প্রাথমিক শিক্ষার সুযোগবঞ্চিত অবহেলিত শিশুরা by এমরানা আহমেদ

‘গ্রামে লেখাপড়া করতাম, ঢাকায় আইন্যা বাপে কামে লাগাইয়া দিছে।’ পড়াশোনা থেকে ছিটকে পড়ার কথা এভাবেই জানায় বাংলামটরের মোটরগাড়ি মেরামত কারখানার এক শিশুশ্রমিক মিজান। কারওয়ানবাজারের সবজির দোকানে কাজ করা শিশুশ্রমিক রহমান জানায় সে কখনও স্কুলেই যায়নি।

প্রতিদিন ঢাকা মেগাসিটিতে কাজের সন্ধানে লাখো ভাসমান মানুষ এসে ভিড় করছে। গ্রামে দু’মুঠো আয়ের সংস্থান করতে না পারায় তারা শহরমুখো হচ্ছে। শহরে এসে ঠাঁই নিলেও তাদের ভাগ্যের পরিবর্তন হচ্ছে না। দারিদ্র্যের দুষ্টচক্র তাদের আরও বেশি করে আষ্টেপৃষ্ঠে বেঁধে ফেলছে। এখানেই শেষ নয়, মিজান এবং রহমানের মতো তাদের শিশুসন্তানরা থেকে যাচ্ছে শিক্ষার আলো থেকে বঞ্চিত। কারও কারও ছেলেমেয়ে এনজিও পরিচালিত পথস্কুলগুলোতে পড়াশোনার সুযোগ পেলেও সে শিক্ষা তাদের জীবনমান উন্নয়নে তেমন কোনো ভূমিকাই রাখতে পারে না। এছাড়া মানসম্মত পরিবেশের অভাব, দারিদ্র্য, অভিভাবকের অসচেতনতা—এসব কারণে শিশুরা শিক্ষা থেকে ঝরে পড়ছে। এসব ঝরেপড়া শিশুদের অনেকেই পরে শিশুশ্রমে জড়িয়ে পড়তে বাধ্য হচ্ছে। সরকারের বাধ্যতামূলক প্রাথমিক শিক্ষা কর্মসূচির আওতায় এসব শিশুকে আনা কিছুতেই সম্ভব হচ্ছে না। সরকার, জাতিসংঘ শিশু তহবিল (ইউনিসেফ), দাতাগোষ্ঠী, ব্র্যাক, ঢাকা আহ্ছানিয়া মিশনসহ বিভিন্ন এনজিও অপ্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা কার্যক্রম পরিচালনা করছে। তবে এসব কার্যক্রমে যারা শিক্ষার সুযোগ পাচ্ছে তাদের সংখ্যাও হাতেগোনা।

খিলগাঁও চৌধুরীপাড়া সংলগ্ন রেললাইন বস্তির আক্কাস আলী মুন্সীগঞ্জের লৌহজং থানার যশলদিয়া গ্রামের বাসিন্দা। পদ্মার ভাঙনে বাপ-দাদার ভিটা হারানোর পর শহরে এসে ঠাঁই হয় রেললাইন বস্তিতে। তার পাঁচ সন্তানের কাউকেই অভাবের তাড়নায় লেখাপড়া করাতে পারেননি। অনেক কষ্টেসৃষ্টে ৫০ হাজার টাকা যৌতুক দিয়ে দু’মেয়ের বিয়ে দেন। পরের ৩ সন্তান ছেলে। বড় দু’জনের একজন রিকশা এবং অন্যজন ভ্যান চালায়। ছোট্ট ছেলেটিকে কষ্টসৃষ্ট করে স্থানীয় একটি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে পড়াশোনা করান বলে আমার দেশ প্রতিবেদকে জানান আক্কাস আলী। ভালো ফলাফল নিয়ে পঞ্চম শ্রেণী পাস করলেও অর্থাভাবে মাধ্যমিক পর্যন্তও ছেলেকে তার পক্ষে পড়ানো সম্ভব হয়নি। রেলবস্তিতে ৫ শতাধিক পরিবারের মধ্যে পঞ্চাশটি পরিবারের ছেলেমেয়েরাও প্রাথমিক শিক্ষার সুযোগটুকু পাচ্ছেন না বলে আমার দেশ প্রতিবেদকের কাছে আক্ষেপ করেন আক্কাস আলী। কিছু কিছু এনজিওর লোকজন সপ্তাহে দুই থেকে তিনদিন এসে ছোট ছোট ছেলেমেয়েদের পড়াশোনা করান বলে জানান তিনি। রাজধানীতে বসবাসকারী নিম্ন আয়ের পরিবারগুলোর ছেলেমেয়েদের শিক্ষার এই বেহাল দশা সর্বত্র চোখে পড়বে। নগরে বসবাসকারী দরিদ্র রহমান-মিজানের মতো এমন অবহেলিত ও শিক্ষাবঞ্চিত শিশুর সংখ্যা অনেক। এদের কেউ হোটেল-রেস্তোরাঁয়, কেউ ফ্যাক্টরি-ওয়ার্কশপে, কেউবা বাসাবাড়িতে ঝুঁকিপূর্ণ কাজ করছে। কোনো কাজ না পেয়ে অনেকে আবার ছিন্নমূল শিশুতে পরিণত হয়ে নানা অপরাধমূলক কাজে জড়িয়ে পড়ছে। মা-বাবা ও আপনজনের কাছ থেকে বিচ্ছিন্ন জীবনযাপনের কারণে এসব শিশু বিভিন্ন মাদকদ্রব্যে আসক্ত হয়ে পড়ছে। এসব শিশুর অধিকাংশই মাদকের ক্ষতিকারক দিক সম্পর্কে জানে না। আর যখন তারা মাদকের ভয়াবহতা বুঝতে পারে ফেরার আর পথ থাকে না। ২০০৭ সালের এক সমীক্ষায় দেখা গেছে, ঢাকা শহরে কমপক্ষে ২২৯টি স্পট রয়েছে, যেখানে ৯ থেকে ১৮ বছর বয়সী শিশু মাদক সেবন করে। ক্যাম্পেইন ফর পপুলার এডুকেশনের (গণসাক্ষরতা অভিযান) সম্প্রতি এক গবেষণায় বলা হয়েছে, বাংলাদেশে এখনও ৪৯ লাখ শিশু শিক্ষার আলো থেকে বঞ্চিত। আবার যারা প্রাথমিক ও মাধ্যমিক পর্যায়ের শিক্ষায় জড়িত, বিদ্যালয়ে তাদের উপস্থিতি কম। শতকরা ৬০ থেকে ৬২ ভাগ শিশু প্রাথমিক শিক্ষা থেকে বঞ্চিত এবং তারাই শ্রমনির্ভর হয়ে পড়ছে। আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থার (আইএলও) ২০০৬ সালের জরিপ অনুসারে, দেশের মোট জনসংখ্যার ৪০ শতাংশ শিশু। এর মধ্যে ৭৪ লাখ শ্রমজীবী। ‘জেন্ডার : ইক্যুয়ালিটি অ্যান্ড এডুকেশন’ শীর্ষক প্রতিবেদনে বলা হয়, দেশে ৫২ শতাংশ বয়স্ক নারী নিরক্ষর। বাংলাদেশে প্রাক-প্রাথমিক শিক্ষা পায় না ৯১ শতাংশ শিশু। প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, মানুষের মস্তিষ্কের ৯০ শতাংশ গঠিত হয়ে যায় পাঁচ বছর বয়সের মধ্যে। এটি প্রাক-প্রাথমিক শিক্ষার বয়স। বেশির ভাগ শিশু প্রস্তুতি ছাড়াই ভর্তি হয় প্রাথমিক স্তরে। প্রাক- প্রাথমিক শিক্ষা না থাকায় বাংলাদেশে ৩২ শতাংশ শিশু প্রাথমিক স্তর থেকে ঝরে পড়তে বাধ্য হচ্ছে। বাংলাদেশের সংবিধানে শিশুদের প্রাথমিক শিক্ষা বাধ্যতামূলক এবং তাদের অধিকার নিশ্চিত করার কথা বলা হয়েছে। এই লক্ষ্যে সরকার শিশু অধিকার এবং আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থার সনদসহ ৩৩টি সনদ অনুসমর্থন করেছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা ও গবেষণা ইনস্টিটিউট (শিক্ষা ও প্রশাসন) বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক হোসনে আরা বেগম আমার দেশ-কে বলেন, এনজিও পরিচালিত স্কুলগুলোর স্বল্প ও বিক্ষিপ্ত পরিসরে সুবিধাবঞ্চিত শিশুদের মাঝে শিক্ষার আলো ছড়িয়ে দেয়ার কাজটিকে আমি স্বাগত জানাই। তবে জাতীয় এবং আন্তর্জাতিক সব এনজিওর উচিত নগরীর বস্তি এলাকায় গিয়ে শিশুদের পড়াশোনার কারিকুলাম এক রেখে ছাত্রছাত্রীদের জ্ঞানের স্তরভেদে সেখানে পদ্ধতিগত পরিবর্তন এনে শিক্ষা দেয়া। সেটি করা গেলে তা বেশি কার্যকর এবং বাস্তবসম্মত হবে। বর্তমান সরকার দেশের স্কুল যাওয়ার উপযোগী সব শিশুকে শিক্ষার অধিকার নিশ্চিত করার জন্য যে সর্বজনীন প্রাথমিক শিক্ষা এবং অবৈতনিক শিক্ষা কার্যক্রম চালু করেছে সেখানে দরিদ্র পরিবারের সুবিধাবঞ্চিত শিশুদের শিক্ষার আওতায় আনতে না পারলে সরকারের এই মহতী উদ্যোগটি প্রকৃতপক্ষে কোনো কাজেই আসবে না। উদ্যোগটির বাস্তবায়নে সরকারের উচিত সব শ্রেণীপেশার শিশু স্কুলে যাচ্ছে কি না, সেটা নিয়মিত মনিটরিং করা। অন্যথায় সরকারের সব উদ্যোগই ব্যর্থ হবে বলে মনে করেন অধ্যাপক হোসনে আরা বেগম।

No comments

Powered by Blogger.