আলোকের এই ঝরনাধারায় (পর্ব-৪৫)-বিশ্ববিদ্যালয় জীবনের ছোটখাটো ঘটনা by আলী যাকের

মি আগেই হয়তো কোথাও লিখেছি যে গুলিস্তান সিনেমা হলের ওপরে একটি মিনি সিনেমা হল ছিল। যার নাম 'নাজ'। এই হলে আমরা প্রায়ই নাইট শোতে নামকরা বিদেশি সব ছবি দেখতাম। হলে ফিরতে দেরি হয়ে যেত। ডাইনিং হলে খাওয়ার পাট ততক্ষণে চুকে গেছে। অতএব বাইরে খাওয়া ছাড়া তখন কোনো উপায় ছিল না। এখন যেখানে প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের স্থাপত্য বিভাগ, তার বাইরের দেয়ালসংলগ্ন কতগুলো ছোট ছোট খাওয়ার জায়গা ছিল।
সেখানে সাধারণত রিকশাওয়ালা এবং মুটে-মজুররা খেতো। আমরাও এখানে খেতে ভালোবাসতাম। কেননা অতি অল্প পয়সায় এত উপাদেয় মাংস এবং ভাত তখনকার ঢাকায় কোথাও পাওয়া যেত কি না জানি না। অধিক রাতে কুকুরের চিৎকার একটি অত্যন্ত স্বাভাবিক বিষয়। আমরা হয়তো খেতে যাওয়ার জন্য বেরিয়েছি, দিব্যি কুকুর চিৎকার করে চলেছে, আমাদের কোনো বন্ধু হলের ভেতর থেকে চেঁচিয়ে বলল, 'ওই যে তোমাদের জন্য ডিনার তৈরি হচ্ছে।' অর্থাৎ ইঙ্গিত ছিল যে অত অল্প পয়সায় কেবল কুকুরের মাংসই পাওয়া যেতে পারে। এ রকম নানা স্মৃতি মনে পড়ে যায়। আমাদের এক বন্ধু হলের দেনা কখনো সময়মতো শোধ করত না। এ জন্য তাকে হলের অফিস থেকে নানা সময় নানাভাবে তাগাদা দেওয়া হয়েছে। কিন্তু সে নির্বিকার। আমাদের এই বন্ধুটির বাবার সঙ্গে ইকবাল হলের প্রভোস্ট ড. মতিন চৌধুরীর সখ্য ছিল। তাই বন্ধুটি ড. চৌধুরীকে এড়িয়ে চলত। একদিন ইকবাল হলে বড় পুকুরের ধারে বসে আমরা আড্ডা মারছি। সেখানে ওই বন্ধুটিও আছে। হঠাৎ প্রায় যমদূতের মতো ওখানে ড. মতিন চৌধুরী এসে হাজির হলেন। তিনি আমাদের বন্ধুটিকে দূর থেকে দেখতে পেয়েছিলেন। চাপা কণ্ঠে আমরা বন্ধুটিকে বললাম, 'এই প্রভোস্ট আসছে এই দিকে।' ও কোনো চিন্তাভাবনা না করেই সরসর করে পুকুরের পানিতে নেমে গেল। তারপর এক ডুব। ওদিকে ড. চৌধুরী ওখান থেকে সরছেন না। আর বন্ধুও পানির ভেতর থেকে নিঃশ্বাস যে নেবে, সেই গতিও নেই। ড. মতিন চৌধুরী কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থেকে মৃদু হেসে আমাদের বললেন, 'আমি আর বেশিক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকলে ওর নির্ঘাত মৃত্যু হবে। এই বয়সে এসে আমার কারণে একটি বাচ্চা ছেলের অপঘাতে মৃত্যু আমি সহ্য করতে পারব না। ওকে বলে দিয়ো যেন সময়মতো হলের পাওনা-গণ্ডা মিটিয়ে দেয়।' বলেই তিনি হনহন করে চলে গেলেন।
আমাদের বন্ধুটি কী করে জানতে পারল জানি না, তিনি দৃষ্টির বাইরে চলে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে পানির ভেতর থেকে মাথা তুলল। আমাদের এই বন্ধুরই আরো অনেক কীর্তি আছে। সে হলের বাসিন্দা ছিল না এবং আমাদের সঙ্গে আড্ডা মেরে অনেক রাতে বাড়ি ফিরত। এ বিষয়টি তার বাবার একদম পছন্দ নয়। সে জন্য সে তার মাকে একটি সময় দিয়ে রেখেছিল। মা সেই সময়মতো দরজা খুলে রাখতেন। একদিন প্রায় রাত ১টার দিকে সে বাড়ি ফিরল। ফিরে আস্তে দরজার কড়া নাড়ল। কিন্তু কেউ দরজা খুলল না। এবার একটু জোরে কড়া নাড়ল সে। ভেতর থেকে জলদগম্ভীর কণ্ঠে প্রশ্ন এল, 'কে?' তার কোনো ধারণাই ছিল না যে তার বাবা এত রাত-অবধি জেগে থাকবে। সে ভয়ে ভয়ে বলল, 'আমি'। তার বাবা বুঝতে পারলেন যে ছেলে বাড়ি ফিরেছে। একটা হেস্তনেস্ত করার জন্য তিনি আজ অপেক্ষা করেই ছিলেন। বললেন, 'আমি কে?' আমার বন্ধুটি সামান্য চিন্তা করে জবাব দিল, 'আমি কী করে বলব তুমি কে?' বলেই চোঁ চাঁ দৌড়।
ইসলামপুরে সেই সময় খুব ভালো মোরগ পোলাও পাওয়া যেত একটি বিশেষ দোকানে। দোকানটি 'পালোয়ানের দোকান' হিসেবে পরিচিত ছিল। আমরা মাঝেমধ্যে এখানে মোরগ পোলাও খেতে যেতাম। একবার ইংরেজি নববর্ষের রাতে আমরা সিদ্ধান্ত নিলাম, হল থেকে হেঁটে হেঁটে ইসলামপুরে পালোয়ানের দোকান পর্যন্ত যাব। পথে যারই দেখা পাই তাকে শুভ নববর্ষ জানানো হবে। আমাদের পাগলামি এমন। যেমন ভাবা তেমনি কাজ। আমরা শুভ নববর্ষ বলতে বলতে রাত ১১টায় পালোয়ানের দোকানে পেঁৗছে গেলাম। ঠিক ১২টায় গরম গরম মোরগ পোলাও দিয়ে নববর্ষ পালিত হলো। ফেরার সময় আবার সেই রাস্তার সব মানুষকে শুভ নববর্ষ জানানো। এমনকি ফুটপাতে ঘুমায় যে মানুষ তাকেও ঘুম থেকে তুলে বলা 'শুভ নববর্ষ'। গুলিস্তানের ওখানে পেঁৗছানোর পর আমরা ভাবলাম যে সেখানে পথের ধারে একটি চায়ের দোকানে চা খাওয়া যাক। কিছু এই ধরনের দোকান আছে, যা সারা রাত খোলা থাকে। কিন্তু এই চা খাওয়ার জন্য যাত্রাবিরতি দেওয়াটাই নিয়তি হলো। কিছুক্ষণের মধ্যেই দেখলাম প্রায় ১৫-১৬ জন ভিখারি, যাদের আমরা নববর্ষের শুভেচ্ছা জানাতে জানাতে এসেছিলাম, আমাদের ঘিরে ধরল। সেই যাত্রায় করজোড়ে মাফ চেয়ে আমাদের যার পকেটে যা ছিল টাকা-পয়সা, তাদের হাতে তুলে দিয়ে নিস্তার পেলাম। এ ধরনের কত ছোটখাটো ঘটনা ঘটেছে আমাদের বিশ্ববিদ্যালয় জীবনে, যা নিয়ে একটি গ্রন্থ রচনা করা যেতে পারে। তবে এ ধরনের অনেক অভিজ্ঞতা থেকেই আমি বঞ্চিত হয়েছি মায়ের অসুখ এবং মৃত্যু আর দিদির মৃত্যুর কারণে নিয়মিত বিশ্ববিদ্যালয়ে যেতে না পারায়।
(চলবে...)

লেখক : সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব

No comments

Powered by Blogger.