচলে বেচ, হাতে সময় নাই। তো, দুটো পয়সা কম হোক তাড়াতাড়ি বেচে বাড়ি গিয়ে অন্য কাজে লেগে পড়তে পারবে বিক্রেতারা, এটাই তো ভালো! বিশ জোড়া সক্ষম যুবক-যুবতী থাকলে মাসে বিশ জোড়া বাচ্চা বেচা যায়, উড়ুক্কু হওয়ার আগেই বেচতে হয় নইলে পাখনা বাড়ে, তুলতুলে মাংস কমে। মঙ্গলবার হলেই তাই এখানে আসা—কবুতর মঙ্গলের হাট। কবে থেকে এই হাট তা হাটের লোক জানে না, জানার কী-বা দরকার। কবুতরই তো, গরুও নয়, খাসিও নয়। অলোকার নামটা পছন্দ, কবুতরের সঙ্গে মঙ্গল-অমঙ্গল নাকি জড়িয়ে থাকে সব সময়, ছোটবেলা থেকে শোনা।
মঙ্গলবার হলেই অলোকার এই হাটে আসা লাগে। সোমবার ঘড়িতে অ্যালার্ম দেয় ভোর সাড়ে পাঁচটায়। অ্যালার্ম বাজার অনেক আগেই সে উঠে শাড়ি পাল্টায়। স্বামীর পায়ের নিচে দু-মিনিট হাত বোলাতে বোলাতে বলে, ‘আমি বেরোলাম, তুমি দু-ঘণ্টা ঘুমাও।’ স্বামী বলে, ‘কাউকে সঙ্গে নাও।’—‘নাহ, সব ঘুমাচ্ছে, ঘুমাক।’ তারপর কাজের মেয়েকে ডাকে দরজা বন্ধ করতে। রিকশায় উঠলে পাঁচ টাকা, হাঁটলে দশ মিনিট। এই অপূর্ব বাতাসে হাঁটাই পছন্দ, উপরন্তু পাঁচ টাকা বাঁচে। পাঁচ টাকা মানে দুই কেজি ঢ্যাঁড়স কিংবা দেড় কেজি পটোল কিংবা আড়াই কেজি দৌলতপুরের বিখ্যাত কচুমুখী। সস্তাই সব—কৃষক-কৃষির ভাবনা থাকুক না থাকুক, দশ টাকায় চাল খাওয়াবে বলে সরকার যে কথা দিয়েছিল, সে কথা সে রেখেছে। প্রতি মঙ্গলবারই অলোকা চার জোড়া কি তিন জোড়া বাচ্চা কেনে, প্রতি জোড়া আটাশ কিংবা ত্রিশ। খুব পুষ্ট বাচ্চা হলে বত্রিশও হয়। আনাড়ি বিক্রেতার দেখা পেলে পঁচিশেও মেলে; আর প্রতিবারই ফিরে যাওয়ার সময় গিরিবাজের মালিক কিশোরকে খোঁজে, কাছে দাঁড়ায়। দেখে, খাঁচা হাতে মালিক নিজের কবুতরের মতোই কি এক আবেগে কম্পমান। তারপর বাচ্চা-বোঝাই ঝোলা হাতে রিকশায় ওঠে অলোকা, সামনে অনেক কাজ—কবুতর জবাই করানো, পাখনা ছাড়ানো, সুপের জন্য একটা রেখে বাকিগুলো ফ্রিজে রাখা, পুরো সপ্তাহের সুপের জোগান। তিন মাস ধরে এই কবুতর কেনা চলছে, নিরবচ্ছিন্ন। এই ভোরে চেনা লোক নেই, কেউ না। এটা স্বস্তিরই। বাজারে গেলে আত্মীয় কিংবা পরিচিতদের দেখা মেলে, তাদের উৎসুক দৃষ্টি, ঠোঁটে আহা! এই ভোরে এসব নেই।
কিন্তু তিন মাস পর বর্ষার শুরুতে দুই মঙ্গলবার এই লোকটা রেললাইনের ওপর পাশে পাশে হেঁটে চলল। পরিচিত মানুষ, প্রাতর্ভ্রমণে এই প্রভাতে হাঁটতে হাঁটতে রেললাইন অবধি আসতে পারে যদিও। প্রথম দিন, ‘কবুতর কিনবেন?...প্রতি মঙ্গলবার আসেন?’ ইত্যাদি। দ্বিতীয় মঙ্গলবার বলে, ‘আপনার বাবার বাড়ি ঢাকা না! ঢাকায় যান না!’ ইত্যাদি। অলোকার বাসার সামনের রাস্তার ওপারে থাকে লোকটা, টিনের ঘরে। বাজারে তার গেল গেল অবস্থায় ধুলায় ধূসর ছোট্ট একটা ঘড়ির দোকান, চিকন গলির ভেতর। গত বছর স্বামীসহ দু-এক দিন বেল্ট কি ব্যাটারি পাল্টাতে এখানে এসেছিল অলোকা। সে যে প্রতিবেশী, তা জেনেছিল পরে। অলোকা যেদিন অ্যাম্বুলেন্সে আহত স্বামীকে ঢাকার হাসপাতাল থেকে বাসায় ফিরিয়ে আনে, তার কয়েক দিন পরেই লোকটা আসে—সেটাই প্রথম। ভারি কষ্ট পেয়েছে সে প্রতিবেশী সজ্জন এই মানুষটার জন্য। আহতের মাথার কাছে বসে কখনো মাথা টেপে, কখনো পায়ের আঙুলে থেরাপি দেয়। থেরাপিস্ট ছেলেটার কাছ থেকে একদিন জেনে নিয়েছিল, কীভাবে থেরাপি দিতে হয়। আহতকে সবাই যেমন দেখতে আসে, সে-ও আসে; একটু বেশি আসে। কেউ ভাবে, অলোকার স্বামী হয়তো বাঁচবেই না, মাথায় চোট বলে কথা। কেউ ভাবে, আহা লোকটা কি কখনো আগের অবস্থায় ফিরে যেতে পারবে! কিংবা অনেকেই ভাবে, লোকটির বেঁচে থাকাটা খুব জরুরি, ছোট ছোট ছেলেমেয়ে। কিন্তু কেউ থেরাপিস্ট ছেলেটার কাছ থেকে থেরাপি দেওয়া দেখে শিখে বিকেল কিংবা রাতে এসে তার পুনরাবৃত্তি করতে পারে না। লোকটা পারে এবং করে। ঘড়িঘর থেকে ফেরার পথে সে আসে—রাত নটা-দশটার দিকেও আসে। মানে রাত নয়টার দিকে থেরাপিস্ট চলে যাওয়ার পর। থেরাপিস্ট ছেলেটা সকালে এক ঘণ্টা আর রাতে এক ঘণ্টা থেরাপি দিয়ে ঘেমে-নেয়ে বাড়ি ফিরে যায়। সে অন্য রকম ছেলে, অতিরিক্ত ভালো। তাই প্রতি মাসেই তার মাসোহারা দিতে বেগ পেতে হয়—কিছুতেই নেবে না। অলোকার পরিবারের সবাইকে সে ভাইবোনের মতো দেখে, বাজার পর্যন্ত করে দিতেও অলসতা নেই। অলোকাও তাকে ছোট ভাইয়ের মর্যাদায় বসিয়েছে।
সে যাক, অলোকাদের পরিবারটা বড়—এগারো সদস্যের। এ ছাড়া বাধা একটা কাজের বুয়া। যে লোকটা মাঝেমধ্যে হিতাকাঙ্ক্ষী বেশে অলোকার স্বামীর ঘরে তার বিছানার পাশে বসে থাকে, ধরা যাক তার নাম বাদশা। তার শরীর আতরের গন্ধে ম-ম। থেরাপিস্ট চলে গেলে কখনো বাদশার উপস্থিতিতেই স্বামীর রাতের খাবার চলে। তারপর পরিবারের অন্যরা যখন খায়দায়, তখনো পরম আত্মীয়ের মতো বসে থাকে লোকটি, যেন আহতের পাশে আতরে ভুরভুর করা প্রতিবেশী নয়, দেবদূতের মতন কেউ বসে আছে। তারপর রাত এগারোটা-বারোটার দিকে চলে যাওয়ার সময় ইতস্তত করতে করতে কাউকে ডাকতে চেষ্টা করে সে। ভাবটা এমন, কে যে তাকে বিদায় করবে সে বুঝতে পারছে না। বাড়ির ছেলেমেয়েরা হইচই করতে করতে তার জন্য মেইন গেট, কলাপসিবল গেট খুলে দিলে চলে যায় সে। এই পর্যন্ত বাদশাকে নিয়ে কারও কোনো আলাদা ভাবনা নেই। সে একজন সদালাপী সেবাপরায়ণ, পরদুঃখকাতর সজ্জন দরিদ্র ঘড়িঘরের মালিক, যার স্ত্রী-সন্তান এবং যে নিজেও দারিদ্র্যক্লিষ্ট, রোগাপটকা ও যথেষ্ট জীর্ণকায়। এপ্রিল-মের গরমের পর বর্ষাটাও যায় যায়। অলোকার স্বামী এখন চিকিৎসকদের সব ভবিষ্যদ্বাণী উপেক্ষা করে অলৌকিকভাবে একা একা উঠে বসতে পারে, হাঁটতে তার তখনো ছয় মাস বাকি। পরিবারের বারোয়ারি খাবার তাকে দেওয়া হয় না—ফল, দুধ, মুরগির ঝোল—সব আলাদা। থেরাপিস্ট দু-বেলা ফিজিওথেরাপি দেয় ঘড়ি ধরে, ফাঁকে ফাঁকে পরিবারের সদস্যরাও। পুরো পরিবার খেয়াল রাখে তার দিকে—ছোট-বড় সব সদস্য। বিকেলে চেয়ারে বসিয়ে দুজন ধরে ধরে বাগানে নামায় তাকে। বাগানে দোলনচাঁপা ঘ্রাণ ছড়ায়, দোপাটির রং চমকায়। সকালের শিউলিতে বিকেলের ভুঁই সাদা। শরতের নীল আকাশ দেখে রোগী পাগলপারা। আহ্, একবার যদি নিজের মতো বাঁচা যেত!
আশ্বিনের ভোরে শিশির পড়ে টুপটুপ। কার্তিকে-অগ্রহায়ণে অলোকার স্বামীর দুই বগলে দুজন হাত দিয়ে হাঁটিয়ে বেড়ায়। থেরাপিষ্ট তো আরেক কাঠি সরেস। কোনো দিন ছাদে নিয়ে হাঁটিয়ে এনে বলে, ‘স্যারের আর এক মাস...তারপর একা একা ব্যাংকে চলে যাবে, কোনো চিন্তা নাই।’ আর লোকটা, মানে বাদশা, বর্ষার পর আর আসেনি। অলোকার বাজারে যাওয়ার পথেও দাঁড়ায়নি। রেললাইনের পাতে তো নয়ই। পরের জ্যৈষ্ঠে অলোকার স্বামী ভদ্রলোক ধীর পায়ে কর্মজীবনে প্রবেশ করলে পুরো পরিবারে প্রাণ ফিরে আসে। তার কিছুদিন পরে ঘটে একটা ঘটনা—বাদশার মাফলার প্যাঁচানো মৃতদেহটা আবিষ্কার হয় রেললাইনের ধারে হিজড়াদের থানের পেছনে পানাভরা খানাখন্দে। অলোকার স্বামী বিস্ময় নিয়ে তাকে বলেন, ‘কী করে সম্ভব! ও তো খুব ভালো একটা লোক।’ তবে খবরটি শুনে বিস্মিত হয় না অলোকা; বরং কপাল কুঁচকে বিরক্তমুখে বলে, ‘মরেছে...কে মারল লোকটাকে, ওর বাচ্চাগুলো খুব ছোট, বউটাও তো অল্পবয়সী।’ পরদিন সারা মফস্বল শহরে মৃত্যুর সঙ্গে আরেকটি কাহিনিও জানা যায় নতুন করে—বাদশার পূর্বকীর্তি। এ কাহিনি একদমই জানা ছিল না অলোকাদের। কারণ, এখানে তাদের বাড়ি হলেও স্বামীর চাকরিসূত্রে অনেক দিনই তারা ছিল বাইরে। কিন্তু বাদশার কীর্তি শোনার পর নিজেকে আর ধরে রাখতে পারে না অলোকা। চার বছর আগে স্থানীয় অবস্থাপন্ন ঘরের এক বয়স্ক মহিলাকে নিয়ে বাদশা ভেগে গিয়েছিল। পনেরো দিন পর তারা ফিরে আসে। মাঝখানে মহিলা হারায় সম্মান, যাবতীয় গহনা আর টাকাকড়ি। মহিলার ছেলেমেয়েরা তখন কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ে। ব্যাপারটা নিয়ে মানুষ বেশি ঘাঁটাঘাঁটি করেনি। কারণ, মহিলার পরিবারের রাজনৈতিক প্রতিপত্তি। তার বড় চাচা সাবেক উপজেলা চেয়ারম্যান। গু ঘাঁটলে গন্ধ ছড়ায়, ছোট শহরে সবাই সবাইকে চেনে। তাই কেউই কথা বাড়ায়নি। কিন্তু এখনো মাঝেমধ্যে দু-একজনের আলোচনা শোনা যায়, ‘ছেলেরা মনে রেখেছে গো...সঙ্গে সঙ্গে তার কোনো সুরাহা করেনি, করলে মায়ের কলঙ্ক বাড়ে বই কমে না যে।’
ভরা বর্ষায় যখন স্কুল-কলেজ গ্রামবাসীর আশ্রয়স্থল, শহরে পানি ঢুকবে ঢুকবে করছে, তখন একদিন রেললাইনের পাতে দাঁড়িয়ে অলোকাকে খুঁজে পেয়ে দৌড়ে এসেছিল বাদশা। তাকে বলেছিল, ‘চলেন ঢাকা থেকে ঘুরে আসি। আপনি তো অনেক দিন বাপের বাড়ি যাননি, আহা মানুষটা এত অসুস্থ! আপনারও কী ধকল! ’ অলোকা প্রথমে বুঝতেই পারে না লোকটা কী বলে। গত রাত এগারোটায় এই লোকটাই না তার স্বামীর সঙ্গে স্থানীয় রাজনীতি প্রসঙ্গে আলাপ করছিল পায়ের আঙুল ঘুরিয়ে দিতে দিতে! বলছিল, ‘মাহিদুল জাল সার্টিফিকেট দিয়ে কলেজে চাকরি করলেও ভোটারদের কাছ থেকে কী করে ভোট আদায় করতে হয়, তা ভালোই জানে, সে হলো ভোট মেশিন। বস্তা ভরে শাড়ি আর টাকা নিয়ে গ্রামে চলে যায় ভোটের তিন দিন আগে বউসহ, ব্যস। ধরেন বউটা তো আবার খাসা, দেখতেও দারুণ। শহরের ভোট যে সে পাবে না, তা সে জানে। ধরেন, কুলিনেই তো কন্দল। শহরের শিক্ষিত কুলিনদের ভোট সে পাবে না। তো, শহরের জন্য খেটে লাভ কী বলেন স্যার? মাহিদুল ভোটের জন্য কি আপনার বাড়ি আসছিল? না, আসে নাই। কথা হলো, শহরের ভোট কয়টা নিয়েই শিক্ষিত নেতাকে খুশি থাকতে হবে। তা থাক। মাহিদুল তাকে কোনো ডিস্টার্বই করেনি। কারণ সে জানত, শুধু শহরের ভোটে তো পাস করা যাবে না। কিন্তু কপাল খারাপ মাহিদুলের, সে জিতল, তবে দল জিতল না। দল জিতলে টাটা-বিড়লাকে ঠিক ব্যবস্থা করে দিত নদীর এপারে কি ওপারে।’ আকাশের মেঘের ওপর চোখ রেখে অলোকাকে বাদশা আবার সেদিন বলেছিল, ‘বলছিলাম অনেক দিন ধরে ঢাকায় যান না, যদি যেতে চান আমি আপনাকে নিয়ে যেতে পারি, ঘড়ি আনতে যাব তো। ভাড়া আমার, জাস্ট দু-দিনের জন্য।’ এ কথায় হতভম্ব অলোকা। বলে ‘না, এখন কোথাও যাওয়ার দরকার নাই আমার।’ তারপর কবুতরের দোকানে গিয়ে দেখে বাদশা কবুতরের দাম করে দাঁড়িয়ে আছে। যন্ত্রচালিতের মতো সেই কবুতর বাজারের ব্যাগে পুরে টাকা দিতে দিতে বাদশার বলা কথাগুলোর অর্থ পুরোপুরি বুঝতে পারে সে। এরপর আর কোনো দিন বাদশা তার সামনে পড়েনি। কারণ, সেদিন ওর সামনেই থলেটা সে ছুড়ে ফেলে দিয়েছিল রেললাইনের নোংরা পাথরের ওপর। থলের ভেতরের বাচ্চাগুলোর খবর সে নেয়নি কিন্তু কিশোরের গিরিবাজগুলোর একটিও যে সে দিনও বেচা হয়নি, সেটি সে জানে।
এসব গল্প সদ্য কাজে যোগ দেওয়া স্বামীকে বলে অলোকা। গিরিবাজের মালিক কিশোরের গল্পটা কী কারণে যেন বলতেই থাকে সে, ‘ছেলেটার হাত নেই, তবু ও রোজ আসে, কিন্তু কবুতরগুলো বিক্রি করে না, কেন করে না কে জানে।’ স্বামী অন্যমনস্ক, গিরিবাজের গল্পে তার অল্পই আগ্রহ। কেন যেন তার আগ্রহ বাদশায়—আতরে ম-ম করা কমদামি চকচকে সিল্কের হলুদ পাঞ্জাবি পরা লোকটা—বাদশা—মনে ঘাই মারে প্রায়ই। দিনের পর দিন যার যাতায়াত ছিল, কোনো কোনো দিন যে রাত বারোটা-একটা পর্যন্তও পায়ের কাছে বসে থাকত। রাজনীতির গল্পের ফাঁকে ফাঁকে যে মেয়েদের গহনাপ্রীতি নিয়ে কথা বলতে চাইত বিনা কারণে, ‘বোনের বিয়ে, খালি গহনা গহনা করে...’। সব শুনে অলোকা বলেছিল, ‘গহনা সব মেয়েরই শখ, আমার বাবা আমার শখ মিটিয়ে গহনা দিয়েছেন।’ অলোকা ও বাদশা—কাউকেই যেন ঠিক বিশ্বাস করতে পারে না অলোকার স্বামী। তার মধ্যে সারাক্ষণ একটা অদ্ভুত দোলাচল, দুলতে থাকে সে। রাতে ঘুমাতে গিয়ে অলোকা দেখে ব্যাংক কর্মকর্তা স্বামীটি গম্ভীর, সিলিংয়ের দিকে মুখ। যেন তার ওপর দিয়ে বড় একটা প্রলয় গেছে। পাশ ফিরে শুয়ে পড়ে অলোকা। অভিমানে বুক ভারী হয়ে আসে প্রথমে, তারপর জাগে ক্রোধ। তন্দ্রা এলে সে দেখতে পায়, এক গাট্টি গহনা আর টাকা নিয়ে ট্রেনে চেপে কোথাও যাচ্ছে, পাশেই বাদশা, বসার জায়গা না পেয়ে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে ঘুমিয়ে পড়ছে, ওর গা দিয়ে পচা মাছের গন্ধ বেরোচ্ছে। এরপর অন্য একটা দৃশ্যে সে দেখল, সদ্য সেরে ওঠা ব্যাংক কর্মকর্তার হাতে বাদশার মাফলার, আর বাদশার রোগা বউটা কী করুণ হয়ে ডুকরে ডুকরে কাঁদছে।
মঙ্গলবার হলেই অলোকার এই হাটে আসা লাগে। সোমবার ঘড়িতে অ্যালার্ম দেয় ভোর সাড়ে পাঁচটায়। অ্যালার্ম বাজার অনেক আগেই সে উঠে শাড়ি পাল্টায়। স্বামীর পায়ের নিচে দু-মিনিট হাত বোলাতে বোলাতে বলে, ‘আমি বেরোলাম, তুমি দু-ঘণ্টা ঘুমাও।’ স্বামী বলে, ‘কাউকে সঙ্গে নাও।’—‘নাহ, সব ঘুমাচ্ছে, ঘুমাক।’ তারপর কাজের মেয়েকে ডাকে দরজা বন্ধ করতে। রিকশায় উঠলে পাঁচ টাকা, হাঁটলে দশ মিনিট। এই অপূর্ব বাতাসে হাঁটাই পছন্দ, উপরন্তু পাঁচ টাকা বাঁচে। পাঁচ টাকা মানে দুই কেজি ঢ্যাঁড়স কিংবা দেড় কেজি পটোল কিংবা আড়াই কেজি দৌলতপুরের বিখ্যাত কচুমুখী। সস্তাই সব—কৃষক-কৃষির ভাবনা থাকুক না থাকুক, দশ টাকায় চাল খাওয়াবে বলে সরকার যে কথা দিয়েছিল, সে কথা সে রেখেছে। প্রতি মঙ্গলবারই অলোকা চার জোড়া কি তিন জোড়া বাচ্চা কেনে, প্রতি জোড়া আটাশ কিংবা ত্রিশ। খুব পুষ্ট বাচ্চা হলে বত্রিশও হয়। আনাড়ি বিক্রেতার দেখা পেলে পঁচিশেও মেলে; আর প্রতিবারই ফিরে যাওয়ার সময় গিরিবাজের মালিক কিশোরকে খোঁজে, কাছে দাঁড়ায়। দেখে, খাঁচা হাতে মালিক নিজের কবুতরের মতোই কি এক আবেগে কম্পমান। তারপর বাচ্চা-বোঝাই ঝোলা হাতে রিকশায় ওঠে অলোকা, সামনে অনেক কাজ—কবুতর জবাই করানো, পাখনা ছাড়ানো, সুপের জন্য একটা রেখে বাকিগুলো ফ্রিজে রাখা, পুরো সপ্তাহের সুপের জোগান। তিন মাস ধরে এই কবুতর কেনা চলছে, নিরবচ্ছিন্ন। এই ভোরে চেনা লোক নেই, কেউ না। এটা স্বস্তিরই। বাজারে গেলে আত্মীয় কিংবা পরিচিতদের দেখা মেলে, তাদের উৎসুক দৃষ্টি, ঠোঁটে আহা! এই ভোরে এসব নেই।
কিন্তু তিন মাস পর বর্ষার শুরুতে দুই মঙ্গলবার এই লোকটা রেললাইনের ওপর পাশে পাশে হেঁটে চলল। পরিচিত মানুষ, প্রাতর্ভ্রমণে এই প্রভাতে হাঁটতে হাঁটতে রেললাইন অবধি আসতে পারে যদিও। প্রথম দিন, ‘কবুতর কিনবেন?...প্রতি মঙ্গলবার আসেন?’ ইত্যাদি। দ্বিতীয় মঙ্গলবার বলে, ‘আপনার বাবার বাড়ি ঢাকা না! ঢাকায় যান না!’ ইত্যাদি। অলোকার বাসার সামনের রাস্তার ওপারে থাকে লোকটা, টিনের ঘরে। বাজারে তার গেল গেল অবস্থায় ধুলায় ধূসর ছোট্ট একটা ঘড়ির দোকান, চিকন গলির ভেতর। গত বছর স্বামীসহ দু-এক দিন বেল্ট কি ব্যাটারি পাল্টাতে এখানে এসেছিল অলোকা। সে যে প্রতিবেশী, তা জেনেছিল পরে। অলোকা যেদিন অ্যাম্বুলেন্সে আহত স্বামীকে ঢাকার হাসপাতাল থেকে বাসায় ফিরিয়ে আনে, তার কয়েক দিন পরেই লোকটা আসে—সেটাই প্রথম। ভারি কষ্ট পেয়েছে সে প্রতিবেশী সজ্জন এই মানুষটার জন্য। আহতের মাথার কাছে বসে কখনো মাথা টেপে, কখনো পায়ের আঙুলে থেরাপি দেয়। থেরাপিস্ট ছেলেটার কাছ থেকে একদিন জেনে নিয়েছিল, কীভাবে থেরাপি দিতে হয়। আহতকে সবাই যেমন দেখতে আসে, সে-ও আসে; একটু বেশি আসে। কেউ ভাবে, অলোকার স্বামী হয়তো বাঁচবেই না, মাথায় চোট বলে কথা। কেউ ভাবে, আহা লোকটা কি কখনো আগের অবস্থায় ফিরে যেতে পারবে! কিংবা অনেকেই ভাবে, লোকটির বেঁচে থাকাটা খুব জরুরি, ছোট ছোট ছেলেমেয়ে। কিন্তু কেউ থেরাপিস্ট ছেলেটার কাছ থেকে থেরাপি দেওয়া দেখে শিখে বিকেল কিংবা রাতে এসে তার পুনরাবৃত্তি করতে পারে না। লোকটা পারে এবং করে। ঘড়িঘর থেকে ফেরার পথে সে আসে—রাত নটা-দশটার দিকেও আসে। মানে রাত নয়টার দিকে থেরাপিস্ট চলে যাওয়ার পর। থেরাপিস্ট ছেলেটা সকালে এক ঘণ্টা আর রাতে এক ঘণ্টা থেরাপি দিয়ে ঘেমে-নেয়ে বাড়ি ফিরে যায়। সে অন্য রকম ছেলে, অতিরিক্ত ভালো। তাই প্রতি মাসেই তার মাসোহারা দিতে বেগ পেতে হয়—কিছুতেই নেবে না। অলোকার পরিবারের সবাইকে সে ভাইবোনের মতো দেখে, বাজার পর্যন্ত করে দিতেও অলসতা নেই। অলোকাও তাকে ছোট ভাইয়ের মর্যাদায় বসিয়েছে।
সে যাক, অলোকাদের পরিবারটা বড়—এগারো সদস্যের। এ ছাড়া বাধা একটা কাজের বুয়া। যে লোকটা মাঝেমধ্যে হিতাকাঙ্ক্ষী বেশে অলোকার স্বামীর ঘরে তার বিছানার পাশে বসে থাকে, ধরা যাক তার নাম বাদশা। তার শরীর আতরের গন্ধে ম-ম। থেরাপিস্ট চলে গেলে কখনো বাদশার উপস্থিতিতেই স্বামীর রাতের খাবার চলে। তারপর পরিবারের অন্যরা যখন খায়দায়, তখনো পরম আত্মীয়ের মতো বসে থাকে লোকটি, যেন আহতের পাশে আতরে ভুরভুর করা প্রতিবেশী নয়, দেবদূতের মতন কেউ বসে আছে। তারপর রাত এগারোটা-বারোটার দিকে চলে যাওয়ার সময় ইতস্তত করতে করতে কাউকে ডাকতে চেষ্টা করে সে। ভাবটা এমন, কে যে তাকে বিদায় করবে সে বুঝতে পারছে না। বাড়ির ছেলেমেয়েরা হইচই করতে করতে তার জন্য মেইন গেট, কলাপসিবল গেট খুলে দিলে চলে যায় সে। এই পর্যন্ত বাদশাকে নিয়ে কারও কোনো আলাদা ভাবনা নেই। সে একজন সদালাপী সেবাপরায়ণ, পরদুঃখকাতর সজ্জন দরিদ্র ঘড়িঘরের মালিক, যার স্ত্রী-সন্তান এবং যে নিজেও দারিদ্র্যক্লিষ্ট, রোগাপটকা ও যথেষ্ট জীর্ণকায়। এপ্রিল-মের গরমের পর বর্ষাটাও যায় যায়। অলোকার স্বামী এখন চিকিৎসকদের সব ভবিষ্যদ্বাণী উপেক্ষা করে অলৌকিকভাবে একা একা উঠে বসতে পারে, হাঁটতে তার তখনো ছয় মাস বাকি। পরিবারের বারোয়ারি খাবার তাকে দেওয়া হয় না—ফল, দুধ, মুরগির ঝোল—সব আলাদা। থেরাপিস্ট দু-বেলা ফিজিওথেরাপি দেয় ঘড়ি ধরে, ফাঁকে ফাঁকে পরিবারের সদস্যরাও। পুরো পরিবার খেয়াল রাখে তার দিকে—ছোট-বড় সব সদস্য। বিকেলে চেয়ারে বসিয়ে দুজন ধরে ধরে বাগানে নামায় তাকে। বাগানে দোলনচাঁপা ঘ্রাণ ছড়ায়, দোপাটির রং চমকায়। সকালের শিউলিতে বিকেলের ভুঁই সাদা। শরতের নীল আকাশ দেখে রোগী পাগলপারা। আহ্, একবার যদি নিজের মতো বাঁচা যেত!
আশ্বিনের ভোরে শিশির পড়ে টুপটুপ। কার্তিকে-অগ্রহায়ণে অলোকার স্বামীর দুই বগলে দুজন হাত দিয়ে হাঁটিয়ে বেড়ায়। থেরাপিষ্ট তো আরেক কাঠি সরেস। কোনো দিন ছাদে নিয়ে হাঁটিয়ে এনে বলে, ‘স্যারের আর এক মাস...তারপর একা একা ব্যাংকে চলে যাবে, কোনো চিন্তা নাই।’ আর লোকটা, মানে বাদশা, বর্ষার পর আর আসেনি। অলোকার বাজারে যাওয়ার পথেও দাঁড়ায়নি। রেললাইনের পাতে তো নয়ই। পরের জ্যৈষ্ঠে অলোকার স্বামী ভদ্রলোক ধীর পায়ে কর্মজীবনে প্রবেশ করলে পুরো পরিবারে প্রাণ ফিরে আসে। তার কিছুদিন পরে ঘটে একটা ঘটনা—বাদশার মাফলার প্যাঁচানো মৃতদেহটা আবিষ্কার হয় রেললাইনের ধারে হিজড়াদের থানের পেছনে পানাভরা খানাখন্দে। অলোকার স্বামী বিস্ময় নিয়ে তাকে বলেন, ‘কী করে সম্ভব! ও তো খুব ভালো একটা লোক।’ তবে খবরটি শুনে বিস্মিত হয় না অলোকা; বরং কপাল কুঁচকে বিরক্তমুখে বলে, ‘মরেছে...কে মারল লোকটাকে, ওর বাচ্চাগুলো খুব ছোট, বউটাও তো অল্পবয়সী।’ পরদিন সারা মফস্বল শহরে মৃত্যুর সঙ্গে আরেকটি কাহিনিও জানা যায় নতুন করে—বাদশার পূর্বকীর্তি। এ কাহিনি একদমই জানা ছিল না অলোকাদের। কারণ, এখানে তাদের বাড়ি হলেও স্বামীর চাকরিসূত্রে অনেক দিনই তারা ছিল বাইরে। কিন্তু বাদশার কীর্তি শোনার পর নিজেকে আর ধরে রাখতে পারে না অলোকা। চার বছর আগে স্থানীয় অবস্থাপন্ন ঘরের এক বয়স্ক মহিলাকে নিয়ে বাদশা ভেগে গিয়েছিল। পনেরো দিন পর তারা ফিরে আসে। মাঝখানে মহিলা হারায় সম্মান, যাবতীয় গহনা আর টাকাকড়ি। মহিলার ছেলেমেয়েরা তখন কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ে। ব্যাপারটা নিয়ে মানুষ বেশি ঘাঁটাঘাঁটি করেনি। কারণ, মহিলার পরিবারের রাজনৈতিক প্রতিপত্তি। তার বড় চাচা সাবেক উপজেলা চেয়ারম্যান। গু ঘাঁটলে গন্ধ ছড়ায়, ছোট শহরে সবাই সবাইকে চেনে। তাই কেউই কথা বাড়ায়নি। কিন্তু এখনো মাঝেমধ্যে দু-একজনের আলোচনা শোনা যায়, ‘ছেলেরা মনে রেখেছে গো...সঙ্গে সঙ্গে তার কোনো সুরাহা করেনি, করলে মায়ের কলঙ্ক বাড়ে বই কমে না যে।’
ভরা বর্ষায় যখন স্কুল-কলেজ গ্রামবাসীর আশ্রয়স্থল, শহরে পানি ঢুকবে ঢুকবে করছে, তখন একদিন রেললাইনের পাতে দাঁড়িয়ে অলোকাকে খুঁজে পেয়ে দৌড়ে এসেছিল বাদশা। তাকে বলেছিল, ‘চলেন ঢাকা থেকে ঘুরে আসি। আপনি তো অনেক দিন বাপের বাড়ি যাননি, আহা মানুষটা এত অসুস্থ! আপনারও কী ধকল! ’ অলোকা প্রথমে বুঝতেই পারে না লোকটা কী বলে। গত রাত এগারোটায় এই লোকটাই না তার স্বামীর সঙ্গে স্থানীয় রাজনীতি প্রসঙ্গে আলাপ করছিল পায়ের আঙুল ঘুরিয়ে দিতে দিতে! বলছিল, ‘মাহিদুল জাল সার্টিফিকেট দিয়ে কলেজে চাকরি করলেও ভোটারদের কাছ থেকে কী করে ভোট আদায় করতে হয়, তা ভালোই জানে, সে হলো ভোট মেশিন। বস্তা ভরে শাড়ি আর টাকা নিয়ে গ্রামে চলে যায় ভোটের তিন দিন আগে বউসহ, ব্যস। ধরেন বউটা তো আবার খাসা, দেখতেও দারুণ। শহরের ভোট যে সে পাবে না, তা সে জানে। ধরেন, কুলিনেই তো কন্দল। শহরের শিক্ষিত কুলিনদের ভোট সে পাবে না। তো, শহরের জন্য খেটে লাভ কী বলেন স্যার? মাহিদুল ভোটের জন্য কি আপনার বাড়ি আসছিল? না, আসে নাই। কথা হলো, শহরের ভোট কয়টা নিয়েই শিক্ষিত নেতাকে খুশি থাকতে হবে। তা থাক। মাহিদুল তাকে কোনো ডিস্টার্বই করেনি। কারণ সে জানত, শুধু শহরের ভোটে তো পাস করা যাবে না। কিন্তু কপাল খারাপ মাহিদুলের, সে জিতল, তবে দল জিতল না। দল জিতলে টাটা-বিড়লাকে ঠিক ব্যবস্থা করে দিত নদীর এপারে কি ওপারে।’ আকাশের মেঘের ওপর চোখ রেখে অলোকাকে বাদশা আবার সেদিন বলেছিল, ‘বলছিলাম অনেক দিন ধরে ঢাকায় যান না, যদি যেতে চান আমি আপনাকে নিয়ে যেতে পারি, ঘড়ি আনতে যাব তো। ভাড়া আমার, জাস্ট দু-দিনের জন্য।’ এ কথায় হতভম্ব অলোকা। বলে ‘না, এখন কোথাও যাওয়ার দরকার নাই আমার।’ তারপর কবুতরের দোকানে গিয়ে দেখে বাদশা কবুতরের দাম করে দাঁড়িয়ে আছে। যন্ত্রচালিতের মতো সেই কবুতর বাজারের ব্যাগে পুরে টাকা দিতে দিতে বাদশার বলা কথাগুলোর অর্থ পুরোপুরি বুঝতে পারে সে। এরপর আর কোনো দিন বাদশা তার সামনে পড়েনি। কারণ, সেদিন ওর সামনেই থলেটা সে ছুড়ে ফেলে দিয়েছিল রেললাইনের নোংরা পাথরের ওপর। থলের ভেতরের বাচ্চাগুলোর খবর সে নেয়নি কিন্তু কিশোরের গিরিবাজগুলোর একটিও যে সে দিনও বেচা হয়নি, সেটি সে জানে।
এসব গল্প সদ্য কাজে যোগ দেওয়া স্বামীকে বলে অলোকা। গিরিবাজের মালিক কিশোরের গল্পটা কী কারণে যেন বলতেই থাকে সে, ‘ছেলেটার হাত নেই, তবু ও রোজ আসে, কিন্তু কবুতরগুলো বিক্রি করে না, কেন করে না কে জানে।’ স্বামী অন্যমনস্ক, গিরিবাজের গল্পে তার অল্পই আগ্রহ। কেন যেন তার আগ্রহ বাদশায়—আতরে ম-ম করা কমদামি চকচকে সিল্কের হলুদ পাঞ্জাবি পরা লোকটা—বাদশা—মনে ঘাই মারে প্রায়ই। দিনের পর দিন যার যাতায়াত ছিল, কোনো কোনো দিন যে রাত বারোটা-একটা পর্যন্তও পায়ের কাছে বসে থাকত। রাজনীতির গল্পের ফাঁকে ফাঁকে যে মেয়েদের গহনাপ্রীতি নিয়ে কথা বলতে চাইত বিনা কারণে, ‘বোনের বিয়ে, খালি গহনা গহনা করে...’। সব শুনে অলোকা বলেছিল, ‘গহনা সব মেয়েরই শখ, আমার বাবা আমার শখ মিটিয়ে গহনা দিয়েছেন।’ অলোকা ও বাদশা—কাউকেই যেন ঠিক বিশ্বাস করতে পারে না অলোকার স্বামী। তার মধ্যে সারাক্ষণ একটা অদ্ভুত দোলাচল, দুলতে থাকে সে। রাতে ঘুমাতে গিয়ে অলোকা দেখে ব্যাংক কর্মকর্তা স্বামীটি গম্ভীর, সিলিংয়ের দিকে মুখ। যেন তার ওপর দিয়ে বড় একটা প্রলয় গেছে। পাশ ফিরে শুয়ে পড়ে অলোকা। অভিমানে বুক ভারী হয়ে আসে প্রথমে, তারপর জাগে ক্রোধ। তন্দ্রা এলে সে দেখতে পায়, এক গাট্টি গহনা আর টাকা নিয়ে ট্রেনে চেপে কোথাও যাচ্ছে, পাশেই বাদশা, বসার জায়গা না পেয়ে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে ঘুমিয়ে পড়ছে, ওর গা দিয়ে পচা মাছের গন্ধ বেরোচ্ছে। এরপর অন্য একটা দৃশ্যে সে দেখল, সদ্য সেরে ওঠা ব্যাংক কর্মকর্তার হাতে বাদশার মাফলার, আর বাদশার রোগা বউটা কী করুণ হয়ে ডুকরে ডুকরে কাঁদছে।
No comments