মতামত-হরতাল এবং দুটি খণ্ড দৃশ্য by রোকেয়া কবীর

মরা আমাদের শৈশব-কৈশোরে খেলাধুলায় মগ্ন থাকার অনেক সুযোগ পেয়েছি। কি গ্রাম কি শহর, উভয় ক্ষেত্রেই এখন খেলাধুলার সুযোগ অনেক কমে গেছে। গ্রামে যেমন এখন আর গোল্লাছুট, দাড়িয়াবান্দা, হাডুডু, বৌছি, ডাংগুলি, ক্যারামবোর্ড, লুডু, জাম্বুরা দিয়ে ফুটবল খেলা নেই, নেই শহরেও। পাশাপাশি কয়েকটা মহল্লাজুড়ে শহরে একটিও খেলার মাঠ নেই। যেখানে আছে, তারও নেই ব্যবহার উপযোগিতা হরতালের পক্ষে বা বিপক্ষে কিছু বলার জন্য এই


লেখা নয়, কথার সূত্রপাত যদিও হরতাল থেকেই। হরতালে অফিসে না গিয়ে কাজ বন্ধ করে আমি ঘরে বসে থাকতে পারি না। তবে হরতালে গাড়ি নিয়ে পথে বেরোনো ঝুঁকিপূর্ণ বলে এ দিনগুলোতে আমি সাধারণত সিএনজিচালিত অটোরিকশার সেবা নিয়ে থাকি। ২২ সেপ্টেম্বরের হরতালের দিনও তা-ই করতে হলো। অটোরিকশা মিটারে চলবে এ রকম আশা এখন সম্পূর্ণই দুরাশা। এ জন্য জিজ্ঞেস করতে হলো ভাড়ার কথা।
ড্রাইভার ১২০ টাকা হাঁকাল। বনানী থেকে মোহাম্মদপুর যেতে এই ভাড়া হয়তো খুব বেশি না, যদিও মিটারে গেলে এর চেয়ে কমই লাগার কথা। তবু উঠে বসলাম, যেতে তো হবে।
বললাম, 'আজকে তো রাস্তা ফাঁকা, জ্যাম নেই, সে ক্ষেত্রে ভাড়া তো আরও কম হওয়া উচিত।'
ড্রাইভার বলল, 'আপা, হরতালের কথা বলে ভাড়া কম দিতে চাইতেছেন। কিন্তু আপনি হয়তো জানেন না যে, এই গাড়িটা রাস্তায় নামাইতে সাড়ে নয় লাখ টাকা লাগছে। মাত্র চাইর দিন হইল গাড়ির বয়স। এত টাকা দিয়া গাড়ি কিনতে হয় বইল্যাই মালিক আমদানিও বেশি নেয়। সকাল ৬টা থেকে সন্ধ্যা ৬টার জন্য আমদানি সাতশ' টাকা, রাতের জন্য সাড়ে তিনশ' থেকে চারশ'। এর কম ভাড়ায় আমগোর পুষাবো কেমনে?' অকাট্য যুক্তি তার।
কৌতূহল জাগল অটোরিকশার দাম নিয়ে। বললাম, 'এত ছোট গাড়ি রাস্তায় নামাতে সাড়ে নয় লাখ টাকা লাগার তো কথা না!'
ড্রাইভার জানাল ঘুষের কথা। বলল, 'আপনি তো জানেন, বর্তমানে সিএনজির লাইসেন্স দেওয়া বন্ধ। সে জন্য এই লাইসেন্সটা পাইতে অনেক টাকা লাগছে। গাড়ির ইঞ্জিন-বডি-নেট এইসব লাগাইতে সোয়া পাঁচ লাখের মতো লাগলেও বাকি টাকা গেছে নানা ঘাটে ঘুষ দিতে দিতে। এই টাকাটা তো তার উঠানো লাগবো।'
তার কথাবার্তা ঘুরেফিরে আবার হরতালের দিকে এলে বললাম, 'হরতালটা কেন হচ্ছে?'
সরাসরি জবাবে না গিয়ে সে বলল, 'পথঘাট স্বাভাবিক, গাড়ি-ঘোড়া কম, গণ্ডগোল দেখলাম না কোনোখানে। তবে ওইদিন জামাত যে কাজটা করল, সেইটা একদম ঠিক করে নাই। পুলিশ চাইলে আগেই ঠেকাইতে পারত। কিন্তু তারা সেইটা করে নাই। আগে মাইর খাইছে, পরে মাইর দিছে। এতে অনেক ক্ষতি হইছে।'
বললাম, 'জামায়াত যে ইসলামের কথা বলে, এই ব্যাপারে আপনার মত কী?'
প্রশ্ন শুনে উসকে উঠল সে, 'আরে রাখেন জামাত। এরা সব শয়তানের চ্যালা। আমার এলাকার মসজিদের এক জামাতি ইমাম, মুখে মিষ্টি মিষ্টি কথা কয়, মনে হয় ফেরেশতা, কিন্তু মসজিদের লাইট-ফ্যান সব বিক্রি কইরা খাইয়া ফেলে। গত আওয়ামী লীগ সরকার মসজিদে কিছু টিন দিছিল। সে ওই টিন বাড়িতে খাটাইয়া মসজিদে লাগাইছে খারাপ টিন। এলাকার টাকা-পয়সাওয়ালা লোকজন শখ কইরা, মানত কইরা মুসলি্লদের সুবিধার জন্য লাইট-ফ্যান-মাইক দেয়, কিন্তু সে বিক্রি কইরা দেয়। মাঝে মাঝে লোকজন নামাজের শেষে মসজিদের ব্যাপারে প্রশ্ন তুলবার চেষ্টা করলে ইমাম সাব লাঠিয়াল সাঙ্গোপাঙ্গ ডাকে।' সে আরও যোগ করে, 'জামাত নামাজ পড়া, ধর্মপালন করা নিয়া বড় বড় কথা কয়, কিন্তু এরা শয়তানের হাড্ডি। চুরি, ঘুষ খাওয়া থেকে শুরু করে সবই করে।'
জানতে চাইলাম, 'বাড়ি কোথায় আপনার?'
'ফরিদপুর।' তারপর সে হেসে ফেলে এবং বলে, 'ফরিদপুর হইলে কী হইবো, আমার এলাকা কিন্তু বিএনপির ঘাঁটি। কামাল সাব খুব ভালা মানুষ। কিন্তু তার পার্টি বিএনপি ভালা না। সে গরিব লোকদের সাহায্য-সহযোগিতা করে, বর্ষায় জনসাধারণের চলাচলের জন্য ট্রলার দেয়।'
জিজ্ঞেস করলাম, 'আওয়ামী লীগ দেশ চালাচ্ছে কেমন?'
'না, চালাইতে পারতেছে না', সে বলল। 'বিশেষ কইরা পুলিশ প্রশাসন একদমই চালাইতে পারতেছে না।' এই মতের সঙ্গে সে ব্যাখ্যাও যুক্ত করল। বলল, 'কেমনে পারবো, সরকার আওয়ামী লীগ হইলেও পুলিশ, সরকারি অফিসার অনেকেই বিএনপি-জামাতের। আমার এলাকার থানায় যত পুলিশ অফিসার একের পর এক বদলি হইয়া আইছে, তারা সবাই বিএনপির। এরা সরকারের কথা মানে না। তার চাইতে সরকারকে ডোবানোর জন্য কাজ করে।' সে আরও বলল, 'বিএনপির হাতে অনেক টাকা। ধরেন, আমার এই গাড়ির মালিকের কথাই। সে বিএনপির ৩০ জনরে চাকরি দিছে। প্রত্যেকের কাছ থেইকা নিছে ২ লাখ টাকা। আওয়ামী লীগ দেশ চালাবো কেমনে? পারবো না।'
'র‌্যাব বিষয়ে আপনার কী মত? সাধারণ মানুষ কি র‌্যাব চায়?' আমি জানতে চাইলাম।
তার স্পষ্ট মত হলো, 'র‌্যাব দরকার আছে। র‌্যাব আছে বইলাই চাঁদাবাজগোর উৎপাত কম। এখন কম চাঁদা দিতে অয়। তবে মুশকিল হইল নকল র‌্যাব। এরা ঘুষ নিয়া মানুষ মাইরা দেয়। এরাই সরকাররে ডুবাইতাছে।'
জ্যাম-জটহীন রাস্তায় আলাপে আলাপে অল্পক্ষণেই আমার গন্তব্য বাবর রোডে পেঁৗছে গেছি আমরা। নামার আগে তার প্রতি আমার সর্বশেষ প্রশ্ন করলাম, 'আগামীবার কারা নির্বাচিত হবে?'
'এইটা আল্লায় জানে', সে বলল।
কিছুদিন আগে একদিনের জন্য চট্টগ্রাম যেতে হয়েছিল। এয়ারপোর্ট থেকে শহরের দিকে যাচ্ছি। সিগন্যালে গাড়ি থেমেছে। হঠাৎ চোখ গেল সড়কদ্বীপের দিকে। দুটি ছোট বালককে দেখা গেল পালা করে একটা পলিথিনের প্যাকেট ফুলাচ্ছে।
'কী করে ওরা, খেলছে নাকি!' ওদের দিকে তাকিয়ে আমি আনমনেই উচ্চারণ করে ফেললাম।
গাড়িতে থাকা কলিগ ফেরদৌস বলল, 'ওরা ড্রাগ নিচ্ছে।'
আমি বিস্ময় নিয়ে জিজ্ঞেস করলাম, 'এরা ড্রাগ নেওয়ার পয়সা পায় কোত্থেকে?'
ফেরদৌস জানায়, 'এটা করতে খুবই কম পয়সা লাগে আপা। জুতার সোল লাগাতে যে সলিউশন ব্যবহার করে, ওটা পোড়ালে যে ধোঁয়া তৈরি হয়, এরা ওটাই ইনহেল করছে।'
কথায় কথায় জানা গেল, কাঠমিস্ত্রিরা তাদের কাজে যে সস্তা স্পিরিট ব্যবহার করে ওটাও নাকি নেশাদ্রব্য হিসেবে ব্যবহার করা হয় আজকাল। ওই স্পিরিটটা ঝাঁকালে যে গন্ধ বেরোয়, সেটাই নাকি নেশার কাজ করে।
দরিদ্র জনগোষ্ঠী স্বাস্থ্যের পক্ষে হানিকর দ্রব্য নেশা হিসেবে গ্রহণ করে যেভাবে ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে, সেসব নিয়ে আমাদের বেশি করে কথা বলা দরকার। কিন্তু এ ব্যাপারে মিডিয়াকে প্রায়ই নীরব থাকতে দেখি।
এমন কেন হয়? মিডিয়া কি কেবল বড়লোকদের স্বাস্থ্যভাবনায় মগ্ন থাকবে? নিজেই নিজেকে প্রশ্ন করলাম। দরিদ্র শ্রমজীবী মানুষ বা যারা আগামী সময়ে শ্রম দেবে তারা ক্ষতিকর নেশায় আচ্ছন্ন হয়ে গেলে অর্থনীতির চাকাটাই তো অচল হয়ে যাবে। এদের রক্ষার জন্য কার্যকর উদ্যোগ কই?
জবাবটাও নিজেই খুঁজতে চাইলাম। এদের এই নেশার জগতে আসার বড় একটা কারণ বিনোদনহীনতা ও খেলাধুলার সুযোগ না থাকা। একে তো দারিদ্র্যজনিত হতাশা, তার ওপর হতাশা কাটানোর জন্য দরকারি বিনোদন ও খেলাধুলার সুযোগের সংকট কাটানো না গেলে এ অবস্থার পরিবর্তন করা যাবে না।
আমরা আমাদের শৈশব-কৈশোরে খেলাধুলায় মগ্ন থাকার অনেক সুযোগ পেয়েছি। কি গ্রাম কি শহর, উভয় ক্ষেত্রেই এখন খেলাধুলার সুযোগ অনেক কমে গেছে। গ্রামে যেমন এখন আর গোল্লাছুট, দাড়িয়াবান্দা, হাডুডু, বৌছি, ডাংগুলি, ক্যারামবোর্ড, লুডু, জাম্বুরা দিয়ে ফুটবল খেলা নেই, নেই শহরেও। পাশাপাশি কয়েকটা মহল্লাজুড়ে শহরে একটিও খেলার মাঠ নেই। যেখানে আছে, তারও নেই ব্যবহার উপযোগিতা। এ রকম অবস্থায় আমাদের ছেলেমেয়েরা স্কুল থেকে ফিরে করবেটা কী? বাধ্য হয়ে ওরা হয় কম্পিউটার গেমে ডুবে থাকে, নয় বাইরে গিয়ে গাঁজা-ফেনসিডিলের আড্ডায় মেশে।
এদের বাইরে শহরে যারা ঘরহীন ছিন্নমূল, তাদের ক্ষেত্রে বিনোদন বা খেলাধুলার সুযোগ প্রায় অসম্ভব। খেলার মাঠ থাকলেও ওদের সেখানে কমই প্রবেশাধিকার থাকে। এরা প্রায়ই মা-বাবার সন্ধান জানে না অথবা জানলেও তাদের থেকে আলাদা থাকে বা থাকতে বাধ্য হয়। এদের যে ধরনের হতাশাজনক অবস্থার ভেতর দিয়ে যেতে হয়, সেখানে জুতার আঠা দিয়ে ইনহেল করাকে খুব স্বাভাবিকই মনে হয়।
ভাবি, এদের রক্ষায় সরকার ও আমাদের অনেক কিছুই করবার আছে।

রোকেয়া কবীর : মুক্তিযোদ্ধা ও নির্বাহী পরিচালক, বাংলাদেশ নারী প্রগতি সংঘ

No comments

Powered by Blogger.