সম্মিলিত আরব ভিশনই উগ্রপন্থীদের পরাজিত করতে পারে

আইএসের সঙ্গে ইরাকের নিষিদ্ধ ঘোষিত বাথ পার্টির সংযোগের বিষয়টি কয়েক বছর ধরে মিডিয়ার পুনঃপৌনিক আলোচনার বিষয়ে পরিণত হয়েছে। বাস্তব অভিজ্ঞতার আলোকে হোক বা ভুয়া অনুমানের ভিত্তিতে অনেক প্রতিবেদন বলছে, আইএসের ভিত্তি গড়ে উঠেছে এবং তা ব্যাপকভাবে পরিচালিত হচ্ছে সাবেক ইরাকি প্রেসিডেন্ট সাদ্দাম হোসেনের প্যান আরব জাতীয়তাবাদী বাথ পার্টির কর্মকর্তাদের ব্যবস্থাপনায়। ২০০৩ সালে যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক হামলা ও ইরাক দখলের পরপরই দলটিকে নিষিদ্ধ করা হয় এবং ইরাকের সেনাবাহিনী ভেঙে দেয়া হয়। দেশটির তখনকার মার্কিন শাসক পল ব্রেমার ‘ডি-বাথিফিকেশন ল’ নামে পরিচিত একটি আইনে স্বাক্ষর করেছিলেন, যাতে চার লাখ সদস্যের সেনাবাহিনী ভেঙে দেয়ার পাশাপাশি সরকারি চাকরিজীবী ও পেশনভোগীদের সরকারি কাজে নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হয়। ২০০৬ সালে ফাঁসিতে ঝুলিয়ে সাদ্দাম হোসেনের মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা হয়। যে বিষয়টিকে যুক্তরাষ্ট্র হঠকারিতাপূর্ণভাবে চূড়ান্ত বিজয় এবং ইরাকের অতীতকে ভেঙেচুরে পরিষ্কার করা হয়েছে ভেবেছিল, সেটাই ইরাকের সমাজ কাঠামোর মারাত্মক ধ্বংসের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। লাখ লাখ সদস্যের বাথ পার্টিকে নিষিদ্ধ করা, সেনাবাহিনী ভেঙে দেয়া এবং সুন্নিদের প্রান্তিক পর্যায়ে ঠেলে দেয়া আরেকটি অভ্যুত্থান শুরুর পথ দেখিয়েছে, যেটা কেবল সম্ভাব্য আমেরিকাবিরোধীই ছিল না, একই সঙ্গে জাতিগত বিভক্তির ভিত্তিও ছিল। ইরাকে নিপীড়িত ও প্রান্তিকীকৃত সুন্নিদের বিপরীত প্রেক্ষাপটে নতুন প্রভাবশালী গ্রুপ হিসেবে শিয়া ফেরকার উত্থান স্বল্প মেয়াদে কেবল আমেরিকার স্বার্থেরই সুরক্ষা দিয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রের ইরাক দখলের বিরুদ্ধে দেশটিতে বেড়ে ওঠা প্রতিরোধ ক্ষমতা নতুন রূপ পেতে শুরু করেছে, যেখানে একসময় শক্তিশালী আরব দেশ ইরাকে বিদেশিদের উপস্থিতিকে সহজভাবে দেখা লোকদেরও টার্গেট করা হয়েছে। শিয়াদের প্রতি হামলা দ্রুতই বেড়ে গিয়ে নতুন নিয়োগকৃত পুলিশ হত্যা, তীর্থযাত্রী এবং ব্যস্ত মার্কেটে বেসামরিক নাগরিক হত্যা পর্যন্ত গড়াচ্ছে। নিজের তৈরি করা অস্থিতিশীলতা সামাল দিতে ব্যর্থ হয়ে যুক্তরাষ্ট্র ইরাকের ভেতরে ও বাইরে সেনা মোতায়েন করেছে, দেশটিকে বিভিন্ন উপদল ও মতবাদে বিভক্ত করেছে এবং বছরের পর বছরের জন্য গোটা অঞ্চলকে অস্থিতিশীল করতে পর্যাপ্ত অস্ত্র ও ঘৃণার জোগান দিয়েছে। ধারণা করা যায়, ইরাকে যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক হস্তক্ষেপ অনেক সহিংস প্রপঞ্চের সূচনা করেছে- যার ধ্বংসাত্মক উপস্থিতি বড় আকারে অনুভূত হচ্ছে সিরিয়ায়, একই সঙ্গে মধ্যপ্রাচ্যের অন্যান্য অংশের পাশাপাশি সারা বিশ্বেও এর প্রতিক্রিয়া দেখা যাচ্ছে। যদিও অনেকে জোর দিচ্ছেন এসব সহিংস ঘটনাকে বিচ্ছিন্ন হিসেবে দেখার জন্য। কারণ, তাদের মতে বর্তমানের সহিংসতা ও অতীতের অবৈধ যুদ্ধের মধ্যে সংযোগ খোঁজা বিভ্রান্তি তৈরি করে। এ দৃষ্টিভঙ্গিতে কেবল বুদ্ধিবৃত্তিক দৈন্যতা আছে তাই নয়, একই সঙ্গে এটা বিপজ্জনক মতবাদও বটে- যেখানে সমস্যার শাখা-প্রশাখাকে চিহ্নিত করা হয়েছে, মূলকে নয়। অন্যান্য মূলধারার মিডিয়া সূত্রের পাশাপাশি ওয়াশিংটন পোস্ট আইএসের শেকড় নিয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষার প্রয়োজনীয়তার কথা বলেছে। ২০১৫ সালে লিজ স্লাই লিখেছেন, বিদেশি সন্ত্রাসীদের পাবলিক প্রোফাইল প্রায়ই অস্পষ্ট করা হয় আইএসের শেকড় সাম্প্রতিক রক্তাক্ত ইরাকের ইতিহাসের সঙ্গে সম্পৃক্ত করার মাধ্যমে। অন্য লেখকরাও এ দৃষ্টিভঙ্গি তুলে ধরেন যে, তাদের বক্তব্যের উদ্দেশ্য সাদ্দামের বাথ পার্টির শাসনকে আইএসের নির্দয়তার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট করা, নৈতিক দায়-দায়িত্বকে গ্রহণ করে নেয়া নয়। প্রকৃতপক্ষে নিরপেক্ষ সাম্প্রতিক ইতিহাসের পরিপ্রেক্ষিতে বর্তমান সমস্যাগুলো কমই আলোচনায় এসেছে। একটা বিষয় লক্ষণীয়, প্রকৃত সত্য হচ্ছে আরব জাতীয়তাবাদী আন্দোলন, যার প্রকৃত প্রচারক ছিলেন খ্রিস্টান চিন্তাবিদ মিশেল আফলাক এবং যুক্ত ছিলেন নিয়তিবাদে বিশ্বাসী একটি গ্রুপের সঙ্গে, ওই গ্রুপটি ধর্মীয় বিষয়াবলি প্রচারে খুব কম সংশ্লিষ্ট ছিল। বিষয়টি বিবেচনা ও উপলব্ধির দাবি রাখে। এর থেকে এটাই ধরে নেয়া যায়, মধ্যপ্রাচ্যের সহিংসতা, যা বর্তমানে সারা বিশ্বে ছড়িয়ে পড়ছে, এর মূল কখনও ধর্মীয় বা আদর্শিক বিষয়বস্তুকে কেন্দ্র করে নয়; এর মূল হল ধ্বংসাত্মক সিরিজ যুদ্ধের এবং রাজনৈতিক বিভিন্ন সিদ্ধান্তের পারিপার্শ্বিকতা- যে যুদ্ধ ও সিদ্ধান্ত অনৈক্য ও ধর্মীয় গোত্রবাদের বীজ বপন করেছে। যখন যুক্তরাষ্ট্র ও তার মিত্রদের সাহস রাখা উচিত এ অঞ্চলে তাদের ভুল নীতি-আচরণ স্বীকার করে নেয়ার ওপর, তখন আরববিশ্বকে অবশ্যই একটি সম্মিলিত দূরকল্প (ভিশন) ব্যক্ত করতে হবে- যা বিভিন্ন গোত্রের উপজাতীয়তাবাদকে ছাপিয়ে যাবে। এ বিষয়টিকে ভুল ব্যবস্থাপনায় ও ভুল রূপে ব্যবহার করা হচ্ছে। একটি সম্মিলিত দূরকল্প দুর্ভাগ্যজনকভাবে অনুপস্থিত। কারণ, এ অঞ্চলের প্রকৃত রূপ আফলাক, জর্জ হাবাশ, রশিদ আল গানুচি, এডওয়ার্ড সাইদ ও অন্য অনেকের বুদ্ধিবৃত্তিক মতবাদ ও বর্ণনার আবরণে ঢাকা পড়ে গেছে। ইসলামভীতি সৃষ্টিকারীরা আইএসের কাছে ইসলামকে খাটো করতে উদগ্রীব। কেউ কেউ ষড়যন্ত্র তত্ত্বের ওপর জোর দিচ্ছেন আইএসের উত্থানের পেছনের কারণ হিসেবে। ফলে পশ্চিমা মিডিয়া ও শিক্ষাবিদদের এ সংক্রান্ত আলোচনা এখনও রয়ে গেছে নিষ্ফল। এ অনর্থক বিতর্কে অনেক সময় অপচয় হয়েছে; কিন্তু উগ্রপন্থার শেকড় কোনো একটি ধর্মে পাওয়া যায়নি। বিপরীতে এটা বৃহৎভাবে পাওয়া যেতে পারে বড় ধরনের বিদেশি সামরিক হস্তক্ষেপ ও ধ্বংসাত্মক কার্যক্রমের মধ্যে। অদ্ভুতভাবে বিদেশি হস্তক্ষেপকারীরা অন্য দেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে নিজেদের হস্তক্ষেপের যৌক্তিকতা প্রমাণ করতে ‘উগ্রপন্থার বিরুদ্ধে লড়াইয়ের’ বুলি আওড়ায়। এতে করে উগ্রপন্থীরা আরও বেশি সুযোগ পায়, এমন হস্তক্ষেপ তাদের বেশি করে সদস্য সংগ্রহের সুযোগ দেয়, অর্থ সংগ্রহ ও জনপ্রিয়তাও পাইয়ে দেয়। এটা হয়ে পড়েছে একটা দুষ্টচক্র, যা ইরাকে মার্কিন সামরিক হস্তক্ষেপের পর মধ্যপ্রাচ্যকে আঁকড়ে ধরেছে। পশ্চিমা মিডিয়ায় বিদেশি সামরিক হস্তক্ষেপ, এর জের ধরে সৃষ্ট বিশৃঙ্খলা এবং উগ্রপন্থার মধ্যে সম্পর্কের বিষয়টি প্রায় এড়িয়ে যাওয়া হচ্ছে। তবে আরববিশ্বের চ্যালেঞ্জগুলো কিছুটা ভিন্ন। এখনই সময় আরব বুদ্ধিজীবীদের একটি বিষয়ে গুরুত্ব দেয়ার- জাতীয়তাবাদ, সমাজতন্ত্র ও ইসলামী আদর্শের সমন্বয় সাধন। সামগ্রিকভাবে অথবা ব্যক্তিগত পর্যায়ে আরবদের ওপর এর প্রচণ্ড প্রভাব রয়েছে। একমাত্র আরবরাই সক্ষম আইএস ও অন্য সন্ত্রাসীদের পরাস্ত করতে। এ জন্য প্রয়োজন সত্যিকারের দূরকল্প গড়ে তোলা- যেখানে একতার ওপর দৃঢ় ঘোষণা থাকবে এবং স্বাধীনতার আকাঙ্ক্ষাকে উৎসাহিত করা হবে। এর অন্যথা হলে আরও উগ্রপন্থা ও বিদেশি হস্তক্ষেপ দেখা দেবে এবং মধ্যপ্রাচ্যে শান্তি ও স্থিতিশীলতার সুযোগ নষ্ট হয়ে যাবে।
গালফ নিউজ থেকে সংক্ষেপিত ভাষান্তর : সাইফুল ইসলাম
ড. রামজি বারুদ : কলামিস্ট ও প্যালেস্টাইন ক্রোনিকল ডটকমের প্রতিষ্ঠাতা

No comments

Powered by Blogger.