আবদুর রাজ্জাক আর নেই

হান মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম সংগঠক, সাবেক মন্ত্রী, আওয়ামী লীগের নেতা আবদুর রাজ্জাক আর নেই। লন্ডনের কিংস কলেজ হাসপাতালে তিনি শেষনিঃশ্বাস ত্যাগ করেন (ইন্না লিল্লাহি...রাজিউন)। আবদুর রাজ্জাককে তিন দিন ধরে ওই হাসপাতালে কৃত্রিম শ্বাসযন্ত্র লাগিয়ে রাখা হয়েছিল। গতকাল শুক্রবার বাংলাদেশ সময় রাত নয়টা ৫০ মিনিটে চিকিৎসকেরা তাঁকে মৃত ঘোষণা করেন। এর আগে রাত নয়টা ১০ মিনিটে তাঁর কৃত্রিম শ্বাসযন্ত্র খুলে ফেলা হয়।


আবদুর রাজ্জাকের যকৃৎ (লিভার) ও বৃক্ক (কিডনি) অকেজো হয়ে পড়েছিল। তিন মাস ধরে তিনি লন্ডনে চিকিৎসাধীন ছিলেন। এর মধ্যে তিনি এক মাস ছিলেন লন্ডন ব্রিজ হাসপাতালে এবং দুই মাস কিংস কলেজ হাসপাতালে। তাঁকে যকৃৎ ও বৃক্ক দান করার জন্য দুজন দাতা লন্ডনে গিয়েছিলেন। কিন্তু তাঁর শারীরিক অবস্থার অবনতি হওয়ায় অস্ত্রোপচারের মতো অবস্থা ছিল না, তাই যকৃৎ ও বৃক্ক প্রতিস্থাপন করা যায়নি। কয়েক বছর আগেও তাঁর একবার যকৃৎ প্রতিস্থাপন করা হয়।
বর্ণাঢ্য রাজনৈতিক জীবনের অধিকারী আবদুর রাজ্জাকের বয়স হয়েছিল ৬৯ বছর। তিনি দুই ছেলে ফাহিম রাজ্জাক ও নাহিন রাজ্জাক, স্ত্রী ফরিদা রাজ্জাকসহ অসংখ্য গুণগ্রাহী, রাজনৈতিক সহকর্মী ও শুভাকাঙ্ক্ষী রেখে গেছেন। কাল রোববার বেলা ১১টায় তাঁর লাশ বাংলাদেশে এসে পৌঁছাবে বলে আশা করা হচ্ছে।
আবদুর রাজ্জাক শরীয়তপুর জেলার ডামুড্যা উপজেলার দক্ষিণ ডামুড্যা গ্রামে এক মধ্যবিত্ত পরিবারে ১৯৪২ সালের ১ আগস্ট জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর বাবার নাম ইমামউদ্দিন এবং মায়ের নাম বেগম আকফাতুন্নেছা।
আবদুর রাজ্জাকের রাজনৈতিক জীবন শুরু হয় পঞ্চাশের দশকের শেষের দিকে। ছাত্রজীবন থেকেই তিনি আন্দোলন-সংগ্রামে যুক্ত হয়ে পড়েন। পাকিস্তান আমল থেকেই তিনি অত্যাচার-নির্যাতন, জেল-জুলুম ভোগ করেন। বাষট্টির শিক্ষা আন্দোলন, ছয় দফা আন্দোলন, স্বাধীনতাসংগ্রাম এবং মহান মুক্তিযুদ্ধে তিনি অগ্রণী ভূমিকা পালন করেন। স্বাধীন বাংলাদেশে তিনি সামরিক স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনসহ সব গণতান্ত্রিক আন্দোলন-সংগ্রামের পুরোভাগে থেকে নেতৃত্ব দিয়েছেন। ১৯৬০-৬২ সালে পূর্ব পাকিস্তান ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য ছিলেন। ’৬২-৬৩ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফজলুল হক হল ছাত্র সংসদের নির্বাচনে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় সহ-সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন তিনি।
আবদুর রাজ্জাক ১৯৬৬-৬৭ ও ’৬৭-৬৮ দুই মেয়াদে ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৭২ সালে বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে বাকশাল গঠিত হলে তিনি তখন অন্যতম সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৭৯ ও ১৯৮১ সালে দুই মেয়াদে তিনি আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন। ১৯৮৩ সালে আওয়ামী লীগ থেকে বেরিয়ে তিনি বাকশাল গঠন করেন। ১৯৯২ সালে বাকশাল আওয়ামী লীগের সঙ্গে একীভূত হলে তিনি দলের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য হন।
আবদুর রাজ্জাক ১৯৯১ ও ১৯৯৬ সালে দুটি আসন থেকে সাংসদ নির্বাচিত হন। এ ছাড়া ১৯৭০ সালে পাকিস্তান প্রাদেশিক পরিষদের সদস্য, ১৯৭৩ সালে জাতীয় সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। ১৯৯৬ থেকে ২০০১ সাল পর্যন্ত পানিসম্পদমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন তিনি।
নব্বইয়ের দশকের শুরুতে শহীদজননী জাহানারা ইমামের নেতৃত্বে একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটির ব্যানারে স্বাধীনতাবিরোধী রাজাকার ও যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের দাবিতে যে গণ-আন্দোলন শুরু হয়, সেই আন্দোলনে আবদুর রাজ্জাক অগ্রণী ভূমিকা পালন করেন।
পাকিস্তান আমলে ছয় দফা আন্দোলনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন আবদুর রাজ্জাক। বাংলাদেশের স্বাধীনতাসংগ্রাম এবং ১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম সংগঠক ছিলেন তিনি। মুক্তিযুদ্ধে আবদুর রাজ্জাক ভারতের মেঘালয়ে মুজিব বাহিনীর সেক্টর কমান্ডার ছিলেন।
১৯৫৮ সালে আবদুর রাজ্জাক ডামুড্যা মুসলিম উচ্চবিদ্যালয় থেকে এসএসসি এবং ১৯৬০ সালে ঢাকা কলেজ থেকে এইচএসসি পাস করেন। তিনি ১৯৬৪ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে রাষ্ট্রবিজ্ঞানে অনার্স ও পরে মাস্টার্স করেন। এরপর তিনি এলএলবি পাস করেন।
শোক প্রকাশ: জাতীয় নেতা আবদুর রাজ্জাকের মৃত্যুতে রাষ্ট্রপতি মো. জিল্লুর রহমান, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, স্পিকার আবদুল হামিদসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক দল ও ব্যক্তি শোক প্রকাশ করেছেন।
আরও শোক জানিয়েছেন বিএনপির চেয়ারপারসন ও বিরোধীদলীয় নেতা খালেদা জিয়া, ডেপুটি স্পিকার শওকত আলী, তথ্যমন্ত্রী আবুল কালাম আজাদ, জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান এইচ এম এরশাদ, গণফোরাম সভাপতি ড. কামাল হোসেন, বেসামরিক বিমান পরিবহন ও পর্যটনমন্ত্রী মুহাম্মদ ফারুক খান, মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক প্রতিমন্ত্রী এ বি তাজুল ইসলাম, আওয়ামী লীগের ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদক মাহবুব উল আলম হানিফ, শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদ, যোগাযোগমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের, জাতীয় পার্টির (জেপি) সভাপতি আনোয়ার হোসেন মঞ্জু প্রমুখ।

No comments

Powered by Blogger.