একটি জাতীয় ব্যর্থতা by সাজেদুল হক
চার
বছরের ছোট্ট একটি শিশু। দুর্বিষহ এক দুর্ঘটনা। মুহূর্তেই সারা দেশে,
বিশ্বময় ছড়িয়ে পড়ে তার নাম। জিহাদ নামের শিশুটির জন্য প্রার্থনায় বসে যায়
বাংলাদেশ। সীমানা পেরিয়ে সারা দুনিয়ায় বাস করা বাংলাদেশীরাও নিশ্চিতভাবেই
শরিক ছিলেন এ প্রার্থনায়। গত শুক্রবার বিকালে শাহজাহানপুর রেল কলোনির মাঠে
হয়তো বন্ধুদের সঙ্গে খেলায় মগ্ন ছিল শিশুটি। হঠাৎ করেই সে পড়ে যায় কয়েক শ’
ফুট গভীর পাইপের ভেতরে। ১৪ ইঞ্চি ব্যসের পরিত্যক্ত এ পাইপের মুখে কোন ঢাকনা
ছিল না। অমার্জনীয় এক অবহেলার শিকার হলো শিশুটি। তার পাইপে পড়ে যাওয়ার
ঘটনা টেলিভিশন চ্যানেলগুলো সরাসরি সম্প্রচার শুরু করে। লাখ লাখ মানুষ তার
জন্য প্রার্থনা করতে থাকেন। এরই মধ্যে ফায়ার সার্ভিস তাকে উদ্ধারে অভিযান
শুরু করে। কিন্তু এ ব্যাপারে ট্রেনিং না জানা আর যন্ত্রপাতিহীন সংস্থাটি
ঠিক কিভাবে শিশুটিকে উদ্ধার করবে তা নিয়ে নানা প্রশ্নও তৈরি হয়। ওয়াসার
ক্যামেরা আসতেও কয়েক ঘণ্টা লেগে যায়। গভীর রাতে ঘটনাস্থলে ছুটে যান
স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী
বাহিনীর ঊধ্বর্তন কর্মকর্তারাও সেখানে ছিলেন। কিন্তু ক্যামেরার ছবিতে পাইপে
কোন শিশুর ছবি না পাওয়ার কথা বলেন স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী। শিশুটির পড়ে
যাওয়ার খবরকে গুজব হিসেবে অভিহিত করেন এনএসআই’র কর্মকর্তা আবু সাঈদ রায়হান।
তাদের এ বক্তব্যের পর নানা গুজব ছড়াতে থাকে। জিহাদের পিতা নাসির ফকিরকে
শাহজাহানপুর থানায় ধরে নিয়ে যায় পুলিশ। শিশুটি কোথায় আছে তা জানতে তাকে
নানা চাপ দেয়া হয়। এমনকি র্যাবের কাছে দেয়ার হুমকিও দেয়া হয় তাকে। কি
হতভাগা দেশ। পাইপের মধ্যে আটকে পড়া শিশুকে উদ্ধারের চেষ্টা করার অধিকারও
নেই পিতার। শনিবার বেলা আড়াইটার দিকে উদ্ধার অভিযানের সমাপ্তি ঘোষণা করেন
ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্সের মহাপরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল আলী আহমদ
খান। কিন্তু এর আধা ঘণ্টার মধ্যেই উদ্ধার হয় জিহাদ। সাধারণ কিছু মানুষের
উদ্যোগ আর প্রচেষ্টায় উদ্ধার হয় শিশুটি। কিন্তু মানুষের প্রার্থনার শক্তি
পরাজিত হয় মৃত্যুর কাছে। মৃত জিহাদ হয়ে ওঠে এক জাতীয় ব্যর্থতার প্রতীক।
বাংলাদেশ এখন উন্নয়নের গল্পের জন্য সারা দুনিয়াতেই পরিচিত। একটু কান পাতলেই
আপনি শুনবেন উন্নয়ন আর উন্নয়ন। আর কিছু পরিহাসও শুনবেন। রানা প্লাজা ধসের
পর শোনা গিয়েছিল ঝাঁকুনিতত্ত্ব। আটকে পড়া মানুষের লাশ উদ্ধারে সবচেয়ে বেশি
ভূমিকা পালন করতে হয়েছিল মানুষকেই। যাদের লাশ পাওয়া গিয়েছিল তারা হয়তো
সৌভাগ্যবানই। বহু মানুষ তাদের হারানো স্বজনকে আজও খুঁজে পাননি। রানা
প্লাজায় মিশে গেছেন তারা। একটি ভবনের ভেতর থেকে আটকে পড়া মানুষ উদ্ধারের
মতো প্রযুক্তিও আজ পর্যন্ত রপ্ত করতে পারিনি আমরা। ডুবে যাওয়া লঞ্চও এখন
হয়ে যায় নিরুদ্দেশ। মনুষ্যসৃষ্ট গাফিলতিতে সড়ক দুর্ঘটনায় প্রতিদিন মারা
যাচ্ছেন আদম সন্তান। ক্ষমতাবান মন্ত্রীরা যথারীতি এ নিয়ে পরিহাস করেন।
জিহাদের অবর্ণনীয় যন্ত্রণাময় মৃত্যুতেও ফুটে উঠেছে একটি জাতীয় ব্যর্থতার
চিত্রই। এ ব্যর্থতার অবশ্য দুটি ভাগ রয়েছে। এত গভীর একটি পাইপের মুখে কোন
ঢাকনা ছিল না। কর্তৃপক্ষ একবার এর খোঁজ নেয়ারও প্রয়োজন মনে করেনি।
দ্বিতীয়ত, শিশুটি আটকে পড়ার পর তাকে উদ্ধারে যথাযথ ব্যবস্থা নিতে ব্যর্থ
হয়েছে যথাযথ কর্তৃপক্ষ। দুনিয়ার অনেক দেশেই এ ধরনের ঘটনায় সেনাবাহিনীকে
সম্পৃক্ত করার নজির রয়েছে। কিন্তু আমাদের এখানে সে পথে হাঁটা হয়নি। বরং
পুরো উদ্ধার অভিযানই পরিচালিত হয়েছে অপরিকল্পিত আর সমন্বয়হীনভাবে। আর
এখানেও যথারীতি কর্তাব্যক্তিরা কিছু মশকরা করেছেন। জিহাদের জীবনের বিনিময়ে
সে পাইপটিতে ঢাকনা লেগেছে। শিশুটির লাশ প্রমাণ করেছে সে পাইপেই ছিল। এ
কারণে পুলিশের হাত থেকে ছাড়া পেয়েছেন তার পিতা। দুর্ভাগা বাংলাদেশে এমন
দৃশ্যের পুনরাবৃত্তি আর কতদিন চলবে। শরীতপুরের ডামুড্যায় চিরনিদ্রায় শায়িত
শিশুটি অভিশাপ দিচ্ছে কাকে? কার কাঁধে এ লাশ। রেলওয়ে কর্তৃপক্ষ, ওয়াসা,
ফায়ার সার্ভিস আর তার উদ্ধার অভিযান নিয়ে ধূম্রজাল সৃষ্টি করা ব্যক্তিরা কি
এ দায় এড়াতে পারবেন? জিহাদকে হারিয়ে শোকাবিদ্ধ বাংলাদেশ আজ ক্ষুব্ধও।
অনেকেই সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমেও জানিয়েছেন নিজেদের ক্ষোভের কথা। সাপ্তাহিক
সম্পাদক গোলাম মোর্তোজা ফেসবুকে লিখেছেন, জিহাদ জীবন দিয়ে, লাশ হয়ে ফিরে,
তার পিতাকে জেল খাটা থেকে রক্ষা করে গেছে। তা না হলে আমাদের কর্মবীর পুলিশ,
জিহাদ গর্তে পড়ে গেছে, এই মিথ্যা প্রচারণা চালিয়ে সরকারকে বিপদে ফেলার
অপরাধে, নিশ্চিত তাকে এখন জেলে রাখার ব্যবস্থা করতো। যুক্তরাষ্ট্রের ইলিনয়
স্টেট ইউনিভার্সিটির অধ্যাপক আলী রিয়াজ লিখেছেন, শিশু জিহাদের মৃত্যুর দায়
কেউ নেবেন কিনা- সেই প্রশ্নের জবাব আমরা সহজেই বলতে পারি। যারা পাইপের মুখ
খোলা রাখলেন তারা যেমন দায়িত্ব পালনে অবহেলার দায়ে দোষী, তেমনি দোষী তারাও
যারা এ ধরনের কাজের তত্ত্বাবধানের দায়িত্বে আছেন এবং এ ধরনের দুর্ঘটনা না
ঘটা পর্যন্ত যাদের সন্ধান পাওয়া যায় না। এসব ঘটনায়ও যে তাদের টনক নড়ে এমন
বলা যাবে না। উদ্ধার অভিযান চলাকালে পাইপের মধ্যে কোন শিশু নেই বলে যারা
মন্তব্য করেছেন, যারা পুরো ঘটনাকে ‘গুজব’ বলে মন্তব্য করেছেন এবং যারা
উদ্ধার অভিযান শ্লথ এবং পরে স্থগিত করার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন তাদের বিরুদ্ধেও
একই অভিযোগ তোলা যায়। এ দুর্ঘটনার খবর জানার প্রথম ঘণ্টায় কর্তব্য পালনে
অবহেলার জন্য একজনের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণের খবর জানা গিয়েছিল; সেই একই
বিবেচনা কি অন্যদের ক্ষেত্রেও সমভাবে প্রযোজ্য নয়? এ উদ্ধার অভিযানের সময়
যে অব্যবস্থা পরিলক্ষিত হয়েছে তার দায়িত্বইবা কে নেবেন? অভিযান সরকারিভাবে
কার্যত বন্ধ করে দেয়ার পর কয়েকজন তরুণ নিজস্ব উদ্যোগে পদক্ষেপ নিয়ে
শিশুটিকে উদ্ধার করেছেন, তার জন্য আমরা সবাই অবশ্যই তাদের কাছে কৃতজ্ঞ
থাকবো। এই দলে ছিলেন শফিকুল ইসলাম ফারুক, আবু বকর সিদ্দিক, আনোয়ার হোসেন,
কবির মুরাদ, নূর মোহাম্মদ, আবদুল মজিদ, শাহজাহান আলী, ইমরান, রাকিব, মুন ও
রাহুল। লক্ষণীয় যে, তারা সবাই একে অপরের পূর্বপরিচিত নন, উদ্ধার অভিযানে
এসে তাদের পরস্পরের পরিচয় হয়। সঙ্কটে একতাবদ্ধ হওয়ার ঐতিহ্য বাংলাদেশে নতুন
নয়, কিন্তু পরিবর্তনের জোয়ার এবং সমাজে বহুবিধ বিভক্তি সত্ত্বেও সেই
ঐতিহ্য যে এখনও আছে সেটা আমাদের জন্য আশা জাগানোর বিষয়। কিন্তু এ কথাও
বিবেচনা করে দেখুন, উদ্ধার অভিযান ‘স্থগিত’ করার পরপরই সংশ্লিষ্ট
প্রতিষ্ঠানগুলো তাদের দায়িত্ব শেষ মনে করে জায়গাটি অরক্ষিত রেখে দিয়েছে। এর
সঙ্গে যুক্ত হয়েছে পুলিশ বাহিনীর ‘চটজলদি কর্মতৎপরতা’। সেই তৎপরতার যে
ভাষ্য গণমাধ্যমে প্রকাশিত হয়েছে তাতে পুলিশের দায়িত্বে নিয়োজিত ব্যক্তির
শুধু এইটুকুই বলা কি যথেষ্ট যে, এমন হওয়া উচিত ছিল না। পুলিশের এ ভূমিকা
বিষয়ে কি কোন তদন্ত হবে? সেই দাবি তোলা কি অন্যায় আবদার? ১৪ই ডিসেম্বরে
লিখেছিলাম, বড় আকারের একটা বাড়ি ভেঙে পড়লে উদ্ধার অভিযানের যন্ত্রপাতি নেই
দেশে, সাধারণ মানুষকে হাত লাগিয়ে জীবন বিপন্ন করে উদ্ধার অভিযান চলে; ...
এই তালিকা আরও দীর্ঘ করা যায়, যেসব ‘দুর্ঘটনা’ ঘটতে পারে সেগুলো না ঘটা
পর্যন্ত এ নিয়ে কথা বলে লাভ কি? সুন্দরবনে তেল ছড়িয়ে পড়লে সাধারণ মানুষই
তেল উদ্ধারে, পরিবেশ রক্ষায় এগিয়ে এসেছেন। দীর্ঘ মেয়াদে তার ফল কি হবে, এর
জনস্বাস্থ্য-সংক্রান্ত প্রতিক্রিয়া কি হবে আমরা জানি না, সে খবর রাখার
উৎসাহও ক্ষুদ্র্র জনগোষ্ঠীর বাইরে লক্ষণীয় নয়। রানা প্লাজার পরে
শাহজাহানপুরের ঘটনায়ও প্রমাণিত হয়েছে ‘সাধারণ মানুষকে হাত লাগিয়ে’ উদ্ধার
করতে হয়। কিন্তু আর কত দুর্ঘটনার অপেক্ষা করতে হবে যে আমরা বুঝতে পারবো
জবাবদিহির ব্যবস্থা না থাকলে তার পরিণতি কি হয়? মধ্যবিত্তের নিরাপদ জীবন,
যে জীবনের বর্ণনা দিয়ে শামসুর রাহমান লিখেছেন, ‘চাল পাচ্ছি, ডাল পাচ্ছি,
তেল নুন লাকড়ি পাচ্ছি,/ভাগ-করা পিঠে পাচ্ছি, মদির রাত্তিরে কাউকে
নিয়ে/শোবার ঘর পাচ্ছি, মুখ দেখবার/ঝকঝকে আয়না পাচ্ছি, হেঁটে বেড়ানোর/তকতকে
হাসপাতালি করিডর পাচ্ছি/কিউতে দাঁড়িয়ে খাদ্য কিনছি,/বাদ্য শুনছি’ সেই জীবনে
তার প্রভাব না পরা পর্যন্ত কি এ নিয়ে কারও উৎসাহ তৈরি হবে না?
ধন্যবাদ, লেখাটা পড়ে ভালো লাগলো | আমি আপনাকে কোন প্রকার অফার করছি না। আমার মানে হয় এই ছোট তথ্যটি আপনার উপকারে আসতে পারে অ্যাপার্টমেন্ট ভাড়া।
ReplyDelete