পাকিস্তানে সরকার ও সেনাবাহিনী মুখোমুখি

পাকিস্তানের বেসামরিক সরকার ও সামরিক বাহিনী মুখোমুখি অবস্থান নিয়েছে। গত বৃহস্পতিবার দেশটির প্রধানমন্ত্রী ইউসুফ রাজা গিলানি সামরিক বাহিনীর প্রতি ইঙ্গিত করে ‘সরকার পতনে ষড়যন্ত্র হচ্ছে’ বলে অভিযোগ তোলেন। তাঁর এই অভিযোগ উভয় পক্ষের মধ্যে মুখোমুখি অবস্থানকে প্রকাশ্যে নিয়ে আসে। এদিকে বার্তা সংস্থা রয়টার্স গত বৃহস্পতিবার জানায়, সেনাবাহিনী চায় প্রেসিডেন্ট জারদারি ক্ষমতা থেকে সরে যাক।


পাকিস্তানে বেশ কিছুদিন ধরেই সরকার ও সামরিক বাহিনীর মধ্যে দূরত্ব বাড়ছে। গতকাল শুক্রবার দেশটির গণমাধ্যমের প্রতিবেদন ও নিবন্ধেও সরকারের সঙ্গে সামরিক বাহিনীর মুখোমুখি অবস্থানের বিষয়টি উঠে এসেছে। তবে দেশটির সেনাপ্রধান জেনারেল আশফাক পারভেজ কায়ানি গতকাল অভ্যুত্থানের আশঙ্কাকে গুজব বলে উড়িয়ে দিয়েছেন। পাকিস্তানের প্রধান বিচারপতি ইফতিখার মোহাম্মদ চৌধুরীও অভ্যুত্থানের আশঙ্কা নাকচ করে দিয়েছেন।
পাকিস্তানের অন্যতম ইংরেজি দৈনিক ডন গতকাল প্রধান শিরোনাম করেছে, ‘সরকার ও সেনাবাহিনী মুখোমুখি’। দ্য ন্যাশন-এর শীর্ষ নিবন্ধের শিরোনাম ‘সেনাবাহিনীর মুখোমুখি গিলানি’। গত বৃহস্পতিবার প্রধানমন্ত্রী গিলানির বক্তব্যের ওপর ভিত্তি করেই এমন প্রতিবেদন ও নিবন্ধ ছেপেছে দেশটির পত্রিকাগুলো।
বৃহস্পতিবার জাতীয় আর্ট গ্যালারিতে এক সমাবেশে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ষড়যন্ত্রকারীরা তাঁর সরকারের পতন ঘটাতে চাইছে। তিনি বলেন, ‘দেশের কোনো প্রতিষ্ঠান “রাষ্ট্রের ভেতর আরেক রাষ্ট্রের” মতো চলতে পারে না। প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়সহ প্রতিটি মন্ত্রণালয়কে অবশ্য পার্লামেন্টের কাছে জবাবদিহি করতে হবে।’
গত ২ মে পাকিস্তানে মার্কিন বাহিনীর অভিযানে আল-কায়েদার প্রতিষ্ঠাতা ওসামা বিন লাদেন নিহত হওয়ার ঘটনায় পাকিস্তানের সেনাবাহিনীর হাত ছিল বলে অভিযোগ ওঠে। এর পর থেকে দেশটির বেসামরিক সরকারের সঙ্গে সেনাবাহিনীর শীতল সম্পর্কের সূচনা। গত নভেম্বরে আফগানিস্তান-পাকিস্তান সীমান্তে মার্কিন বাহিনীর বিমান হামলায় ২৪ পাকিস্তানি সেনা নিহত হলে সরকার আরও চাপে পড়ে। প্রেসিডেন্ট আসিফ আলী জারদারির বিরোধীদের মতে, মার্কিন সামরিক বাহিনীঘেঁষা জারদারি অভ্যন্তরীণ চাপে পাকিস্তান থেকে ন্যাটোর রসদ সরবরাহের পথ বন্ধ করে দেন। একই সঙ্গে দেশটির সামসি বিমানঘাঁটি থেকে মার্কিন বাহিনীকে সরে যাওয়ার নির্দেশ দেন।
এরপর সামনে আসে ‘গোপন চিঠি’ কেলেঙ্কারি। এ চিঠির সূত্র ধরে গত নভেম্বরে পদত্যাগ করেন যুক্তরাষ্ট্রে নিযুক্ত পাকিস্তানের রাষ্ট্রদূত হুসাইন হাক্কানি। অভিযোগ উঠেছে, তিনি একটি গোপন চিঠি লেখেন মার্কিন সামরিক কর্মকর্তাদের কাছে। ওই চিঠিতে পাকিস্তানের শীর্ষ সামরিক ও গোয়েন্দা কর্মকর্তাদের সরিয়ে দিতে পাকিস্তান সরকারের পক্ষ থেকে মার্কিন সহায়তা চাওয়া হয়। পাকিস্তান সেনাবাহিনী অভ্যুত্থান করতে পারে বলেও আশঙ্কা করা হয়। চিঠিতে অঙ্গীকার করা হয়, যুক্তরাষ্ট্র প্রেসিডেন্ট জারদারির সরকারকে সহায়তা দিলে ইসলামাবাদের পররাষ্ট্রনীতি মার্কিন অনুকূলে থাকবে। স্বাক্ষরবিহীন ওই চিঠি পাকিস্তানি বংশোদ্ভূত মার্কিন ব্যবসায়ী মনসুর ইজাজের মাধ্যমে মার্কিন সামরিক কর্মকর্তাদের কাছে পাঠানো হয়।
পাকিস্তানের প্রধান বিরোধী দলের নেতা নওয়াজ শরিফসহ কয়েকজন চিঠির বিষয়টি তদন্তের জন্য কয়েক সপ্তাহ আগে দেশটির সুপ্রিম কোর্টে আবেদন করেন।
গত ৬ ডিসেম্বর হঠাৎ করেই সংযুক্ত আরব আমিরাতের দুবাই চলে যান জারদারি। এতে গুজব ছড়িয়ে পড়ে, জারদারিকে চাপের মুখে ক্ষমতা ছাড়তে বাধ্য করা হবে। গণমাধ্যমের খবরে জানা যায়, চিকিৎসা নিতে দুবাই যান জারদারি। চিকিৎসা শেষে সপ্তাহ খানেক আগে দেশে ফেরেন তিনি।
গতকাল পাকিস্তান সামরিক বাহিনীর এক বিবৃতিতে সেনাপ্রধান জেনারেল কায়ানি অভ্যুত্থানের আশঙ্কা উড়িয়ে দিয়ে বলেন, অভ্যুত্থানের গুজব ছড়িয়ে প্রকৃত ইস্যু থেকে সবার নজর সরিয়ে নেওয়া হচ্ছে।
প্রধান বিচারপতি ইফতিখার মোহাম্মদ চৌধুরী গতকাল আদালতে ‘গোপন চিঠি’র বিষয়ে শুনানির সময় অভ্যুত্থানের আশঙ্কা উড়িয়ে দেন। তিনি বলেন, ‘সেনাবাহিনীর ক্ষমতা নেওয়ার কোনো প্রশ্নই ওঠে না। কারণ, এখন আদালতের ওপর জনগণের আস্থা আছে।’
দেশের এমন পরিস্থিতিতে গতকাল ক্ষমতাসীন পাকিস্তান পিপলস পার্টির (পিপিপি) কোর কমিটির বৈঠকে হয়। দলের কো-চেয়ারম্যান আসিফ আলী জারদারি এতে সভাপতিত্ব করেন। প্রধানমন্ত্রী গিলানিসহ দলের জ্যেষ্ঠ নেতারা বৈঠকে উপস্থিত ছিলেন। বৈঠক শেষে পিপিপির মুখপাত্র ফারহাতুল্লাহ বাবর জানান, বৈঠকে সার্বিক রাজনৈতিক পরিস্থিতি নিয়ে আলোচনা হয়। এতে পার্লামেন্টের সার্বভৌমত্ব, সংবিধান ও আইনের শাসন অক্ষুণ্ন রাখার অঙ্গীকার করা হয়। পিপিপি ও সরকার যেকোনো পরিস্থিতিতে এই নীতিতে অটল থাকবে। সূত্র: এএফপি, সিএনএন, ইকোনমিকস টাইমস।

No comments

Powered by Blogger.