জার্নি বাই ট্রেন by জাহিরুল ইসলাম

ত রোববার রেলমন্ত্রীর ঢাকা-চট্টগ্রাম ট্রেন ভ্রমণে অনেকের 'এ জার্নি বাই ট্রেন' রচনার কথা মনে পড়তে পারে। স্কুল শিক্ষার্থীদের কাছে এটি অতি পরিচিত একটি রচনা। এ রচনায় প্রকৃতি ও পরিবেশের বর্ণনায় ট্রেন ভ্রমণের যে চিত্র অঙ্কন করা হয় তাতে মনের মধ্যে এক ধরনের রোমাঞ্চ তৈরি হয়। ট্রেন ভ্রমণে উৎসাহ জাগে। আমাদের দেশের ট্রেনের প্রকৃত চিত্র ভিন্ন। তাই বইয়ের রচনা পড়ে কৌতূহলী কেউ ট্রেন ভ্রমণে গেলে হোঁচট খেতে বাধ্য। কারণ ট্রেনের নানা রকম


অব্যবস্থাপনা। তাত্তি্বকভাবে স্বাস্থ্যবান্ধব হলেও এ দেশে অন্যান্য গণপরিবহনের তুলনায় ট্রেন ভ্রমণ কিছুটা বিরক্তিকর। তাই নিতান্ত দায়ে না পড়লে কেউ ট্রেনে ভ্রমণ করে না।
ট্রেন ভ্রমণের প্রতি মানুষের এই মনোভাব কেন? রেলওয়ের অব্যবস্থাপনার শত অভিযোগের মধ্যে সবচেয়ে গুরুতর হলো সময়মতো যাত্রা শুরু করতে না পারা এবং নির্দিষ্ট সময়ে গন্তব্যে পেঁৗছানোর ব্যর্থতা। ট্রেনের সময়সূচি নিয়ে তাই অনেক কৌতুকও মানুষের মুখে মুখে ফেরে। সম্ভবত এ কারণেই নতুন গঠিত রেলপথ মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব গ্রহণ করেই মন্ত্রী সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত বলেছিলেন, সময়মতো ট্রেন চলাচল নিশ্চিত করাই তার প্রথম কাজ। কিন্তু অব্যবস্থাপনা বলে কথা! আর সম্ভবত সে কারণেই বিসমিল্লার গলদ এড়ানো সম্ভব হয়নি। স্বয়ং মন্ত্রীর ঢাকা-চট্টগ্রাম ভ্রমণের দিনও মহানগর প্রভাতী সময়মতো ছাড়তে পারেনি।
রেলের বিরুদ্ধে এ রকম অনেক অভিযোগ থাকলেও ইতিবাচক দিকও রয়েছে। রেলপথে যোগাযোগই এখন পর্যন্ত তুলনামূলক নিরাপদ। লাইন থেকে বগিচ্যুতি এবং রেলক্রসিংয়ের দুই-একটি দুর্ঘটনা বাদ দিলে রেলপথে প্রাণহানি তেমন ঘটে না। সড়কপথের মতো যানজটেরও দুর্ভাবনা নেই। তুলনামূলকভাবে সুলভও। কিন্তু এর পরও ট্রেন ভ্রমণ থেকে মানুষ ক্রমে মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছে। কারণ, যাত্রীসেবার মান যাচ্ছেতাই। রেলওয়ের অব্যবস্থাপনাও যে এর অন্যতম কারণ তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না।
মন্ত্রীর বক্তব্য থেকেই জানা যায়, রেলওয়ের বার্ষিক লোকসানের পরিমাণ প্রায় ৭শ' কোটি টাকা। এ রকম লোকসান হচ্ছে বছরের পর বছর। তাই বাস্তবিক কারণেই বেশি কিছু আশা করাও দুরাশা। এই পরিস্থিতি থেকে উত্তরণের জন্য রেলওয়েকে লাভজনক করা জরুরি। বাংলাদেশে সড়ক এবং নৌপথে দুর্ঘটনার পরিমাণ যেভাবে বেড়ে চলছে তাতে উন্নত সেবা প্রদানের মাধ্যমে খাতটিকে লাভজনক করা অসম্ভব ছিল না। কিন্তু সেটা সম্ভব হয়নি সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের দুর্নীতি ও সদিচ্ছার অভাবের কারণে।
লোকসানের ভূত থেকে রেলওয়েকে বের করে নিয়ে আসার জন্য ট্রেন ভ্রমণকে জনপ্রিয় করার বিকল্প নেই। বিদেশে মন্ত্রী-সরকারপ্রধানরা হরহামেশাই পাবলিক পরিবহনে চলাফেরা করেন। উত্তর কোরিয়ার প্রেসিডেন্ট কিম জং ইল গত শনিবার শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন ট্রেনে ভ্রমণের সময়েই। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বর্তমান প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামাও ট্রেনে চড়ে তার নির্বাচনী প্রচারণা শুরু করেছিলেন। বাংলাদেশে সরকারের উচ্চপর্যায়ের ব্যক্তিদের ট্রেন ভ্রমণের এ রকম নজির খুব কম। রেলপথে ভ্রমণকে জনপ্রিয় করতে মন্ত্রী-সাংসদরা এভাবে মাঝে মধ্যে ভ্রমণ করতে পারেন।
রেলওয়ের উন্নয়নে সরকারি উদ্যোগ গ্রহণ করা হলেও দূরপাল্লার যাত্রীবাহী বাসের মালিকরা তাদের ব্যবসায় লোকসানের কথা চিন্তা করে এ ধরনের পদক্ষেপ বাধাগ্রস্ত করেন বলে অভিযোগ রয়েছে। এ রকম দুই-একজন ব্যক্তি মন্ত্রিসভায় রয়েছেন বলেও শোনা যায়। এ ধরনের চিন্তা ধ্বংসাত্মক। নতুন মন্ত্রী ব্যক্তিস্বার্থের হীন উদ্দেশ্য থেকে রেলওয়েকে মুক্ত করতে পারবেন কি? তাদের দৌরাত্ম্য থেকে বের হতে পারলেই রেলওয়ের উন্নয়ন সম্ভব। তা না হলে রেলওয়েকে বেশিদিন বাঁচানো যাবে না। সড়কপথে পরিবহন ব্যয় যেভাবে বাড়ছে তখন নিম্ন আয়ের মানুষের যোগাযোগের কোনো বাহন থাকবে না। অন্যদিকে এ দেশে 'ট্রেন ভ্রমণ' শব্দটিরও ঠাঁই হবে বইয়ের পাতায়।
zahirul.du@gmail.com

No comments

Powered by Blogger.