তামার জন্য ট্রান্সফর্মার চুরি অপ্রতিরোধ্য চোর চক্র!- প্রস্তুতকারক অনেক প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে গুরুতর অভিযোগ by রশিদ মামুন

বেসরকারী গ্রাহকদের চাহিদার যোগান আর মূল্যবান কপার (তামা) বিক্রির জন্য চোরচক্র সারাদেশে ট্রান্সফর্মার চুরি করছে। চোর চক্রের কেউ কেউ কখনও কখনও গ্রেফতার হলেও এদের নির্মূল করা সম্ভব হচ্ছে না।
কোন কোন বেসরকারী ট্রান্সফর্মার প্রস্তুতকারক প্রতিষ্ঠান পুরনো ঢাকার এবং ধোলাইখাল জিঞ্জিরা একটি চক্র সারাদেশে ট্রান্সফর্মার চুরির সঙ্গে সম্পৃক্ত বলে জানা গেছে। রবিবার কুমিল্লার চৌদ্দগ্রাম এলাকা থেকে চুরি যাওয়া ট্রান্সফর্মার উদ্ধার এবং চোর ধরতে গিয়ে এ ধরনের চক্রের হাতে নিহত হন পুলিশ কর্মকর্তা এসআই শরিফুল ইসলাম। পুলিশ কর্মকর্তার মৃত্যুর পর ট্রান্সফর্মার চুরির বিষয়টি আবারও আলোচনায় এসেছে।
বিদ্যুত বিতরণ কোম্পানি ট্রান্সফর্মার চুরির যে হিসাব দিয়েছে তাতে দেখা যায় ২০০২ সাল থেকে এখন পর্যন্ত ৩০ হাজারের উপরে ট্রান্সফর্মার চুরি হয়েছে। এর মধ্যে পল্লী বিদ্যুতায়ন বোর্ড (আরইবি), ঢাকা পাওয়ার ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানি (ডিপিডিসি) এবং বাংলাদেশ পাওয়ার ডেভেলপমেন্ট বোর্ডের (পিডিবি) ট্রান্সফর্মার চুরির ঘটনা বেশি। তবে আরইবি বলছে এ পর্যন্ত এককভাবে ট্রান্সফর্মার তাদের চুরি হয়েছে ৩০ হাজারের মতো।
সেচ মৌসুমে আরইবি এলাকায় ট্রান্সফর্মার চুরির ঘটনা সব থেকে বেশি ঘটে থাকে। আগে জনবহুল এলাকায় চোরচক্র ট্রান্সফর্মার চুরি না করলেও সম্প্রতি এই চক্র এতটাই বেপরোয়া হয়ে উঠেছে যে মানুষের সামনে থেকেই ট্রান্সফর্মার খুলে নিয়ে যাচ্ছে। এরা বিদ্যুত অফিসের লোকের ছদ্মবেশে ট্রান্সফর্মার চুরি করছে। বিদ্যুত অফিসের লোকের মতোই ওয়াকিটকি, গাড়ি, মই নিয়ে এরা মানুষের সামনে থেকে ট্রান্সফর্মার খুলে নিয়ে যাচ্ছে। সাধারণ মানুষ দীর্ঘ সময় বিদ্যুত বন্ধ থাকার পর স্থানীয় বিদ্যুত অফিসে যোগাযোগ করলে তারা এসে ট্রান্সফর্মার চুরির বিষয়টি নিশ্চিত করছে। সীমান্ত এলাকায় ট্রান্সফরমার চুরির হার বেশি। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, তুলনামূলকভাবে প্রতিবেশী রাষ্ট্র ভারতে তামার দাম বেশি। এ কারণে ট্রান্সফর্মার চুরির পর তামা পাচার করা হয় ভারতে। একবার ট্রান্সফর্মার চুরি হলে আওতাভুক্ত গ্রাহকদের প্রতিস্থাপন না করা পর্যন্ত বিদ্যুত বিচ্ছিন্ন থাকতে হচ্ছে।
সূত্র বলছে বিদ্যুত বিতরণ কোম্পানিগুলো নিজস্ব ভাবে ট্রান্সফর্মার উৎপাদন এবং মেরামতের জন্য কারখানা স্থাপন করলেও তা প্রয়োজনের তুলনায় খুবই অপ্রতুল। বিতরণ কোম্পানিগুলো অনেক সময় টেন্ডারের মাধ্যমে বেসরকারী এসব প্রতিষ্ঠানের কাছ থেকে ট্রান্সফর্মার কিনে থাকে। এ ছাড়া এখন খোলা বাজারেও ট্রান্সফর্মার কিনতে পাওয়া যায়। তবে বিদ্যুত বিভাগের কর্মকর্তারা বলছেন, যেহেতু এক সঙ্গে তারা অনেক ট্রান্সফর্মার কেনে তাই চুরি যাওয়া ট্রান্সফর্মার দিয়ে এ চাহিদা তারা পূরণ করতে পারবে না। তবে প্রস্তুতকারক প্রতিষ্ঠানগুলো ট্রান্সফর্মারের মূল উপাদান কপার কিনছে কিনা তা খতিয়ে দেখা প্রয়োজন বলে মনে করেন তারা।
বিদ্যুতের বড় গ্রাহকদের নিজস্ব ট্রান্সফর্মার স্থাপন করতে হয়। রাজধানীর বহুতল ভবনসহ বিভিন্ন শিল্প কারখানায় নিজস্বভ ট্রান্সফর্মার স্থাপন করে বিদ্যুত লাইন দিয়ে থাকে বিতরণ কোম্পানিগুলো। কোন কোন ক্ষেত্রে এসব গ্রাহকই চোরাই ট্রান্সফর্মারের ক্রেতা। বাজারে আকার ভেদে নতুন ট্রান্সফর্মারের দাম ৫০ হাজার থেকে চার লাখ টাকা পর্যন্ত হলেও চোরাই ট্রান্সফর্মার অর্ধেক দামে পাওয়া যায়।
অভিযোগ রয়েছে বেসরকারী ট্রান্সফর্মার প্রস্তুতকারী এবং কারখানার সঙ্গে চোর চক্রের যোগাযোগ রয়েছে। ট্রান্সফর্মার চুরি করে এই চোরচক্র এদের কাছে ট্রান্সফর্মার বিক্রি করে। ট্রান্সফর্মারের ওপরের অংশ পরিবর্তন করে আবার তা বাজারে ছেড়ে দেয় এসব কোম্পানি। এ ছাড়া ওয়েল্ডিংয়ের জন্য যে মেশিন ব্যবহৃত হয় তা মূলত ট্রান্সফর্মারের ভেতরের অংশ। কোনভাবে চোরাই ট্রান্সফর্মার বিক্রি করা সম্ভব না হলে এর ভেতরের কপার গলিয়ে বিক্রি করা হয়। একটি ট্রান্সফারের মধ্যে সাধারণত ৩০ থেকে ৪০ কেজি কপার থাকে। শুধু এই কপার বিক্রি করলেও ৩০ থেকে ৪০ হাজার টাকা পাওয়া যায়।
একটি সূত্র জানায়, কোম্পানি ছাড়াও রাজধানীর পুরানা ঢাকায় ভাঙ্গাড়ির দোকানে তামা বিক্রি করে চোরেরা। কপারের দাম কেজিপ্রতি ৯৫০ টাকা হলেও এসব জায়গায় ৫০০ টাকার নিচে পাওয়া যায়। এই কপার মূলত কেবল ফ্যাক্টরি এবং ট্রান্সফর্মার প্রস্তুতকারী প্রতিষ্ঠানের প্রধান কাঁচামাল। কপার আমদানির পাশাপাশি চোরাই তামা কিনেও প্রতিষ্ঠানগুলো চাহিদা পূরণ করে। আরইবি সূত্র বলছে, তাদের চুরি যাওয়া বেশিরভাগ ট্রান্সফর্মারের ভেতর থেকে কপার নিয়ে কাঠামো ফেলে দিয়ে যায় চোররা।
একটি ট্রান্সফর্মারের ওজন গড়ে এক হাজার ২৫ কেজি। এটি লম্বায় প্রায় তিন/চার ফুট। সরবরাহ তার থেকে গ্রাহকদের উপযোগী বিদ্যুত পৌঁছে দিতে এই ট্রান্সফর্মার কাজ করে। একটি ট্রান্সফর্মার একাধিক গ্রাহককে বিদ্যুত সুবিধা দিয়ে থাকে। এত বড় এবং ওজনের একটি জিনিস একের পর এক চুরি হয়ে যাচ্ছে। কিন্তু সংশ্লিষ্টরা ধরতেই পারছেন না। কোন কোন ক্ষেত্রে চোর ধরা পড়লেও আদালত থেকে জামিন নিয়ে আবারও একই কাজ করছে।
ট্রান্সফর্মার চুরি হলে প্রতিস্থাপনের জন্য গ্রাহকদের দীর্ঘ সময় অপেক্ষা করতে হয়। টাকা দিলেও অনেক সময় তড়িঘড়ি ট্রান্সফর্মার পাওয়া যায় না। বিদ্যুত উন্নয়ন বোর্ড (পিডিবি), ডিপিডিসি, ডেসকো নিজস্বভাবে ট্রান্সফর্মার স্থাপন করে দেয়। আরইবির ক্ষেত্রে প্রথম বার চুরি হলে ট্রান্সফর্মারের আওতায় থাকা গ্রাহকদের অর্ধেক মূল্য পরিশোধ করতে হয়। দ্বিতীয়বার চুরি হলে পুরো মূল্য গ্রাহককেই পরিশোধ করতে হয়।
ডিপিডিসির ব্যবস্থাপক (অপারেশন) শেখ মুশতাক আলী এ প্রসঙ্গে জনকণ্ঠকে বলেন, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ট্রান্সফর্মার চোর ধরতে খুব বেশি সাহায্য করে না তাদের। ট্রান্সফর্মার চুরির পর তারা থানায় একটা সাধারণ ডায়েরি করে। অজ্ঞাতনামা ব্যক্তিদের নামে ডায়েরি করায় পুলিশ আর বিষয়টি খতিয়ে দেখে না। তবে স্থানীয় জনগণকে সচেতন করার পাশাপাশি ট্রান্সফর্মার ওয়েল্ডিং করে দেয়া হচ্ছে। কিন্তু ওয়েল্ডিং কেটে পর্যন্ত চোররা ট্রান্সফর্মার নিয়ে যাচ্ছে।
পিডিবির একজন কর্মকর্তা বলেন, আগে শুধু কপারের জন্য ট্রান্সফর্মার চুরি হলেও এখন ট্রান্সফর্মারের স্থানীর বাজার তৈরি হয়েছে। বড় গ্রাহকদের বিতরণ কোম্পানিগুলো ট্রান্সফর্মার দেয় না। তাদের নিজস্বভাবে ট্রান্সফর্মার স্থাপন করতে হয়। ফলে চুরি যাওয়া ট্রান্সফর্মার বিক্রির কোন সমস্যা না থাকায় চুরির সঙ্গে অনেক লোক জড়িয়ে গেছে। তিনি বলেন, যেহেতু চুরি থেকে বিক্রি পর্যন্ত একটি চক্র কাজ করে তাই শুধু চোর ধরলেই হবে না যারা এই কাজ করছে তাদের সকলকে আইনের আওতায় আনতে হবে।
জানতে চাইলে আরইবির প্রধান প্রকৌশলী (প্লানিং এ্যান্ড অপারেশন) নজরুল ইসলাম বলেন, চোর চক্রের মূল লক্ষ্য থাকে কপার বিক্রি করা। কারণ একটি বড় ট্রান্সফর্মারের মধ্যে অন্তত ৩০ হাজার টাকার কপার থাকে। তিনি বলেন, রাজধানীর আশপাশেই চোরাই কপারের গোপন মার্কেট রয়েছে। ট্রান্সফর্মার চুরি প্রতিরোধে স্থানীয় জনগণকে সচেতন করা ছাড়াও ওয়েল্ডিং করে এগুলো খাম্বার সঙ্গে আটকে দেয়া হচ্ছে বলে জানান তিনি।

No comments

Powered by Blogger.