স্বাধীনতার ৪০ বছর-তোমাদের এ ঋণ শোধ হবে না


৬৩ স্বাধীনতার চার দশক উপলক্ষে খেতাবপ্রাপ্ত মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়ে ধারাবাহিক এই আয়োজন।শহীদ আবুল কালাম আজাদ, বীর বিক্রম আর ফিরে আসেননি তিনি আবুল কালাম আজাদ চাকরি করতেন পাকিস্তান সেনাবাহিনীতে।কর্মরত ছিলেন তৃতীয় ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টে। ১৯৭১ সালে এই রেজিমেন্টের অবস্থান ছিল সৈয়দপুর সেনানিবাসে। মুক্তিযুদ্ধ শুরু হওয়ার পর আবুল কালাম আজাদের সঙ্গে মা-বাবার যোগাযোগ ছিল না। নোয়াখালী


জেলার সুধারাম থানার (বর্তমানে উপজেলা) বিনোদপুর ইউনিয়নের বিনোদপুর গ্রামে তাঁর পৈতৃক বাড়ি। স্বাধীনতার পর মা-বাবা অপেক্ষায় থাকেন ছেলের। কিন্তু ছেলে আর ফিরে আসে না। দরিদ্র মা-বাবার পক্ষে সম্ভব হয়নি সৈয়দপুর সেনানিবাসে গিয়ে ছেলের খোঁজ নেওয়ার। বিভিন্ন জনের মাধ্যমে খোঁজখবর নিতে থাকেন তাঁরা। কয়েক মাস পর বাংলাদেশ সেনাবাহিনী থেকে জানানো হয়, তাঁদের ছেলে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে এক যুদ্ধে শহীদ হয়েছেন। কোন দিন এবং কোথায় যুদ্ধে শহীদ হয়েছেন, সে তথ্য হয়তো চিঠিতে ছিল। কিন্তু সেই চিঠি হারিয়ে গেছে। এখন পরিবারের কেউ সে সম্পর্কে কিছু জানেন না। তাঁর মা-বাবা মারা গেছেন। বেঁচে আছেন তাঁর এক ভাই ও বোন। তাঁরা কিছু জানেন না। ভাই আবুল কাশেম গাড়িচালক।
১৯৭১ সালের মার্চের প্রথমদিকে সম্ভাব্য ভারতীয় আগ্রাসন, অভ্যন্তরীণ আইনশৃঙ্খলা বজায় রাখা, অনির্ধারিত সাঁতার প্রশিক্ষণ ইত্যাদি বাহানায় এই রেজিমেন্টের সেনাদের সেনানিবাসের বাইরে মোতায়েন করা হয়। ‘বি’ (ব্রাভো) ও ‘ডি’ (ডেল্টা) কোম্পানিকে পাঠানো হয় রংপুর জেলার ঘোড়াঘাটে। ‘সি’ (চার্লি) কোম্পানি সৈয়দপুর-দিনাজপুর সড়কের মধ্যবর্তী মণ্ডলপাড়ায় বৈদ্যুতিক কেন্দ্র পাহারায়। ‘এ’ (আলফা) কোম্পানিকে দিনাজপুরের পার্বতীপুরে। ওয়্যারলেস সেট ও ভারী অস্ত্রশস্ত্র থাকে ব্রিগেড হেডকোয়ার্টারের নিয়ন্ত্রণে। এ সময় সেনানিবাসে অবস্থান করছিল রেজিমেন্টের ‘রিয়ার পার্টি’, ব্যাটালিয়ন হেডকোয়ার্টার ও হেডকোয়ার্টার কোম্পানির কিছু সেনা। ২৫ মার্চ রাতে পাকিস্তান সেনাবাহিনী কর্তৃক ঢাকার গণহত্যার সংবাদ দেশের উত্তরাঞ্চলে অবস্থানরত তৃতীয় ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের সদস্যদের কাছে পৌঁছায়। এরপর এই রেজিমেন্টের কোম্পানিগুলো নিজ নিজ অবস্থানে থেকে বিদ্রোহ করে। ৩০ মার্চ রাতে সেনানিবাসে অবস্থানরত বাঙালি সেনাদের ওপর পাকিস্তানি সেনারা আক্রমণ করে। তখন বাঙালি সেনারা তাদের প্রতিরোধ করেন। এই যুদ্ধে অনেক বাঙালি সেনা শহীদ ও আহত হন। বাকিরা পালিয়ে যেতে সক্ষম হন। তাঁরা পরে সমবেত হন দিনাজপুরের ফুলবাড়ীতে। এরপর দিনাজপুরের বিভিন্ন স্থানে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর সঙ্গে তৃতীয় ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের মুক্তিযোদ্ধাদের যুদ্ধ হয়। এর মধ্যে ভূষিরবন্দর যুদ্ধ (৫ ও ৬ এপ্রিল), পার্বতীপুর যুদ্ধ (৭ এপ্রিল), বদরগঞ্জ যুদ্ধ (৮ ও ৯ এপ্রিল), খোলাহাটি যুদ্ধ (১০ এপ্রিল), ফুলবাড়ী যুদ্ধ (১১ এপ্রিল), হিলির যুদ্ধ (১৯-২০ এপ্রিল) উল্লেখযোগ্য। এসব যুদ্ধে তৃতীয় ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের মুক্তিযোদ্ধারা অসীম সাহস ও বীরত্ব প্রদর্শন করেন। অনেকে শহীদ ও আহত হন। ২১ এপ্রিলের পর মুক্তিযোদ্ধারা ভারতে অবস্থান নেন। এরপর জুন মাসের প্রথম সপ্তাহ পর্যন্ত মুক্তিযোদ্ধারা সীমান্ত এলাকার রামগতি, ফুলবাড়ী, চরখাই, রামনগর, জলপাইতলী, রাজাই, আমবাড়ী, গৌরীপুর, মন্মথপুসহ আরও কয়েক স্থানে অ্যামবুশ, রেইড, কমান্ডো হামলা চালান। কোনো এক যুদ্ধে আবুল কালাম আজাদ শহীদ হন। এসময় দেখা যায়, ৭০০ সদস্যের তৃতীয় ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের ৪১৬ জন মুক্তিযোদ্ধা ক্যাম্পে আছেন। বাদবাকি শহীদ, আহত বা নিখোঁজ।
মুক্তিযুদ্ধে সাহস ও বীরত্ব প্রদর্শনের জন্য শহীদ আবুল কালাম আজাদকে মরণোত্তর বীর বিক্রম খেতাবে ভূষিত করা হয়। ১৯৭১ সালের সরকারি গেজেট অনুযায়ী তাঁর বীরত্বভূষণ সনদ নম্বর ৭৫।
শহীদ আবুল কালাম আজাদের বাবার নাম মকবুল আহম্মদ, মা ফুল বানু। তাঁর ছবি পাওয়া যায়নি। শহীদ আবুল কালাম আজাদ বীর বিক্রম কোথায় এবং কোন দিন শহীদ হয়েছেন, এ তথ্য কারও জানা থাকলে তা প্রথম আলো কার্যালয়ে পাঠানোর জন্য অনুরোধ জানানো হলো।
সূত্র: ফখরুল ইসলাম (নোয়াখালী) এবং বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধ সেক্টরভিত্তিক ইতিহাস, সেক্টর ৭।
গ্রন্থনা: তারা রহমান
trrashed@gmail.com

No comments

Powered by Blogger.