উদ্যোগগুলোকে প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামোয় আনতে হবে
রাজধানীর মহাখালীর ব্র্যাক সেন্টারে গতকাল অ্যাকশনএইড আয়োজিত সংলাপে বক্তব্য দেন সংস্থাটির এ দেশীয় পরিচালক ফারাহ কবির |
রানা
প্লাজা ধসের পর আহত শ্রমিকেরা অর্থসহায়তা পেয়েছেন। তবে সহায়তার অধিকাংশ
তাঁদের দৈনন্দিন খরচ ও ঋণ দিতেই ব্যয় হয়েছে। ফলে সেটি বিনিয়োগ পর্যায়ে
যায়নি। তা ছাড়া আহত শ্রমিকদের স্বাস্থ্যগত মূল্যায়ন করে যে অর্থ দেওয়া
হয়েছে, সেটিও পর্যাপ্ত নয়। বেসরকারি সংস্থা অ্যাকশনএইড আয়োজিত ‘বহুপাক্ষিক
সংলাপ: রানা প্লাজা ধসের তিন বছর ও পোশাকশিল্পের অগ্রগতি’ শীর্ষক
আলোচনায় বক্তারা এসব কথা বলেন। তাঁরা বলেন, আর্থসামাজিক চাহিদা বিবেচনা
করে জাতীয় ক্ষতিপূরণকাঠামো করা দরকার। কারণ, শ্রম আইন অনুযায়ী বর্তমানে
ক্ষতিপূরণের হার খুবই কম। পাশাপাশি আহতের দীর্ঘমেয়াদি চিকিৎসায় সরকারকে
নীতিমালা করতে হবে। এ ছাড়া স্বাধীনভাবে ট্রেড ইউনিয়ন নিবন্ধন ও অনুশীলন,
কারখানার কর্মপরিবেশ উন্নয়নসহ বিভিন্ন উদ্যোগকে প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামোর
মধ্যে নিয়ে আসা দরকার। না হলে ভবিষ্যতে কোনো দুর্ঘটনা ঘটলে আবারও পেছন
থেকে শুরু করতে হবে বলেও সাবধান করে দেন আলোচকেরা। রাজধানীর মহাখালীতে
ব্র্যাক সেন্টার ইনে গতকাল শনিবার সংলাপটি অনুষ্ঠিত হয়। এতে সভাপতিত্ব করেন
সংস্থার এদেশীয় পরিচালক ফারাহ কবির। উপস্থিত ছিলেন কলকারখানা ও প্রতিষ্ঠান
পরিদর্শন অধিদপ্তরের মহাপরিদর্শক সৈয়দ আহম্মদ। আহত শ্রমিক ও নিহতের
পরিবারের সদস্যদের ক্ষতিপূরণের বিষয়ে মানবাধিকারকর্মী হামিদা হোসেন বলেন,
‘ইউরোপীয় কিছু ট্রেড ইউনিয়নের চাপে পড়ে ব্র্যান্ডগুলো কিছু অর্থসহায়তা
দিয়েছে। এটি ক্ষতিপূরণ না।’ তিনি বলেন, ক্ষতিপূরণের বিষয়ে কারখানার মালিক ও
বিজিএমইএকে আরও বেশি দায়বদ্ধতায় আনতে হবে।ক্ষতিপূরণ নির্ধারণের জন্য
হাইকোর্টের দুই বিচারপতি স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে রুল জারি করেন। সে অনুযায়ী
সরকার উচ্চপর্যায়ে কমিটি গঠন করে। কমিটি ক্ষতিপূরণের একটি নির্দিষ্ট অঙ্ক
নির্ধারণ করে হাইকোর্টে জমা দেয়। এসব তথ্য দিয়ে হামিদা হোসেন বলেন,
‘ক্ষতিপূরণের বিষয়টি হাইকোর্টে এখনো ঝুলে আছে। সিদ্ধান্ত আসেনি।’ রানা
প্লাজা ধসের পর ভুক্তভোগীদের সহায়তায় নেওয়া বিভিন্ন উদ্যোগের মধ্যে সমন্বয়
নেই বলে অভিযোগ করেন বেসরকারি গবেষণা সংস্থা সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের
(সিপিডি) অতিরিক্ত গবেষণা পরিচালক খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম। তিনি বলেন,
একটি তথ্যভান্ডার করা দরকার। কারা সুবিধা পাচ্ছে, কারা সুবিধার বাইরে রয়ে
গেছে, এ জন্য মন্ত্রণালয় উদ্যোগ নিতে পারে। ইউরোপীয় ক্রেতাদের জোট
অ্যাকর্ড ও উত্তর আমেরিকার ক্রেতাদের জোট অ্যালায়েন্স বাংলাদেশের পোশাক
কারখানার কর্মপরিবেশ উন্নয়নের কাজটি ২০১৮ সালে শেষ করবে। সেটি স্মরণ করিয়ে
দিয়ে গোলাম মোয়াজ্জেম বলেন, উদ্যোগ দুটোকে এগিয়ে নিতে না পারলে আবার
বড় দুর্ঘটনা ঘটলে নতুন করে সবকিছু শুরু করতে হবে। আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থা
(আইএলও) বাংলাদেশের আরএমজি প্রোগ্রাম ম্যানেজার টিউমো পটিআইনেন বলেন,
সরকার সংশোধন সমন্বয় কেন্দ্র (আরসিসি) করতে যাচ্ছে। অ্যাকর্ড ও
অ্যালায়েন্সের কারখানার সংশোধন কার্যক্রমকে চলমান ও এগিয়ে নেওয়ার
পরিকল্পনা নিয়েই এটি করা হচ্ছে। অ্যালায়েন্সের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মেসবাহ
রবিন বলেন, ‘২০১৮ সালের ১১ জুলাইয়ের পর একদিন থাকবে না অ্যালায়েন্স। তবে যে
সংস্থা এটির দায়িত্ব নেবে, তাদের ওপর বিদেশি ক্রেতা ও ব্র্যান্ডের ভরসা
কতটুকু আছে, সেটিও দেখতে হবে। কারণ, তারা কেবল শ্রম আইন বাস্তবায়ন করে।
সংস্কার কাজ তদারকিতে অনেক প্রযুক্তিগত সহায়তা লাগবে। আশা করি, দুই বছরের
মধ্যে সেই সক্ষমতা তৈরি হবে।’ অ্যাকশনএইড রানা প্লাজা ধসে আহত শ্রমিক ও
নিহত শ্রমিক পরিবারের সদস্যদের ওপর একটি জরিপ চালায়। অনুষ্ঠানে জরিপের
বিভিন্ন তথ্য-উপাত্ত তুলে ধরেন সংস্থার কর্মকর্তা নুজহাত জেবিন। তিনি রানা
প্লাজার সার্বিক পরিস্থিতি বিবেচনায় নিয়ে কারখানার নিয়মিত পরিদর্শন
কার্যক্রমকে শক্তিশালী, কারখানায় স্বাধীনভাবে ইউনিয়ন করার অধিকার নিশ্চিত,
শ্রম আইনের দুর্বল দিকগুলো সংশোধন এবং ব্র্যান্ডগুলোর জবাবদিহি নিশ্চিত
করার সুপারিশ করেন। অধিদপ্তরের মহাপরিদর্শক সৈয়দ আহম্মদ রানা প্লাজা ধসের
শ্রমিকদের নিরাপত্তা নিশ্চিতে সরকারের নেওয়া বিভিন্ন উদ্যোগ গ্রহণের কথা
বলেন। তিনি জানান, শ্রম আইন সংশোধনের পর পোশাকশিল্পে ট্রেড ইউনিয়ন
নিবন্ধনের হার বাড়ছে। এখন পর্যন্ত ৪৮১টি ইউনিয়ন নিবন্ধিত হয়েছে। ট্রেড
ইউনিয়নের বিষয়ে হামিদা হোসেন বলেন, বাংলাদেশে ট্রেড ইউনিয়নের দুটি সমস্যা।
এক. ইউনিয়ন অনেক বেশি রাজনৈতিকীকরণ হয়ে আছে। দুই. মালিকেরাও ট্রেড ইউনিয়ন
করছেন। ফলে স্বাধীনভাবে শ্রমিকেরা ট্রেড ইউনিয়ন করতে পারেন না।
অ্যাকশনএইডের এদেশীয় পরিচালক ফারাহ কবির বলেন, ‘যে ট্র্যাজেডি ঘটেছিল, সেটি
ঘটার কথা ছিল না। ১০-১৫ বছর পরও আমরা যেন ভুলে না যাই, এটি আমাদের
ব্যর্থতা ছিল। ব্যর্থতাটি সরকারের সংস্থা, ভবনমালিক, কারখানার মালিক ও
ব্র্যান্ডের।’ তিনি বলেন, ‘যতটুকু ইতিবাচক পরিবর্তন হয়েছে, বাকিটার জন্য
যাতে আরেকটি রানা প্লাজা ধস দেখতে না হয় আমাদের।’
No comments