অবাক করা ভূতের রাতে by শান্তা ফারজানা

লাল ইটের রাস্তা। ধুম বর্ষায় ভেঙে গেছে এখানে সেখানে। রিকশা-অটো চলাচল করে না বললেই চলে। কেননা, পথে পথে শক্ত ঝাঁকুনি। হেঁটেই চলে ওদিককার লোকজন। তবে সত্যি কথা বলতে কী, ওপথে মানুষের যাতায়াত শতে দশ-বারো। তাও আবার নিরুপায় হয়ে। কিংবা সময় বাঁচাতে। মানুষ বেশিরভাগই ঘুরপথে চলাফেরা করে। আর যারা সেই ইট বিছানো স্বল্পদৈর্ঘ্য পথে যায়, সঙ্গী-সাথী নিয়ে যায়। উপরন্তু দিনের সোনালি আলোয়। রাতের আঁধারে কারও


ছায়াও দেখা সম্ভব নয় সে পথে। ইট রাস্তার শেষ মাথায় বাজার। সূর্যতলী গ্রামের সবচেয়ে বড় হাট এই বাজারেই বসে। রাস্তার ধারে বিশাল বিশাল বটের গুঁড়ি। কয়েক শত বছরের পুরনো তো হবেই। এর প্রমাণ হলো, গাছগুলোর মোটা শক্ত শাখা-প্রশাখা বিস্তারকারী শেকড়। ওরা নির্ভয়ে মাটির ওপরেই গর্বের সঙ্গে প্রবহমান।
এমনই এক বুড়ো বটের ছায়ায় গনি দাদার দোকান। বেড়া ছাউনি। ছোট্ট। চা-কেক-বিস্কুটের। সামনে কাঠের বেঞ্চ পাতা। কবে, কীভাবে যেন এর একটা পায়া ভেঙে গিয়েছিল; নতুন কাঠে পেরেক মারা।
গনি দাদা জ্যান্ত টেলিগ্রাম! উত্তর-দক্ষিণ-পূর্ব-পশ্চিম, ১৫-২০ মাইল, প্রতিদিন কী ঘটছে, কী রটছে_ সবই তার কান দারস্থ। পথচলা মানুষগুলো গনি দাদার দোকানে বসে তৃষ্ণা মিটায়।
'দাদা আর কী খবর, শোনাও।' _চায়ের কাপে ছোট ছোট চুমুক দেয় নিতেন। এই বাজারেই তার দোকান। তুুলার।
'আরে দা-দা ..., খবর তো অখন একটাই। চৌধুরীর ছোট ছেলে...' _গনি দাদা মোয়ার নতুন প্যাকেট ছিঁড়তে ছিঁড়তে বলেন।
'চৌধুরীর ছেলে! উনার আবার কী হইল?' _মুড়ির মোয়া চিবুতে চিবুতে প্রশ্ন করে বিমল।
'গত পরশু রাতে আসছিল বাড়িতে। ছুটিতে। শহরে মানুষ। কলেজ-ভার্সিটি করে গেরামের গন্ধ চেনে না। তেমন তো আসেও না।' _গনি দাদা গল্প বলার মতো আসর করে বসালেন। নিতেন, বিমল, আরশাদ, রানা, মফিদ আর সবাই চা খাওয়া ভুলে দাদার দিকে তাকিয়ে রইল।
'সেদিন ট্রেন মাঝপথে আটকে গেছিল...' _দাদা বলেই চললেন, 'কী যেন ইঞ্জিন সমস্যা! যখন ছাড়ল, তখন প্রায় সন্ধ্যা। আর ট্রেন-বাস করতে করতে প্রায় বেশ রাত হয়ে গেল। রিকশা না পেয়ে হেঁটেই রওনা হলো বেচারা। তা ছাড়া ঘন রাত, তাই কাউকে ডাকতেও চাইল না। শিক্ষিত মানুষ, ভদ্রতা জ্ঞান ভালো। তো হাঁটতে উঠে পড়ল ইটা পথে। যেই ঝাড়টার ধারে পেঁৗছল, অমনি নাকি ভয়ে চিৎকার!'
গনি দাদা চোখ বড় বড় করে হাত নেড়ে বলেই চলেছেন। আর শ্রোতাদের নিঃশ্বাস তো রীতিমতো বন্ধ হওয়ার পালা।
'এত বড় তাগড়া জওয়ান। ভয়ে মিশে যেতে চাচ্ছিল মাটির সঙ্গে। ঘামতে লাগল দরদর করে। শরীর ভিজে শেষ। এক সময় জ্ঞান হারাল। রাস্তাতেই লুটোপুটি। কাকডাকা ভোরে আবদুল করিম নামাজ শেষে বাড়ি ফেরার পথে তাকে দেখে চৌধুরীবাড়িতে খবর পাঠায়।'
'আরে দাদা, এই হলো মুশকিল!' _বিমলের চোখে বিরক্তি, 'তুমি আসল কথাটা বলতেই ভুলে যাও। কী দেখে তার এমন...।'
'আরে শোনোই না।' _আরশাদের জন্য কাপে পানিতে চা-পাতি মেশাতে মেশাতে বললেন, 'ঝাড়ের কাছে ছেলেটা দেখল, বেতের একটা পাটি হঠাৎ হেলে পড়েছে। কোনো বাতাস নেই, ঝড় নেই। কেন এমন হচ্ছে_ কিছু বোঝার আগেই আরও কয়েকটা পটপট করে নুইয়ে পড়ল। এসব দেখে... বেচারা নতুন মানুষ...!'
'আহ্হা...! আরে হ্যাঁ, ঐ বেতঝাড়টা অভিশপ্ত... প্রতি রাতেই অমন...' _চায়ের গরম ধোঁয়ার সঙ্গে সঙ্গে অন্য সবার কান দিয়েও ধোঁয়া বের হতে থাকে।
সূর্যতলী গ্রামের ওই একটু পথ বেশ সুনসান। দিনের আলোতেই গ্রামবাসী ওপথ মাড়াতে ভয় পায়। গ্রামে প্রচলিত আছে, বছর কয়েক আগে কোন এক পাগল নাকি সে পথে হোঁচট খেয়ে জ্ঞান হারিয়ে এক সময় মারা যায়। এই ঘটনার পর থেকে প্রায় প্রতি রাতেই ওখানকার বেতগুলো মাটিতে হেলে পড়ে। হাঁটাপথ রুদ্ধ করে দেয়। অদ্ভুতুড়ে শব্দ খেলা করে বাতাসে বাতাসে। তাই জরুরি না হলে ওপথ মাড়াতে সাহস হয় না কারোরই।
রাজু। বিমলের বড় চাচার ছেলে। শহরে পড়ে। ছুটিছাটায় গ্রামে আসে। ভাইবোনের সঙ্গে বেশ কাটে সময়। রাজু মেধাবী ছাত্র। বইয়ের পাতায় আঠার মতো লেগে থাকে। তবে সময় পেলে লেখালেখিও করে। তার লেখা চমৎকারভাবে প্রকাশিত হয়। রাজু ভাবে, এবার অদ্ভুত ও অন্যরকম কিছু লেখার চেষ্টা করবে।
০২.
রাজু আর বিমলের বন্ধুত্ব গভীর। যদিও বিমল বয়সে দুই-তিন বছরের বড়। তারপরও ওদের মনের মিলটা বেশি। রাজু সুযোগ পেলেই ছুটে আসে সূর্যতলীতে। আর বিমলও সব কাজ সরিয়ে সঙ্গ দেয় রাজুকে। এ বছর এসএসসি পরীক্ষার ছুটিতে রাজু বেড়াতে এসেছে। আর বিমলের হাতেও প্রচুর সময়। কেননা, মাত্র কলেজ সেকেন্ড ইয়ারের প্রথম সাময়িকী শেষ হয়েছে। ওরা দীঘি পেরিয়ে হাঁটছিল। গল্প বুনতে বুনতে কখন যে গনি দাদার দোকান, বুড়ো বট, আমড়াতলা ছাড়িয়ে ইটরাস্তায় উঠে পড়েছে_ খেয়ালই করেনি। রাজু তো বকবক করেই চলেছে। শহরের দালান-গাড়ি-ভিড়ভাট্টার কথা, তাদের স্কুলের কথা, এসএসসি পরীক্ষার অভিজ্ঞতার কথা।
হঠাৎ বিমল চমকে উঠে বলে, 'রাজু, দাঁড়া ভাই...'
'কেন!'
'আমরা তো দেখি বেতঝাড়ের দিকে যাচ্ছি!'
'তো...?' _অবাক হয় রাজু।
'আগে বাসায় চল, তারপর বলব।' _রাজুর হাত ধরে টানতে টানতে ঘরে ছোটে বিমল। অবাক রাজুকে পুকুর ঘাটে বসিয়ে-পাগল লোকটা থেকে শুরু করে চৌধুরীর ছোট ছেলে পর্যন্ত টুকরো টুকরো ঘটনা সব খুলে বলে। অভিশপ্ত বেতঝাড় উন্মোচিত হয় রাজুর দৃষ্টি উঠানে।
সবকিছু শোনার পর থেকেই রাজু সারা বিকেল বসে ভাবে। কিছু লিখে, কিছু হিসাব কষে। সন্ধ্যা ঘনালে বিমলকে খুলে বলে মনের কথা। সব শুনে বিমল কিছুক্ষণ ধুম ধরে থাকে।
০৩.
রাত দশটা। গনি দাদার দোকানটা তখনও খোলা। দাদা ভেতরে ঝিমুচ্ছেন। রাজু আর বিমল ধীরে ধীরে হাঁটতে থাকে। এই নীরব অন্ধকারে নিজেদের উপস্থিতি কাউকে জানতে দিতে চাচ্ছে না তারা। হাঁটতে হাঁটতে এসে দাঁড়ায় ইট জড়ানো ভাঙা রাস্তাটাতে।
অন্ধকারে বিশাল দানোর মতো লাগছে ঝাড়টাকে। রাজু ও বিমল পা টিপে টিপে হেঁটে চলে ঝাড়ের ধারে।
খট্ মট্ খট্ মট্...। শরর্ শরর্...। অদ্ভুত অদ্ভুত আওয়াজ বাজতে থাকে বাতাসে বাতাসে। ভীষণ অন্ধকার এদিকটায়। এতটাই যে, চোখ পর্যন্ত ডুবে থাকতে চায়। গাছে গাছে পাতাগুলোর খুনসুটি। শুকনো পাতা গড়াগড়ি খায়, শব্দ তোলে মড়্ মড়্...। বিমল হঠাৎ চমকে ওঠে। আঁকড়ে ধরে রাজুর কাঁধ। আচমকা যেন বন্ধ হয়ে যায় বাতাস। খুব বেশি নীরব হয়ে ওঠে চারদিক। ডুব দেয় আকাশের এক চিলতে চাঁদটাও। পাতাগুলো নড়তেও ভুলে যায় যেন।
অন্ধকারে ভ্যাবাচ্যাকা খায় বিমল। বার কয়েক চমকে ওঠে রাজুর স্পর্শেও। অদ্ভুত শব্দ ভেসে আসে বেতঝাড়টা থেকে। কেমন একটা হুটোপুটির। ভূতেরা নাচছে_ ভাবতেই চোখ বন্ধ করে ফেলে বিমল। ছেলেটা ভয়ে কাঁপছে। হঠাৎ পট্ পট্ পট্...!
ওদের চোখের সামনেই বেতের একটা পাটি মাটিতে নেমে আসে। যেন পথরুদ্ধ করতে চাইছে। ক্যাৎ-ক্যাৎ... ফ্যাৎ-ফ্যাৎ...। পরপর হেলে পড়ে আরও তিন-চারটা পাটি।
'বাবা গো, ভূতে জান নিলো গো...' _বলে উল্টো পথে দৌড় দেয় বিমল। রাজু নিজেও চমকে ওঠে। পৌষের শীতেও ঘামতে থাকে ওর শরীর। কিন্তু সে সাহস সঞ্চয় করে। কাঁধে ঝোলানো ডিজিটাল ক্যামেরাটা বের করে।
ক্লিক... ক্লিক... ক্লিক...!
কাঁপা হাতে পাঁচ-ছয়টা ছবি তুলে ঘুরেই দৌড়। অনেকটা দূরে এসে ক্যামেরার স্ক্রিনে চোখ রাখে। ভাবে, গাঢ় অন্ধকার। তা ছাড়া ভূতদের নাকি আলোতে দেখা যায় না; অন্ধকারেও না। মোট কথা, ভূতদের ছবি ওঠানো অসম্ভব। ওরা তো ছায়া। তবুও স্ক্রিনে ছবিগুলো চলমান। হেলেপড়া বেতের আগায় বসে আছে বড়সড় বনবিড়াল। জ্বলজ্বলে চোখ। আরেকটা ছবিতে একটা বনবিড়াল বেত বাইছে...!
পরের ঘটনা হলো, রাজু বিমলকে খুঁজে ওকে সঙ্গে নিয়ে আবার যায় বেতঝাড়ে। লাঠি হাতে হুশ হুশ তাড়া দিতেই হুড়োহুড়ি করে পালিয়ে বাঁচে ধূসর রঙের বনবিড়ালগুলো।
রাতের ঠাণ্ডা হাওয়ায় নিশাচর প্রাণীগুলো বেতঝাড়ে খেলা করতে এসে থাকে। বনবিড়ালের ভারে হাল্কা বেতগুলো নুইয়ে পড়ে, আর মানুষ ভাবে 'ভূত'! রাজু আর বিমল হেসেই বাঁচে না। বীরদর্পে রওনা হয় বাড়ির পথে ফিরে গিয়ে সবাইকে ভূতের ছবি দেখাবে বলে।

No comments

Powered by Blogger.