মশক নিধনকর্মীদের দেখা মেলে কম by শুভ্র দেব
ডেঙ্গু
আতঙ্ক সর্বত্র। ডেঙ্গু ছড়িয়ে পড়ার পর থেকেই সিটি করপোরেশনের মশক নিধন
কার্যক্রম নিয়ে প্রশ্ন দেখা দিয়েছে। শুরুতে অকার্যকর ওষুধের বিষয়টি সামনে
আসে। পরে নতুন ওষুধ আনা-নেয়া নিয়ে শুরু হয় টানাহেচড়া। দুই সিটি করপোরেশন
জানিয়েছে, এখন নতুন ওষুধে মশা নিধন কার্যক্রম চালানো হচ্ছে। কিন্তু সরজমিন
বিভিন্ন এলাকা ঘুরে স্থানীয়দের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, মাঠ পর্যায়ে খুব
একটা দেখা মিলছে না মশক নিধনকর্মীদের। অনেক এলাকার বাসিন্দারা সিটি
করপোরেশন কর্তৃপক্ষের ওপর ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন। তারা বলেছেন, ঈদের অনেক আগে
ওষুধ দিয়ে গেলেও এখন আর কাউকে দেখা যাচ্ছে না। নিয়ম অনুযায়ী মশক
নিধনকর্মীরা প্রতিদিন সকাল ৮টা থেকে বেলা ১১টা পর্যন্ত লার্ভিসাইডিং ও
বিকাল ৪টা থেকে সন্ধ্যা ৬টা পর্যন্ত অ্যাডাল্টি সাইডিং করার কথা। কিন্তু
বেশিরভাগ এলাকায়ই তাদের দেখা পাওয়া যায় না।
সিটি কর্পোরেশনসূত্র জানিয়েছে, মূলত ঢাকার মশা নিধনের দায়িত্ব ছিল মশক নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের। কিন্তু তাদের ব্যর্থতার কারণে সেই দায়িত্ব নেয় দুই সিটি কর্পোরেশন। সিটি কর্পোরেশনের জনবলের পাশাপাশি অধিদপ্তরের জনবল যোগ করে মশা নিধনের কাজ শুরু হয়। কিন্তু কাজে গুরুত্ব না দেওয়ায় দুই সিটি মশা নিয়ন্ত্রণ করতে ব্যর্থ হয়। অভিযোগ উঠে, মশার ওষুধ ব্যবহার না করে গোপনে সেগুলো বিক্রি করে দেয়া হত। এমন নানা অভিযোগের প্রেক্ষিতে বেশ কয়েকজন কাউন্সিলর এই দায়িত্ব তাদের হাতে দেয়ার জন্য আবেদন করেন। পরে মশা নিধন কর্মীদের সরাসরি নিয়ন্ত্রণের দায়িত্ব পড়ে কাউন্সিলরদের ওপর। হালে একই অভিযোগ উঠে তাদের বিরুদ্ধেও।
এদিকে সরজমিন গতকাল দুই সিটির অন্তত অর্ধশত এলাকায় গিয়ে স্থানীয় বাসিন্দারের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, মশক নিধন কর্মীদের খুব একটা চোখে পড়ে না। মাঝেমধ্যে দেখা গেলেও অলিগলিতে তারা মশার ওষুধ না দিয়ে চলে যায়। মোহাম্মদপুরের ঢাকা উদ্যান এলাকার বেসরকারি চাকরিজীবি সালেকিন চৌধুরী বলেন, সারাদিনই থাকে মশার উৎপাত। বিশেষ করে সন্ধ্যার পর থেকে মশার কয়েল অথবা স্প্রে দিতে হয়। তা না হলে মশার কামড়ে অতিষ্ট থাকতে হয়। দিনেরও বেলা মশার উৎপাতের কমতি নেই। ঢাকা উদ্যান, নবীনগরে কোনদিনই কাউকে মশা নিধন করার জন্য আসতে দেখা যায়নি।
আদাবর ১০ নম্বর এলাকার বাসিন্দা আরিফুল ইসলাম ও এক দোকানি জানান, এই এলাকায় মশা নিধনের কো-কার্যক্রম সম্প্রতি চোখে পড়েনি। কবে এসেছিলো সেটাও মনে নেই। তবে এলাকার বাড়ির মালিকরা নিজ উদ্যোগে চারপাশ পরিষ্কার করেছেন। মিরপুর ইষ্টার্ন হাউজিংয়ের বাসিন্দা আজহার উদ্দিন বলেন, দুই বছর ধরে এলাকায় থাকি। কখনই মশা নিধন কর্মীদের ওষুধ দিতে দেখা যায়নি। বরং হাউজিং কর্তৃপক্ষ মাঝেমধ্যে মশার ওষুধ স্প্রে করে।
পশ্চিম মনিপুরের এক চা দোকানি আলি হোসেন বলেন, ১৫ দিন আগে একবার ফগার মিশিনের শব্দ শুনেছি। একই স্থানে আরেক নারী এসে বলেন, মশার উৎপাতে অতিষ্ঠ। ছোট ছেলে মেয়েদের নিয়ে খুব সাবধানে থাকতে হচ্ছে।
মোল্লাপাড়া এলাকার বাসিন্দা আব্দুস সাত্তার বলেন, টিন শেডের দুই রুম ভাড়া নিয়ে থাকি। ঈদের আগ থেকে এখন পর্যন্ত কোন মশক নিধন কর্মীকে চোখে পড়েনি। ৬০ ফিট এলাকার বাসিন্দা তহুর আলী বলেন, আমি নিজে ডেঙ্গু রোগে আক্রান্ত ছিলাম। এখন আমার ছেলেও আক্রান্ত। এলাকার সবাই একই আতঙ্কে আছেন।
বনশ্রী এলাকার বাসিন্দা মো. কায়েস বলেন, তিন বছর ধরে এই এলাকায় থাকি। ঠিক করে বলতে পারবো না মশার ওষুধ কবে দিয়েছে। এখন মশার উৎপাত চরমে। কয়েল, স্প্রে ভরসা। এই এলাকায় অনেকেই ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়েছে। তাই আতঙ্কটা একটু বেশি। নিশ্চই এডিস মশা আছে তাই ডেঙ্গু হচ্ছে। আমার ঘরে ছোট বাচ্চা তাকে নিয়ে চিন্তিত। দিনের বেলাও তার জন্য মশারী টানিয়ে রাখি। ফকিরাপুল পানির ট্যাংকি এলাকার বাসিন্দা রবিন হোসেন বলেন, নোংরা এলাকা। অল্প বৃষ্টি হলে পানি জমে থাকে। এই এলাকায় মশার উৎপাত বেশি। অথচ মশা মারতে কাউকে দেখা যায়নি। বাসাবো ছায়াবিথী এলাকার বাসিন্দা আব্দুল আউয়াল। পেশায় তিনি গণমাধ্যমকর্মী। তিনি ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, আমার আশেপাশের এলাকায় কখনও দেখিনি মশার ওষুধ দিতে। মধ্য বাসাবো এলাকার বাসিন্দা মোতালেব হোসেন বলেন, ঈদের কিছুদিন আগে এসেছিল। এরপর থেকে আর কাউকে দেখা যায়নি। একই এলাকার শাহাবউদ্দিন বলেন, এসেই কি করবে যে ওষুধ দেয় বিশ্রি গন্ধই বের হয় কিন্তু মশা মরে না।
গ্রীণ রোড এলাকার দোকানি সজল সরকার বলেন, সেই ঈদের আগে একবার দেখেছি। এরপরেও আর দেখিনি। নিকুঞ্জ এলাকার বাসিন্দা ও বেসরকারি চাকরিজীবি মাহমুদুল হাসান বলেন, গত সাত বছরের মধ্যে এই প্রথমবার মশা মারতে দেখলাম নিকুঞ্জ-২ এলাকায়। ১৩ নম্বর সড়কে হঠাৎ চোখে পড়ল উচ্চ শব্দ। খেয়াল করে দেখলাম মোটরসাইকেলের ওপর থেকে ফগার মিশিন দিয়ে ধোঁয়া দেয়া হচ্ছে। মোটরসাইকেল দিয়ে মশা মারতে জীবনে শুনিনি।
উত্তর মুগদা এলাকার বাসিন্দা ও ব্যবসায়ী ছিদ্দিক মিয়া বলেন, ঈদের আগে মেশিন নিয়ে কয়েকজন লোককে যেতে দেখেছি। তবে ওষুধ দিতে দেখিনি। আব্দুর রহমান নামের আরেক ব্যবসায়ী বলেন, সবসময়ই এলাকায় থাকি। সর্বশেষ এক দুপুরে স্থানীয় কাউন্সিলরের নেতৃত্বে ওষুধ দেয়া হয়েছিল পরে আর দেখিনি। মাহবুব নামের এক বাসিন্দা বলেন, চারটা কয়েল জ্বালিয়ে রাখি। তবুও মশা মরেনি। আমাদের গলিতেই ১২ বছর বয়সী একটা শিশু ডেঙ্গুতে মারা গেছে। আমার নিজেরও ছোট বাচ্চা আছে। সব মিলিয়ে একটা ভয় কাজ করছে। দক্ষিণগাঁও এলাকার বাসিন্দা মো. হেলাল বলেন, আমার এলাকা নতুন করে সিটি কর্পোরেশনে ঢুকানো হয়েছে। তাই কোনো দিনই মশা মারার ওষুধ দেয়া হয়নি। শুনেছি নতুন কেনো এলাকায়ই ওষুধ দেয়া হয় না।
শুক্রাবাদ এলাকার পদ্ম মোদি দোকানের মালিক আবুল বাশার বলেন, শনিবার মশা তাড়ানোর ওষুধ দিয়ে গেছে। এছাড়া এর কিছুদিন আগেও দিয়েছিলো। একই এলাকার বাসিন্দা আসিব বলেন, অনেকদিন পরে মশার ওষুধ দিতে দেখেছি। সব এলাকায় যদি নিয়মিতভাবে দেয়া হয় তাহলে মশা কিছুটা মরবে। পল্লবী এলাকার বাসিন্দা তিথি সরকার বলেন, ডেঙ্গুর প্রকোপ বাড়ার পর মাঝেমধ্যে ওষুধ দেয়। তবে কতটা কার্যকরি হচ্ছে সেটা জানিনা। কদমতলা এলাকার বাসিন্দা আনোয়ার হোসেন বলেন, এই এলাকায় মাঝেমধ্যে ওষুধ দেয়া হয় তবে কোনো উন্নতি দেখি না। যে ওষুধ দেয়া হয় সেটা মনে হয় কাজ করে না। রাজারবাগ কালি মন্দির এলাকায় বাসিন্দা জুয়েল বলেন, ভালো ওষুধ দিতে হবে। মশার উৎপাত বন্ধ হচ্ছে না।
মশক নিধনে পর্যাপ্ত লোকবল নেই: মশক নিধনে সিটি কর্পোরেশনের ভুমিকা নিয়ে প্রশ্ন উঠার পর কর্পোরেশন কর্তৃপক্ষ বলছেন, তাদের পর্যাপ্ত লোকবল নেই। দীর্ঘদিন ধরে লোকবলের চাহিদা মন্ত্রণালয়ে পড়ে আছে। তাই প্রয়োজনের চেয়ে অপ্রতুল লোকবল নিয়েই মশক নিধন কার্যক্রম চলছে। এছাড়া পর্যাপ্ত উপকরণও নেই। প্রতিটা ওয়ার্ডে মাত্র ২/৩ জন কর্মী দিয়েই চলে কার্যক্রম। এ অবস্থা দুই সিটি কর্পোরেশনেরই। সূত্রমতে, ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশন এলাকার ১০টি অঞ্চলে (নতুন যুক্ত পাঁচ ওয়ার্ড) মশা নিধনের কর্মী আছেন ৪২৯ জন। এর মধ্যে ১৭জন সুপারভাইজার, ৩জন আইসি (ইনসেক্ট কালেকটর), ১১০ জন ক্রু, ১৬৯ জন স্প্রেম্যান ও ১৩০ জন চুক্তিভিত্তিক কর্মী রয়েছেন। এসব কর্মীদের মধ্যে ৪০৯ জন সরাসরি মশক নিধনের কাজে জড়িত। এদের মধ্যে থেকে ৫৮ জনকে ডিএসসিসির নতুন ৫টি অঞ্চলে নিয়োগ দেয়া হলেও বাজেট, যন্ত্রপাতি না থাকার কারনে এসব অঞ্চলে এখনও মশক নিধন কাযক্রম শুরু হয়নি। এদিকে, উত্তর সিটি এলাকায় মশা নিধনের জন্য কর্মী আছেন মাত্র ২৮০ জন। এছাড়া ২৫০জনকে চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ দেয়া হয়েছে। সূত্রমতে, মশা নিধনে উত্তর সিটির ৬৫২টি মেশিন ছিল। কিন্তু বর্তমানে মেশিনের সংখ্যা ৭৮১টি। এর মধ্যে ফগার মেশিন ৩২২টি, হস্তচালিত ৪৪৯টি এবং হুইল ব্যারো মেশিন ১০টি। এসব মেশিনের মধ্যে বেশ কিছু মেশিন বিকল আছে। আর দক্ষিণ সিটিতে মশক নিধনের জন্য ৯৪০টি মেশিন রয়েছে। এর মধ্যে ৪৪২টি হস্তচালিত, ৪৪৭টি ফগার ও ৫১টি হুইল ব্যারো মেশিন । হস্তচালিত মেশিনগুলোর মধ্যে ২০৮টি ও ফগারের ১৮৬টি অচল এবং হুইল ব্যারো ১৮টি মেশিন অচল।
খোঁজ নিয়ে জানাগেছে, দক্ষিণ ও উত্তর সিটি কর্পোরেশনের (নতুন যুক্ত হওয়া ওয়ার্ডসহ) আয়তন ২৭০ বর্গকিলোমিটার। দক্ষিণের ৭৫টি ও উত্তরের ৫৪টি ওয়ার্ড মিলিয়ে ১২৯টি ওয়ার্ড রয়েছে। এসব ওয়ার্ডে প্রায় আড়াই কোটি (বেসরকারি হিসাব মতে) মানুষের বসবাস। অথচ বিশাল এই আয়তনের আড়াই কোটি মানুষের শহরে মশা নিধনের জন্য মাত্র ৭০৯জন কর্মী রয়েছেন। গড়ে প্রতিটা ওয়ার্ডে মাত্র ৩/৪ জন কর্মী কাজ করছেন। যা দিয়ে একটি ওয়ার্ডের সর্বত্র মশা নিধন সম্ভব হয় না।
সিটি কর্পোরেশনসূত্র জানিয়েছে, মূলত ঢাকার মশা নিধনের দায়িত্ব ছিল মশক নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের। কিন্তু তাদের ব্যর্থতার কারণে সেই দায়িত্ব নেয় দুই সিটি কর্পোরেশন। সিটি কর্পোরেশনের জনবলের পাশাপাশি অধিদপ্তরের জনবল যোগ করে মশা নিধনের কাজ শুরু হয়। কিন্তু কাজে গুরুত্ব না দেওয়ায় দুই সিটি মশা নিয়ন্ত্রণ করতে ব্যর্থ হয়। অভিযোগ উঠে, মশার ওষুধ ব্যবহার না করে গোপনে সেগুলো বিক্রি করে দেয়া হত। এমন নানা অভিযোগের প্রেক্ষিতে বেশ কয়েকজন কাউন্সিলর এই দায়িত্ব তাদের হাতে দেয়ার জন্য আবেদন করেন। পরে মশা নিধন কর্মীদের সরাসরি নিয়ন্ত্রণের দায়িত্ব পড়ে কাউন্সিলরদের ওপর। হালে একই অভিযোগ উঠে তাদের বিরুদ্ধেও।
এদিকে সরজমিন গতকাল দুই সিটির অন্তত অর্ধশত এলাকায় গিয়ে স্থানীয় বাসিন্দারের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, মশক নিধন কর্মীদের খুব একটা চোখে পড়ে না। মাঝেমধ্যে দেখা গেলেও অলিগলিতে তারা মশার ওষুধ না দিয়ে চলে যায়। মোহাম্মদপুরের ঢাকা উদ্যান এলাকার বেসরকারি চাকরিজীবি সালেকিন চৌধুরী বলেন, সারাদিনই থাকে মশার উৎপাত। বিশেষ করে সন্ধ্যার পর থেকে মশার কয়েল অথবা স্প্রে দিতে হয়। তা না হলে মশার কামড়ে অতিষ্ট থাকতে হয়। দিনেরও বেলা মশার উৎপাতের কমতি নেই। ঢাকা উদ্যান, নবীনগরে কোনদিনই কাউকে মশা নিধন করার জন্য আসতে দেখা যায়নি।
আদাবর ১০ নম্বর এলাকার বাসিন্দা আরিফুল ইসলাম ও এক দোকানি জানান, এই এলাকায় মশা নিধনের কো-কার্যক্রম সম্প্রতি চোখে পড়েনি। কবে এসেছিলো সেটাও মনে নেই। তবে এলাকার বাড়ির মালিকরা নিজ উদ্যোগে চারপাশ পরিষ্কার করেছেন। মিরপুর ইষ্টার্ন হাউজিংয়ের বাসিন্দা আজহার উদ্দিন বলেন, দুই বছর ধরে এলাকায় থাকি। কখনই মশা নিধন কর্মীদের ওষুধ দিতে দেখা যায়নি। বরং হাউজিং কর্তৃপক্ষ মাঝেমধ্যে মশার ওষুধ স্প্রে করে।
পশ্চিম মনিপুরের এক চা দোকানি আলি হোসেন বলেন, ১৫ দিন আগে একবার ফগার মিশিনের শব্দ শুনেছি। একই স্থানে আরেক নারী এসে বলেন, মশার উৎপাতে অতিষ্ঠ। ছোট ছেলে মেয়েদের নিয়ে খুব সাবধানে থাকতে হচ্ছে।
মোল্লাপাড়া এলাকার বাসিন্দা আব্দুস সাত্তার বলেন, টিন শেডের দুই রুম ভাড়া নিয়ে থাকি। ঈদের আগ থেকে এখন পর্যন্ত কোন মশক নিধন কর্মীকে চোখে পড়েনি। ৬০ ফিট এলাকার বাসিন্দা তহুর আলী বলেন, আমি নিজে ডেঙ্গু রোগে আক্রান্ত ছিলাম। এখন আমার ছেলেও আক্রান্ত। এলাকার সবাই একই আতঙ্কে আছেন।
বনশ্রী এলাকার বাসিন্দা মো. কায়েস বলেন, তিন বছর ধরে এই এলাকায় থাকি। ঠিক করে বলতে পারবো না মশার ওষুধ কবে দিয়েছে। এখন মশার উৎপাত চরমে। কয়েল, স্প্রে ভরসা। এই এলাকায় অনেকেই ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়েছে। তাই আতঙ্কটা একটু বেশি। নিশ্চই এডিস মশা আছে তাই ডেঙ্গু হচ্ছে। আমার ঘরে ছোট বাচ্চা তাকে নিয়ে চিন্তিত। দিনের বেলাও তার জন্য মশারী টানিয়ে রাখি। ফকিরাপুল পানির ট্যাংকি এলাকার বাসিন্দা রবিন হোসেন বলেন, নোংরা এলাকা। অল্প বৃষ্টি হলে পানি জমে থাকে। এই এলাকায় মশার উৎপাত বেশি। অথচ মশা মারতে কাউকে দেখা যায়নি। বাসাবো ছায়াবিথী এলাকার বাসিন্দা আব্দুল আউয়াল। পেশায় তিনি গণমাধ্যমকর্মী। তিনি ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, আমার আশেপাশের এলাকায় কখনও দেখিনি মশার ওষুধ দিতে। মধ্য বাসাবো এলাকার বাসিন্দা মোতালেব হোসেন বলেন, ঈদের কিছুদিন আগে এসেছিল। এরপর থেকে আর কাউকে দেখা যায়নি। একই এলাকার শাহাবউদ্দিন বলেন, এসেই কি করবে যে ওষুধ দেয় বিশ্রি গন্ধই বের হয় কিন্তু মশা মরে না।
গ্রীণ রোড এলাকার দোকানি সজল সরকার বলেন, সেই ঈদের আগে একবার দেখেছি। এরপরেও আর দেখিনি। নিকুঞ্জ এলাকার বাসিন্দা ও বেসরকারি চাকরিজীবি মাহমুদুল হাসান বলেন, গত সাত বছরের মধ্যে এই প্রথমবার মশা মারতে দেখলাম নিকুঞ্জ-২ এলাকায়। ১৩ নম্বর সড়কে হঠাৎ চোখে পড়ল উচ্চ শব্দ। খেয়াল করে দেখলাম মোটরসাইকেলের ওপর থেকে ফগার মিশিন দিয়ে ধোঁয়া দেয়া হচ্ছে। মোটরসাইকেল দিয়ে মশা মারতে জীবনে শুনিনি।
উত্তর মুগদা এলাকার বাসিন্দা ও ব্যবসায়ী ছিদ্দিক মিয়া বলেন, ঈদের আগে মেশিন নিয়ে কয়েকজন লোককে যেতে দেখেছি। তবে ওষুধ দিতে দেখিনি। আব্দুর রহমান নামের আরেক ব্যবসায়ী বলেন, সবসময়ই এলাকায় থাকি। সর্বশেষ এক দুপুরে স্থানীয় কাউন্সিলরের নেতৃত্বে ওষুধ দেয়া হয়েছিল পরে আর দেখিনি। মাহবুব নামের এক বাসিন্দা বলেন, চারটা কয়েল জ্বালিয়ে রাখি। তবুও মশা মরেনি। আমাদের গলিতেই ১২ বছর বয়সী একটা শিশু ডেঙ্গুতে মারা গেছে। আমার নিজেরও ছোট বাচ্চা আছে। সব মিলিয়ে একটা ভয় কাজ করছে। দক্ষিণগাঁও এলাকার বাসিন্দা মো. হেলাল বলেন, আমার এলাকা নতুন করে সিটি কর্পোরেশনে ঢুকানো হয়েছে। তাই কোনো দিনই মশা মারার ওষুধ দেয়া হয়নি। শুনেছি নতুন কেনো এলাকায়ই ওষুধ দেয়া হয় না।
শুক্রাবাদ এলাকার পদ্ম মোদি দোকানের মালিক আবুল বাশার বলেন, শনিবার মশা তাড়ানোর ওষুধ দিয়ে গেছে। এছাড়া এর কিছুদিন আগেও দিয়েছিলো। একই এলাকার বাসিন্দা আসিব বলেন, অনেকদিন পরে মশার ওষুধ দিতে দেখেছি। সব এলাকায় যদি নিয়মিতভাবে দেয়া হয় তাহলে মশা কিছুটা মরবে। পল্লবী এলাকার বাসিন্দা তিথি সরকার বলেন, ডেঙ্গুর প্রকোপ বাড়ার পর মাঝেমধ্যে ওষুধ দেয়। তবে কতটা কার্যকরি হচ্ছে সেটা জানিনা। কদমতলা এলাকার বাসিন্দা আনোয়ার হোসেন বলেন, এই এলাকায় মাঝেমধ্যে ওষুধ দেয়া হয় তবে কোনো উন্নতি দেখি না। যে ওষুধ দেয়া হয় সেটা মনে হয় কাজ করে না। রাজারবাগ কালি মন্দির এলাকায় বাসিন্দা জুয়েল বলেন, ভালো ওষুধ দিতে হবে। মশার উৎপাত বন্ধ হচ্ছে না।
মশক নিধনে পর্যাপ্ত লোকবল নেই: মশক নিধনে সিটি কর্পোরেশনের ভুমিকা নিয়ে প্রশ্ন উঠার পর কর্পোরেশন কর্তৃপক্ষ বলছেন, তাদের পর্যাপ্ত লোকবল নেই। দীর্ঘদিন ধরে লোকবলের চাহিদা মন্ত্রণালয়ে পড়ে আছে। তাই প্রয়োজনের চেয়ে অপ্রতুল লোকবল নিয়েই মশক নিধন কার্যক্রম চলছে। এছাড়া পর্যাপ্ত উপকরণও নেই। প্রতিটা ওয়ার্ডে মাত্র ২/৩ জন কর্মী দিয়েই চলে কার্যক্রম। এ অবস্থা দুই সিটি কর্পোরেশনেরই। সূত্রমতে, ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশন এলাকার ১০টি অঞ্চলে (নতুন যুক্ত পাঁচ ওয়ার্ড) মশা নিধনের কর্মী আছেন ৪২৯ জন। এর মধ্যে ১৭জন সুপারভাইজার, ৩জন আইসি (ইনসেক্ট কালেকটর), ১১০ জন ক্রু, ১৬৯ জন স্প্রেম্যান ও ১৩০ জন চুক্তিভিত্তিক কর্মী রয়েছেন। এসব কর্মীদের মধ্যে ৪০৯ জন সরাসরি মশক নিধনের কাজে জড়িত। এদের মধ্যে থেকে ৫৮ জনকে ডিএসসিসির নতুন ৫টি অঞ্চলে নিয়োগ দেয়া হলেও বাজেট, যন্ত্রপাতি না থাকার কারনে এসব অঞ্চলে এখনও মশক নিধন কাযক্রম শুরু হয়নি। এদিকে, উত্তর সিটি এলাকায় মশা নিধনের জন্য কর্মী আছেন মাত্র ২৮০ জন। এছাড়া ২৫০জনকে চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ দেয়া হয়েছে। সূত্রমতে, মশা নিধনে উত্তর সিটির ৬৫২টি মেশিন ছিল। কিন্তু বর্তমানে মেশিনের সংখ্যা ৭৮১টি। এর মধ্যে ফগার মেশিন ৩২২টি, হস্তচালিত ৪৪৯টি এবং হুইল ব্যারো মেশিন ১০টি। এসব মেশিনের মধ্যে বেশ কিছু মেশিন বিকল আছে। আর দক্ষিণ সিটিতে মশক নিধনের জন্য ৯৪০টি মেশিন রয়েছে। এর মধ্যে ৪৪২টি হস্তচালিত, ৪৪৭টি ফগার ও ৫১টি হুইল ব্যারো মেশিন । হস্তচালিত মেশিনগুলোর মধ্যে ২০৮টি ও ফগারের ১৮৬টি অচল এবং হুইল ব্যারো ১৮টি মেশিন অচল।
খোঁজ নিয়ে জানাগেছে, দক্ষিণ ও উত্তর সিটি কর্পোরেশনের (নতুন যুক্ত হওয়া ওয়ার্ডসহ) আয়তন ২৭০ বর্গকিলোমিটার। দক্ষিণের ৭৫টি ও উত্তরের ৫৪টি ওয়ার্ড মিলিয়ে ১২৯টি ওয়ার্ড রয়েছে। এসব ওয়ার্ডে প্রায় আড়াই কোটি (বেসরকারি হিসাব মতে) মানুষের বসবাস। অথচ বিশাল এই আয়তনের আড়াই কোটি মানুষের শহরে মশা নিধনের জন্য মাত্র ৭০৯জন কর্মী রয়েছেন। গড়ে প্রতিটা ওয়ার্ডে মাত্র ৩/৪ জন কর্মী কাজ করছেন। যা দিয়ে একটি ওয়ার্ডের সর্বত্র মশা নিধন সম্ভব হয় না।
No comments