সাহিত্যালোচনা- তান তুয়ান এঙের উপন্যাস দ্য গিফট অব রেইন by শ্যারন বেকার

ন্ডনের স্থানীয় পাঠকদের মাঝেমধ্যে বিপাকে পড়তে হয় এশীয়, বিশেষ করে মালয়েশীয় এবং সিঙ্গাপুরী লেখকদের মধ্যে নিজেদের এলাকার পটভূমির অনেক কিছুকে ক্যাপিটাল লেটারে লেখার কারণে। লন্ডনের কেউ কেউ এ বিষয়টিকে অভিযোগের মতো করে উপস্থাপন করে থাকেন। মালয়েশিয়ার ঔপন্যাসিক তান তুয়ান এঙের ব্যাপারেও এ রকম কথা বলা যেতে পারে। তার এ উপন্যাসের পটভূমি ঔপনিবেশিক পেনাঙ। তবে এঙ এ রকমের অভিযোগ বেশ সাহসের সঙ্গেই মোকাবিলা করতে প্রস্তুত।
তিনি বলেন, 'কেউ কেউ অবশ্যই বলতে পারেন, আমার উপন্যাস পশ্চিমা রুচির জন্য সহায়ক হতে পারে। এশিয়া সম্পর্কে পড়তে গেলে এ রকম বৈচিত্র্য না থাকলে পাঠক উপন্যাসে প্রাণ পান না। এশিয়া সম্পর্কে লেখা এ রকমই হওয়া উচিত। পাঠক এশিয়ার উত্তাপ না পেলে এশিয়ার চিত্র বিশ্বস্ত হয়েছে বলে বিশ্বাসই করবেন না।'
তান বলেন, তাঁর এ উপন্যাসের জন্ম গৃহকাতরতা থেকে। একসময় তিনি দক্ষিণ আফ্রিকায় ছিলেন। সে সময়কার গৃহকাতরতা থেকেই এ উপন্যাসের জন্ম। ওখানকার বন্ধু-বান্ধবরা তাঁকে ভ্রমণের আমন্ত্রণ জানান। তাঁর কাহিনী চিত্র মনের ভেতর আগেই বপন করা ছিল। বন্ধুরা বললেন লেখা শুরু করার জন্য। তিনিও বসে গেলেন লিখতে। মনে মনে যে কাহিনী গেঁথে ছিলেন তাঁর বিস্তৃতি ব্যাপক বিশাল আবহে বিরাজমান। তিনি ভেবেছিলেন প্রায় দুই হাজার পৃষ্ঠার একটি পারিবারিক কাহিনী লিখবেন। কিন্তু দেখলেন, এত বড় কাহিনী শেষ করতে দেরি হবে। সুতরাং তিনি ফিলিপ হাটন এবং এন্দো নামের দুটি চরিত্রকে নিয়ে ছোটগল্প তৈরি করতে মনস্থির করলেন। তখন তাঁর বিশ্বাস ছিল, এই ছোট পরিসরের কাহিনী শেষ করতে পারলে দীর্ঘ কাহিনীকে বশে আনতে পারবেন। তারপর মাত্র দুটি চরিত্রকে নিয়ে লেখা শুরু করলেন এবং দেখলেন, কাহিনী চলছেই। তখন আর মূল কাহিনীতে ফিরে যাওয়ার পথ নেই।
দ্য গিফট অব রেইনের লেখকের কাছে সবচেয়ে আকর্ষণীয় ঘটনা হয়ে দেখা দেয়_যখন একদিন হঠাৎ ঘুম থেকে জেগে ওঠেন মনের ভেতর একটি আবেদনময়ী চিত্রকল্প নিয়ে। তিনি এ ঘটনার বর্ণনায় বলেন, 'আমি এই ভগ্ন হৃদয়ের যুবসম্রাটের ছবি দেখলাম : কিসে যেন সামনে হাঁটু মুড়ে বসে আছে। আমিও বসে পড়লাম তার কাহিনী বয়ানে।'
প্রথমদিকে তান সংশয়ে ছিলেন। তিনি ভেবেছিলেন, কাহিনীটিকে হয়তো ছোট একটি উপন্যাস পর্যন্ত নিয়ে যেতে পারবেন; কিন্তু শুরু করার পর থেকেই কাহিনী মসৃণভাবে এগিয়ে যেতে থাকে। দাদা চরিত্রটিকে জীবন্ত করে তৈরি করে ফেলেন। কাহিনীতে মার্শাল আর্ট বিষয়বস্তুর প্রতিধ্বনি তৈরি করতে থাকেন। উপন্যাসের বিভিন্ন দৃশ্য চোখের কাছে সুস্পষ্টভাবে ভেসে ওঠে। এর অবশ্য সুনির্দিষ্ট একটি কারণও আছে : কাহিনীটিকে তান চলচ্চিত্রে রূপদানের কথা মাথায় রেখেই তৈরি করেছিলেন। তিনি বলেছেন, দক্ষিণ আফ্রিকার কিম্বারলিতে থাকাকালে চীনা ফিল্মের মধ্যে ক্রাউচিং টাইগার এবং হিড্ন ড্রাগনের মতো কিছু চলচ্চিত্র পেয়েছিলেন। দ্য গিফট অব রেইন উপন্যাসের ওপর এসব চলচ্চিত্রেরও প্রভাব আছে। উপন্যাসে তিনি ওইসব চলচ্চিত্রের কয়েকটি অংশ অনুবাদের মাধ্যমে তুলে ধরতেও চেয়েছিলেন।
তানের উপন্যাসের একটি বিশেষ দিক হলো, ইতিহাসকে গবেষণাধীন করে উপস্থাপন করা। এ প্রসঙ্গে তিনি অবশ্য বলেন, গবেষণা জাতীয় তেমন কোনো ভাবগম্ভীর প্রচেষ্টা নেই। এ যাবৎ পর্যায়ক্রমে যেসব বিষয় তাঁর নজরে গুরুত্বপূর্ণ বলে ধরা পড়েছে, সেগুলোকেই নিজের মতো করে উপস্থাপন করেছেন। তিনি বরাবরই ইতিহাসের প্রতি আগ্রহী ছিলেন। বিশেষ করে ঔপনিবেশিক ইতিহাস এবং পেনাঙের ইতিহাস তাঁর কাছে সবচেয়ে বেশি আকর্ষণীয় মনে হয়েছে। বহু দিনের পড়ার আলোকে কাজ করতে হয়েছে। এ ছাড়া দক্ষিণ আফ্রিকায় থাকাকালে তাঁর কাছে পেনাঙের ইতিহাসের ওপর খুব বেশি বইপত্র ছিল না। স্মৃতির ওপর নির্ভর করেছেন এবং মাঝেমধ্যেই মাকে ই-মেইল করেছেন তাঁর উপস্থাপিত তথ্য সঠিক আছে কি না দেখার জন্য। বাড়িতে ফিরে আসার আগ পর্যন্ত তাঁকে এ পদ্ধতিতেই এগোতে হয়েছে। ছোটখাটো সব তথ্যই তিনি পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে খতিয়ে দেখেছেন। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, ফিলিপের বাবা কোন আফটার শেভ ব্যবহার করতেন সেসবও তিনি অশীতিপর বয়স্কদের কাছ থেকে জেনে নিয়েছেন।
তান বলেন, উপন্যাসে বৈচিত্র্যের মধ্যে উল্লেখ করার মতো একটি দিক হলো, তাঁর কুংফুপ্রীতি। বাবার কাছ থেকে পেয়েছেন এই অনুরাগ। তাঁর আরেক ধরনের প্রীতি রয়েছে আইকিদোর প্রতি। তিনি বলেছেন, শুধু শারীরিক বিষয় নয়, এই খেলার একটা দার্শনিক বৈশিষ্ট্যও আছে। উপন্যাসে আইকিদো প্রশিক্ষণের একটি বিশেষ উদ্দেশ্যও আছে। এর মাধ্যমে ফিলিপ পরিপক্বতা অর্জন করেন। উপন্যাসের কাহিনীতে মারামারির অনেক সুযোগ থাকতে পারে বলেও তানের বিশ্বাস। নিজের উপন্যাস সম্পর্কে বলেন, হয়তো কোনোখানে কোনো বৃদ্ধ পাঠিকা তাঁর কাহিনী পড়তে পড়তে মন্তব্য করবেন, ওহ, এত দ্বন্দ্ব-সংঘাত!
তানের উপন্যাসে সাংস্কৃতিক পটভূমি এবং ইতিহাসের বিশদ বর্ণনা থাকলেও গতি রক্ষা করলেন কী করে? এ রকম প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, 'আমার নিজের কাছে যেহেতু লম্বা-চওড়া কোনো কিছু খুব তাড়াতাড়িই বিরক্তিকর হয়ে ওঠে, সেহেতু পাঠকের যাতে বিরক্তি না আসে সেদিকে খেয়াল রেখেই লিখতে হয়েছে। কাজেই যেকোনো দৃশ্য উপস্থাপনের সময় ওভাবেই যতটা সম্ভব সংক্ষেপে সারতে হয়েছে। স্বাধীনচেতা মনোভাবের বিপক্ষ বলতে যা বোঝায়_অদৃষ্টবাদ তানের উপন্যাসের একটি প্রধান বিষয়বস্তু হিসেবে দেখা দিয়েছে। অবশ্য তানের বক্তব্য হলো, উপন্যাস লেখা শুরুর আগে এ রকম কোনো পরিকল্পনা তার মাথায় ছিল না। বরং দুজন মানুষের একে অন্যের জন্য যে টান অনুভব করার বিষয়, সেটাকে এবং বিশেষ করে ফিলিপ যে ত্যাগস্বীকার করতে প্রস্তুত, সেটাকে ব্যাখ্যা করার জন্য এটাকে একটা কারণ হিসেবে চিহ্নিত করা যেতে পারে বলেই তাঁর বিশ্বাস। আমাদেরও সব কিছুই কি আগে থেকে পরিকল্পনা করা থাকে? এ রকম প্রশ্নের সম্মুখীন তান বহুবার হয়েছেন এবং জবাবে হ্যাঁসূচক উত্তর দিয়েছেন। তিনি মনে করেন, অনেক কিছুই এ রকম থাকতে পারে। তবে প্রশ্নটা কোন দিন জিজ্ঞেস করা হচ্ছে, তার ওপরও নির্ভর করে এর উত্তর। তান মনে করেন, এ রকম বিষয় আছে বলেই আমরা দেখতে পাই চীনা, ফিলিপিনো এবং জাপানি কূটনীতিক ইন্দোর মধ্যের অস্বাভাবিক সম্পর্ক।
এ রকম প্রশ্নও এসেছে_তান কি তাহলে এ সম্পর্ককে প্রেমের সম্পর্ক বলবেন? উত্তরে তিনি বলেছেন, এর জবাব নির্ভর করে পাঠক এই উপন্যাসে কী খুঁজছেন তার ওপর। অনেক সম্ভাবনার ইঙ্গিত দিয়েই লেখা হয়েছে। কেউ ইচ্ছে করলে ওভাবে নিতে পারেন। ইচ্ছে না করলে যেভাবে খুশি দেখতে পারেন।
জনপ্রিয়তা লাভের জন্য জনপ্রিয় শৈলীতে লেখার বিষয়টিকে তান মনে-প্রাণে অপছন্দ করেন। তাঁর গদ্যরীতি বেশ সোজা-সাপটা। ফিলিপের চরিত্রের খাতিরে ভাষা কিছুটা রীতিসিদ্ধ হলেও উপন্যাসের মেজাজ অনুযায়ী যথেষ্ট সমৃদ্ধ চিত্রকল্পও তৈরি করা হয়েছে।
চিত্রকল্প ব্যবহারের ব্যাপারে তাঁর স্বাচ্ছন্দ্যের কথাও তান উল্লেখ করেছেন অকপটে। চিত্রকল্পগুলোর কোনোটাকেই জোর করে জোড়া দেওয়ার চেষ্টা করা হয়নি, যা এসেছে স্বাভাবিকভাবেই এসেছে। অনিবার্যভাবেই এসেছে। তুলনা-প্রতিতুলনা তৈরি করার জন্য রূপকের ব্যাপারটাও ওই রকমই।
বর্তমানে তানের দ্বিতীয় উপন্যাসের কাজ চলছে। এ উপন্যাসের পটভূমি হিসেবে রাখা হয়েছে পেনাঙের ক্যামেরন পাহাড়ি অঞ্চলকে। সময় ১৯৪৮ থেকে ১৯৬০ পর্যন্ত জরুরি আইনের অধ্যায়কে। এর বিষয়বস্তু হিসেবে পাওয়া যাবে যুদ্ধাপরাধ। তাঁকে প্রশ্ন করা হয়েছিল, উপন্যাসের পটভূমি হিসেবে কখনো কি মালয়েশিয়াকে উপস্থাপন করবেন।
উত্তরে তান বলেছেন আপাতত ইচ্ছে নেই। ওখানে শপিংমল ছাড়া আর আছেই বা কী? গুরুত্বের সঙ্গে ভাবলে দেখা যাবে, লেখার মতো উপাদান বলতে সেখানে কিছু নেই।
তান তুয়ান এঙের জন্ম ১৯৭২ সালে পেনাঙে। ব্যাংকার বাবার বদলির কারণে পরিবারের অবস্থান হয়েছে বিভিন্ন সময়ে মালয়েশিয়ার বিভিন্ন স্থানে। খুব ছোটবেলা থেকেই পড়াশোনার প্রতি তাঁর টান তৈরি হয়ে যায়। পাঁচ-ছয় বছর বয়সেই পড়া শুরু করেন ইনিদ ব্লাইটনে। খাবার টেবিলে বসেও বই পড়তেন; স্কুলে ডেস্কেও আড়ালে বই পড়তেন। পড়ার ব্যাপারে কোনো রকম বাছবিচার ছিল না। যেখানে যেমন পেয়েছেন পড়েছেন। জ্যাকি কলিন্স, সিডনি শেল্ডন, জুডিথ ক্রাঞ্জ_সবার লেখাই পড়েছেন।
তান সাহিত্যকে বেশি গুরুত্বের সঙ্গে গ্রহণ করেছেন এ-লেভেলে পড়ার সময়। শিক্ষক হিসেবে যাঁদের পেয়েছেন তাঁরা ছিলেন অসাধারণ। এ ছাড়া যেসব লেখকের কাছে তাঁর ঋণের শেষ নেই তাঁদের মধ্যে আছেন সালমান রুশদি, কাজুও ইশিগুরো, বিক্রম শেঠ, ভ্লাদিমির নবোকভ, সমারসেট মম প্রমুখ।
তান পড়াশোনা করেন লন্ডন বিশ্ববিদ্যালয়ে আইন বিষয়ে এবং কুয়ালালামপুরের বিখ্যাত সব আইন প্রতিষ্ঠানে কর্মজীবন শুরু করেন। আরো পড়াশোনার জন্য ২০০০ সালে পাড়ি জমান ইউরোপে এবং মালয়েশিয়ার মধ্যে আসা-যাওয়া চলছে।
=========================
খবর- বন্ধ তাবানীতে লোক নিয়োগ  ইতিহাস- আমাদের ভাববিশ্ব ও বৌদ্ধবিহার  স্মৃতি ও ইতিহাস- ঢাকায় আমার প্রথম তিন দিনের স্মৃতিরোমন্থন  আলোচনা- একমাত্র প্রবাল দ্বীপটি কি হারিয়ে যাবে  আলোচনা- বাংলাদেশের সমাজ : মধ্যবিত্ত সমাচার  গল্প- দূর গাঁয়ের গল্প  সাহিত্যালোচনা- কবিতার হয়ে ওঠা  সাহিত্যালোচনা- কবিতার হয়ে ওঠাই কবির তপস্যা  পাঁচ গাড়িসহ দুই ছেলের মালপত্র বুঝে নেওয়া হলো আজ বাকিগুলো  গল্প- 'কোনো এক গাঁয়ের বিয়ে'  গল্প- মৌরস ভৌরস  শিল্পি- ড্রয়িং, স্কেচ না পূর্ণাঙ্গ চিত্রকর্ম  গল্পসল্প- নারী শিক্ষা মন্দির  স্মৃতি ও গল্প- ছিন্নস্মৃতি  স্মৃতি ও গল্প- স্কুল জীবনে বাঁকুড়া, জলপাইগুড়ি ও যশোর  ফিচার- তাঁহাদের দান  ফিচার- ডায়ানার আংটি  গল্প- 'অভিমান'  গল্প- 'মাটির ব্যাংক'  গল্পসল্প- 'সাগরকে যাঁরা পোষ মানালেন'  স্মরণ- 'আমাদের সেলিনা আপা'  আলোচনা- 'বেতন-ভাতা না নেওয়ার ‘নীতিগত’ সিদ্ধান্ত নয় কেন?  ড. ইউনূসের বিরুদ্ধে অভিযোগ পরীক্ষা করছে নরওয়ে  খালেদার মালপত্র আজ বুঝিয়ে দেওয়া হবে  আলোচনা- 'পার্বত্য অঞ্চলে শান্তি ও অশান্তির মনস্তত্ত্ব'  সাক্ষাৎকার- পাহাড়ে পাহাড়িদের সংখ্যালঘু করা হচ্ছে  আলোচনা- 'শান্তিচুক্তির ১৩ বছর'  রাজনৈতিক আলোচনা- 'উন্মত্ত নৈরাজ্যের শক্তি বনাম সোনালি সম্ভাবনা'  আলোচনা- ''ট্রানজিট' না 'করিডোর' না 'কানেকটিভিটি'


দৈনিক কালের কন্ঠ এর সৌজন্যে
লেখকঃ শ্যারন বেকার
অনুবাদঃ দুলাল আল মনসুর


এই লেকখা'টি পড়া হয়েছে...
free counters

No comments

Powered by Blogger.