ঈদ ও নির্বাচনকে ঘিরে চাঙ্গা গ্রামীণ অর্থনীতি

আসন্ন ঈদকে ঘিরে গ্রামে টাকার প্রবাহ বাড়ছে। বিভিন্ন মাধ্যমে টাকার জোগান যাচ্ছে গ্রামে। জাকাত, ফিতরার বড় অংশই বিতরণ হচ্ছে গ্রামে। ঈদ ও রমজানে বাড়তে শুরু করেছে প্রবাসীদের পাঠানো রেমিটেন্স। এ ছাড়া জুনে অর্থবছর শেষ হয়ে আসায় সরকারি বিভিন্ন উন্নয়ন প্রকল্পের অর্থ খরচ করার প্রবণতা বেড়েছে। এর একটি বড় অংশই যাচ্ছে গ্রামে। সরকারি-বেসরকারি চাকরিজীবীদের বোনাসের একটি অংশ ইতিমধ্যে গ্রামে চলে গেছে। রোজা ও ঈদের বাড়তি খরচ মেটাতে কৃষকের ঘরে মজুদ ধান বা অন্যান্য ফসলের একটি অংশ বিক্রি শুরু হয়েছে। বিশেষ করে রাজশাহী, দিনাজপুর অঞ্চলের আম-লিচু বিক্রির টাকাও এখন যাচ্ছে গ্রামে। এদিকে অর্থবছরের শেষ সময় হওয়ায় কৃষি ঋণ বিতরণের লক্ষ্যমাত্রা অর্জন করতে ব্যাংকগুলোকে আরও বেশি টাকা বিতরণ করতে হবে। অপরদিকে এক বছর পরই জাতীয় নির্বাচন। ফলে ভোটার তুষ্ট করতে রাজনীতিবিদদের নানা কর্মসূচিতেও বাড়বে টাকার প্রবাহ। সবকিছু মিলে ঈদ ও নির্বাচনের কারণে চাঙ্গা হচ্ছে গ্রামীণ অর্থনীতি। তবে এ টাকার বড় অংশই ব্যয় হচ্ছে ভোগবিলাসে। আর কিছু অংশ যাচ্ছে গ্রামের বিভিন্ন ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্পভিত্তিক উৎপাদন খাতে। এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা ড. এবি মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম যুগান্তরকে বলেন, রমজান ও ঈদের মতো উৎসব এলেই বাড়তি টাকার প্রবাহে সচল হয়ে ওঠে গ্রামের অর্থনীতি। ফলে নিন্ম আয়ের মানুষের হাতেও টাকা আসে। এতে তাদের ক্রয়ক্ষমতা বাড়ে। এটি ইতিবাচক দিক। তবে বাড়তি টাকার প্রবাহের কারণে মূল্যস্ফীতি বেড়ে যায়। এ জন্য ঈদের পরে ওই টাকা উৎপাদন খাতে নিয়ে যাওয়ার উদ্যোগ থাকা জরুরি।
যাকাত : এফবিসিসিআইয়ের হিসাবে প্রতি বছর যাকাত ও ফিতরা বাবদ খরচ হচ্ছে ৬০ হাজার ৪ শত কোটি টাকা। এ টাকার বড় অংশই চলে যায় গ্রামে। এছাড়া রোজা ও ঈদে নানা কর্মসূচিতে শহরের চাকরিজীবীরা গ্রামে যাচ্ছে। যে কারণে টাকার প্রবাহ বাড়ছে। এছাড়া গ্রামের দরিদ্র মানুষের সহায়তায় শহরের লোকজন সাধ্যানুযায়ী অর্থের জোগান দিচ্ছে।
গ্রামীণ কুটির শিল্প : রোজা ও ঈদকে কেন্দ্র করে গ্রামীণ ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প প্রতিষ্ঠানগুলোতে পণ্য উৎপাদনের ধুম পড়েছে। টাঙ্গাইলের তাঁতের শাড়ির চাহিদা দেশব্যাপী। এ চাহিদা মেটাতে ওই এলাকার তাঁতমালিক ও তাঁতীদের ঘুম নেই। বগুড়া, সিরাজগঞ্জ অঞ্চলের লুঙ্গি ও তাঁতের কাপড়, মুন্সীগঞ্জের রুহিতপুরী তাঁতের কাপড়ের চাহিদা অনেক বেশি। গাজীপুরের কালীগঞ্জের টাওয়ালের চাহিদা ঈদের সময় ব্যাপক। নরসিংদীর বাবুরহাটে ক্রেতার চাপ সামলাতে জেলা প্রশাসন ব্যাপক প্রস্তুতি নিয়েছে। একই অবস্থা নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জে তাঁতের পাইকারি বাজারে। রূপগঞ্জের রূপসীর জামদানি শাড়ি সারা দেশের গণ্ডি ছাড়িয়ে বিদেশেও যাচ্ছে। তাঁতের তৈরি কাপড়ের চাহিদা বাড়ায় ঢাকাকেন্দ্রিক ফ্যাশন হাউস ও বস্ত্র ব্যবসায়ীরা এখন তাঁতীদের কাছ থেকে কাপড় সংগ্রহ করছেন। এসব মিলে গ্রামীণ ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্পগুলোও এখন বেশ জমে উঠেছে।
ব্যাংকিং খাত : বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্যানুসারে ৫৭টি ব্যাংকের সারা দেশে ৯ হাজার শাখা রয়েছে। এর মধ্যে গ্রামীণ শাখা ৫ হাজার ৪৯টি, যা মোট শাখার ৫৭ দশমিক ১১ শতাংশ। অর্থাৎ ব্যাংকিং খাতে শহুরে শাখার চেয়ে গ্রামীণ শাখাই বেশি। ব্যাংকগুলোতে গ্রামের আমানতের পরিমাণ ১ লাখ ৫০ হাজার কোটি টাকা ও ঋণের পরিমাণ ৬০ হাজার কোটি টাকা। রোজা ও ঈদ উপলক্ষে এ টাকার একটি অংশও গ্রামে খরচ হবে। এছাড়া এনজিও ও গ্রামীণ ব্যাংক থেকেও টাকার প্রবাহ বাড়বে।
রেমিটেন্স : রোজায় প্রতি বছরই রেমিটেন্স প্রবাহ বাড়ে। রমজান ও ঈদে বাড়তি খরচের জন্য প্রবাসীরা তাদের স্বজনদের কাছে অতিরিক্ত অর্থ পাঠায়। এর বড় অংশই যায় গ্রামে। বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্যানুসারে গত মাসে ১২৭ কোটি ডলার রেমিটেন্স এসেছে। জুন মাসে রেমিটেন্স আরও বাড়বে। এভাবে প্রতি বছরই ঈদের মাসে রেমিটেন্স বাড়ে।
মৌসুমি ফল বিক্রির টাকা : কৃষি সম্প্রসারণ বিভাগের তথ্য মতে, রাজশাহী ও চাঁপাইনবাবগঞ্জে এ বছর আম উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা সাড়ে ৫ লাখ টন। এর মধ্যে রাজশাহীতে ২ লাখ ৬০ হাজার টন ও চাঁপাইনবাবগঞ্জে ২ লাখ ৮০ হাজার টন। উৎপাদিত আমের মূল্য প্রায় ৩ হাজার কোটি টাকা। এছাড়াও লিচু, কাঁঠাল, জাম, আনারস ও জামরুলসহ সব মৌসুমি ফল বিক্রির টাকাও গ্রামে চলে যাচ্ছে। এতে করে ওইসব অঞ্চলের অর্থনীতি চাঙ্গা হয়ে উঠেছে।
কৃষি ঋণ : চলতি অর্থবছরে সরকারের কৃষি ঋণ বিতরণের লক্ষ্যমাত্রা ১৭ হাজার ৫৫০ কোটি টাকা। জুলাই থেকে মার্চ পর্যন্ত ৯ মাসে বিতরণ করা হয়েছে প্রায় ১৪ হাজার কোটি টাকা, যা মোট ঋণের ৮০ শতাংশ। ফলে জুনের মধ্যে আরও ২০ শতাংশ ঋণ বিতরণ করতে হবে। এ হিসাবে টাকার পরিমাণ দাঁড়ায় ৩ হাজার ৫৫০ কোটি টাকা। আর বাড়তি ঋণ বিতরণের জন্য ব্যাংকগুলো চাপে রয়েছে। সংশ্লিষ্ট সূত্র বলছে, কৃষি ঋণের উল্লেখযোগ্য একটি অংশ চলে যায় ভোক্তার খাতে।
সরকারি বরাদ্দ : চলতি ২০১৬-১৭ অর্থবছরের বাজেটে সামাজিক নিরাপত্তা ও দারিদ্র্যবিমোচন খাতে বরাদ্দ প্রায় ২৭ হাজার কোটি টাকা। এসব অর্থ ব্যয় হচ্ছে, ভিক্ষাবৃত্তির অবসান, মাতৃত্বকালীন ভাতা, বয়স্কভাতা, মুক্তিযোদ্ধা ভাতা, বিধবা ভাতা, এতিম শিশুদের জন্য বরাদ্দ, উপবৃত্তি, একটি বাড়ি একটি খামার, অতি দরিদ্রদের কর্মসংস্থান, ভিজিডি, ভিজিএফ, কাবিখা ইত্যাদি খাতে। এর সুবিধাভোগীর সংখ্যা প্রায় ৩ কোটি। এই টাকার বড় অংশই ব্যয় হয় গ্রামে। ফলে রমজান ও ঈদে গ্রামে এর প্রভাব পড়ে।
মূল্যস্ফীতির ঊর্ধ্বগতি : গত বছরও রমজান ছিল জুন মাসে। ফলে বাড়তি টাকা প্রবাহের কারণে মূল্যস্ফীতি বেড়েছে। মে মাসে মূল্যস্ফীতি ছিল ৫ দশমিক ৪৫ শতাংশ। রমজান ও ঈদের কারণে জুন মাসে মূল্যস্ফীতি বেড়ে ৫ দশমিক ৫৩ শতাংশে উন্নীত হয়। তবে জুলাইয়ে তা কমে ৫ দশমিক ৪০ শতাংশে নেমে আসে। আগস্টে তা আরও কমে ৫ দশমিক ৩৭ শতাংশে নেমে আসে। ধারণা করা হচ্ছে, এ বছরও একই ধারাবাহিকতায় জুনে মূল্যস্ফীতি বাড়বে।

No comments

Powered by Blogger.