যুদ্ধাপরাধী বিচারের রায়ে হতাশার সুর, কারও মুখে হাসি নেই- অমর একুশে গ্রন্থমেলা by মোরসালিন মিজান

বহু জ্বালাও পোড়াও। হুমকি ধামকি। আর তার পর মঙ্গলবারের হরতাল। সঙ্গত কারণেই ভয় পাওয়ার একটি ব্যাপার ছিল। কিন্তু তা হয়নি। অমর একুশে গ্রন্থমেলায় মোটেও প্রভাব পড়েনি হরতালের।
প্রাণের মেলায় ঠিকই যোগ দিয়েছেন লেখক পাঠক প্রকাশকরা। বই দেখেছেন তাঁরা। কিনেছেন। তবে প্রতিদিনের সেই হাসিটি তাঁদের মুখে ছিল না। অধিকাংশ মানুষ কেমন যেন মনমরা হয়েছিলেন। কারণ আর কিছু নয়, শীর্ষ যুদ্ধাপরাধী কাদের মোল্লার বিচারের রায়। একাত্তরের এই ঘাতকের ফাঁসি হবে এটি ছিল খুব সাধারণ একটি প্রত্যাশা। কিন্তু এর পরিবর্তে যাবজ্জীবন কারাদ- দিয়েছে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল। মুক্তচিন্তার সকল মানুষ একে দুঃসংবাদ মানছেন। অমর একুশে গ্রন্থমেলায় আসা মানুষের চোখে মুখেও সে অভিব্যক্তিটি দেখা গেছে। প্রায় সকলেই এ রায়ে অসন্তুষ্ট। যারপর নাই হতাশ।
এ প্রসঙ্গে কথা বলতে গিয়ে দারুণ আবেগাপ্লুত হয়ে পড়েন ‘মুক্তিযুদ্ধ নৌ কমান্ডো ও নাবিকদের জীবনকোষ’ গ্রন্থের লেখক মোঃ খলিলুর রহমান। একাত্তরে পাকবাহিনীর বিরুদ্ধে দারুণ প্রতিরোধ গড়ে তুলেছিলেন এই মুক্তিযোদ্ধা। রায়ের প্রতিক্রিয়ায় জনকণ্ঠকে তিনি বলেন, আমরা এমন একটি রায়ের জন্য দীর্ঘদিন আন্দোলন করিনি। এ রায়ের বিরুদ্ধে আপীল করার জোর আহ্বান জানিয়ে তিনি বলেন, একাত্তরে কাদের মোল্লারা যে অপরাধ করেছিল তার সর্বোচ্চ শাস্তি চাই আমরা। তা না হলে অপরাধটি ছোট বলে মনে হতে পারে। প্রতিদিনের মতো এদিনও মেলায় এসেছিলেন ছড়াকার লুৎফর রহমান রিটন। তিনি জানান, রায়ের পর পরই তিনি একটি ছড়া লিখেছেন। ‘শাবাশ ট্রাইব্যুনাল! শাবাশ বিচারপতি!!’ শিরোনামে লেখা ছড়াটি এ রকম রেপ করেছ? ভয় নাই!/খুব অপরাধ হয় নাই।/খুন করেছ? আচ্ছা।/তুমিই বাঘের বাচ্চা!/তোমার বিচার করব/ তোমায় জেলে ভরব!/আদালতের রায়/তোমার পক্ষে যায়!/আমজনতা যতই চেঁচাও নইতো পেরেশান/এই বিচারের মানটা হলো আন্তর্জাতিক মান!/তিনশতাধিক খুন করেছ? তাতে কী যায় আসে!/যুদ্ধাপরাধ ট্রাইব্যুনালে ঘাতক-খুনী হাসে!/তিরিশ লক্ষ শহীদ কাঁদলে কী আর এমন ক্ষতি?/শাবাশ শাবাশ ট্রাইব্যুনাল আর শাবাশ বিচারপতি! বলা বাহুল্য, শুধু ছড়াকারের নয়, মানবতাবিরোধী বিচারের অপেক্ষায় থাকা কোটি বাঙালীর মনের কথা ফুটে ওঠেছে এ রচনায়। ছড়াকার আলম তালুকদার বিচারকের আসনেও বসেছেন এক সময়। সে অভিজ্ঞতার কথা তুলে ধরে জনকণ্ঠকে তিনি বলেন, এ রায়ে আমি এবং আমরা ক্ষুব্ধ। যে সাজা প্রত্যাশিত ছিল সেটি আমরা পাইনি। তিনি বলেন, বিচারকতো মানুষ। পত্রপত্রিকা পড়েন। টিভি দেখেন। আরও নানা কাজ কর্মে থাকেন। এর পরও তারা কোন কিছু দ্বারা প্রভাবিত হন না। আবার যদি হন তাতেও অবাক হওয়ার থাকবে না। রায় নিয়ে প্রকাশকদের মধ্যেও দিনভর চলেছে আলোচনা। সমালোচনা। এ প্রসঙ্গে আগামী প্রকাশনীর স্বত্বাধিকারী ওসমান গনি জনকণ্ঠকে বলেন, আমরা প্রতিবছর অসংখ্য বই প্রকাশ করি। পাঠক সেসব বই টাকা দিয়ে কেনেন। পড়েন। সংরক্ষণ করেন। কেন? কারণ, বই সত্য বলে। অসংখ্য বইয়ের পাতায় পাতায় লেখা আছে বাঙালীর মুক্তিসংগ্রামের ইতিহাস। সে ইতিহাস তো বলে না, কাদের মোল্লা লঘু অপরাধ করেছে। তাহলে কেন এমন একটি রায়? অমর একুশের গ্রন্থমেলাকে বাঙালীর জাগরণের মেলা হিসেবে বর্ণনা করে তিনি বলেন, এমন একটি সময়ে যে রায় ঘোষিত হলো তা সকলের মতো আমাদেরও হতাশ করেছে। পঞ্চম দিন মেলায় এসেছিলেন সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোটের সহসভাপতি ও কলামিস্ট গোলাম কুদ্দুছ। যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের দাবিতে বহুদিন রাজপথে আছেন তাঁরা। তাই তাঁকে অনেকেই ঘিরে ধরছিলেন। জানতে চাইছিলেন, কী হলো আসলে বিষয়টা? খুব কিছু তাদের বলতে পারছিলেন না তিনি। পরে জনকণ্ঠকে তিনি বলেন, এমন রায়ে সন্তোষ প্রকাশের কোন সুযোগ নেই। আমরা যারপর নাই হতাশ। এর পর অন্য একটি বিষয়ের অবতারণা করে তিনি বলেন, বিচারের রায়ে ক্ষুব্ধ হয়ে বহু মানুষ রাস্তায় নেমে এসেছেন। কাদের মোল্লার মতো ঘৃণ্য অপরাধীর যাবজ্জীবন কারাদ- তারা মেনে নিতে পারছেন না। এই দৃশ্যই আবারও স্মরণ করিয়ে দেয়, যুদ্ধাপরাধীদের বিচার চায় মানুষ। সর্বোচ্চ শাস্তি কামনা করে। এটিও অনেক বড় ব্যাপার।
মেলায় আসা সাধারণ মানুষের সঙ্গে কথা বলেও জানা যায় এমন নানা প্রতিক্রিয়া। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এনথ্রপলজি বিভাগের শিক্ষার্থী তিথি একজন খেতাবপ্রাপ্ত মুক্তিযোদ্ধার সন্তানও। রায় প্রসঙ্গে তিনি বলেন, যাদের বিচার চলছে তাদের সবাই শীর্ষ যুদ্ধাপরাধী। এটা কাওকে বলে বোঝানোর দরকার পড়ে না। যারা মুক্তিযুদ্ধটা জানে তারা কাদের মোল্লাদেরও জানেন। এর পরও এমন লঘুদ- আমাদের হতাশ করেছে। এর পেছনে কিছু আছে কীনা তাও সতর্কতার সঙ্গে খেয়াল করা দরকার বলে মত দেন তিনি। এভাবে প্রায় সকলেই অভিন্ন প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেন।
৭৫টি নতুন বই ॥ পঞ্চম দিনে মঙ্গলবার অমর একুশে গ্রন্থমেলায় আসে ৭৫টি নতুন বই। মোড়ক উন্মোচন করা হয় ৬টি বইয়ের।
নির্বাচিত বই ॥ আগামী থেকে এসেছে মিলি সুলতানার বই ‘যুদ্ধ শিশু’। একই প্রকাশনী এনেছে মিনার মনসুরের বই ‘কবি ও কবিতার সংগ্রাম’। এ্যাডর্ন থেকে এসেছে শিরীন আখতারের বই ‘নারী রাজনীতি ও রাষ্ট্র’। একই প্রকাশনী থেকে মেলায় এসেছে জয়শ্রী সরকারের ‘প্রান্তবাসী হরিজনদের কথা’ ও এম মুফাকখারুল ইসলামের ‘এন ইকোনমিক হিস্টরি অব বেঙ্গল’ বইটি। শিশুদের জন্য চমৎকার ছড়া লিখেছেন আলম তালুকদার। তাঁর ‘মজার ১০০ ছড়া’ বইটিও প্রকাশ করেছে এ্যাডর্ন।
মেলামঞ্চের আয়োজন ॥ মেলার মূল মঞ্চে মঙ্গলবার অনুষ্ঠিত হয় ‘স্বারস্বত ড. মুহম্মদ এনামুল হকের সারাৎসার’ শীর্ষক সেমিনার। সেমিনারে প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন ভাষাবিজ্ঞানী মহাম্মদ দানীউল হক। আলোচনা করেন অধ্যাপক মনসুর মুসা এবং রহমান হাবিব। সভাপতিত্ব করেন বাংলা একাডেমীর মহাপরিচালক শামসুজ্জামান খান।
প্রাবন্ধিক বলেন, ড. মুহম্মদ এনামুল হক ছিলেন বহুদর্শী প-িত। বহুভাষাবিদ্যা, সমাজ-সাহিত্য-সংস্কৃতি ও ধর্মতত্ত্ব বিষয়ে গভীর জ্ঞান তাঁকে অনন্যতা দান করেছিল। বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের অনুদ্ঘাটিত অধ্যায়সমূহ তথ্য ও বিশ্লেষণে তিনি উন্মোচিত করেছেন বিরল দক্ষতায়। ভাষার শুধু তাত্ত্বিক দিক নয়, ব্যবহারিক দিকও তাঁর আগ্রহ ও আবিষ্কারের বিষয় ছিল। ভাষা-আন্দোলনের অন্যতম তাত্ত্বিক পুরোধা ও নির্ভীক প্রবক্তা ছিলেন তিনি। তাঁর অধ্যবসায় ও শ্রম উত্তরকালের গবেষকদের জন্য দৃষ্টান্তস্থানীয়। অন্য বক্তারা বলেন, ব্যাকরণকে ড. মুহম্মদ এনামুল হক ভাষার আন্তঃশৃঙ্খলা জ্ঞান করতেন। বাংলা ভাষার মৌলিকতায় বিশ্বাসী ছিলেন তিনি। আরাকান রাজসভায় বাংলা সাহিত্যের ইতিহাস উদ্ধারের কৃতিত্ব যেমন তাঁর তেমনি বঙ্গে সুফি প্রভাবের আদ্যোপান্ত উদ্ঘাটন করেছেন গবেষকের নিষ্ঠায়। ভাষা ও সাহিত্যের অনুসন্ধিৎসু গবেষণায় ধারায় তাঁকে যথার্থই আবদুল করিম সাহিত্যবিশারদের মানসপুত্র বলা চলে। সভাপতির বক্তব্যে শামসুজ্জামান খান বলেন, ড. মুহম্মদ এনামুল হকের প্রশাসনিক কৃতিত্বও সামান্য নয়। বাংলা একাডেমীর প্রথম পরিচালক হিসেবে এ জাতীয় প্রতিষ্ঠানের গবেষণামূলক চারিত্র্য নির্ধারণে তাঁর দূরদর্শী ভূমিকা স্মরণীয় হয়ে থাকবে। এ ছাড়া একাডেমীকে সাংগঠনিক ভিত্তি দানেও তাঁর অবদান অমূল্য। এই অসাধারণ প-িত ও গবেষকের জন্মের ১১০তম বার্ষিকীতে তিনি নতুন মূল্যায়নের দাবি রাখেন।
সন্ধ্যায় সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে আবৃত্তি পরিবেশন করবেন আবৃত্তিশিল্পী আয়েশা হক শিমু। সঙ্গীত পরিবেশন করেন কণ্ঠশিল্পী আকরামুল ইসলাম, আবুবকর সিদ্দিক, ইন্দ্রমোহন রাজবংশী, দিলরুবা খান, মীনা বড়ুয়া, রহিমা খাতুন, বিমান চন্দ্র বিশ্বাস ও শ্যামল পাল। যন্ত্রাণুষঙ্গে ছিলেন গৌতম মজুমদার (তবলা), হাসান আলী (বাঁশি), আবু কামাল (বেহালা), শিবনাথ শিবু (ঢোল) এবং মিনাল বাউল (মন্দিরা)।

No comments

Powered by Blogger.