কালের পুরাণ-আওয়ামী লীগ কি সত্যিই বিপদে পড়েছে? by সোহরাব হাসান


দুই সপ্তাহ আগে ১৪ দলের একজন প্রভাবশালী নেতা ও সাংসদ অভিযোগ করেছিলেন, ‘সরকার আমাদের কোনো পরামর্শ নেয় না।’ আওয়ামী লীগ ওরফে মহাজোট সরকার ক্ষমতায় এসেছে প্রায় তিন বছর হলো। এর মধ্যে ১৪ দলের শীর্ষস্থানীয় নেতাদের কোনো বৈঠক হয়নি। জোটের প্রধান শরিক আওয়ামী লীগ না চাইলে কীভাবে বৈঠক হবে? নির্বাচনের পর আওয়ামী লীগের নেতাদের হাবভাব দেখে মনে হতো, দেশ চালাতে ১৪ দল বা মহাজোটের শরিকদের


বুদ্ধি-পরামর্শের প্রয়োজন নেই। নাগরিক সমাজ বা গণমাধ্যমের সমালোচনাও আমলে নেওয়ার দরকার নেই। কেননা আওয়ামী লীগে এত বাঘা বাঘা নেতা আছেন, যাঁরা চোখ বন্ধ করেও দেশ চালাতে পারেন। দেশের সব সমস্যার সমাধান তাঁদের নখদর্পণে।
১৪ দলীয় ওই নেতার আক্ষেপ প্রকাশের ১৫ দিনের মধ্যে দেখা গেল, প্রধানমন্ত্রী ও আওয়ামী লীগ সভানেত্রী শেখ হাসিনা তাঁর সরকারি বাসভবন গণভবনে ১৪ দলের শীর্ষস্থানীয় নেতাদের নিয়ে ‘সফল’ বৈঠক করলেন। আগের দিন তিনি বসলেন আওয়ামী লীগের কাছে এখন ‘প্রায় অচ্ছুৎ’ বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টির (সিপিবি) নেতাদের সঙ্গেও। সিপিবি একসময়ে ১৪ দলের শরিক হলেও গত নির্বাচনে আওয়ামী লীগ তাদের ‘বয়কট’ করে এবং সিপিবিও নিজ শক্তিতে এগোনোর চেষ্টা চালায়।
তার পরও কিছু কিছু বিষয় থাকে, যার সঙ্গে জাতির অস্তিত্বের প্রশ্ন জড়িত। যুদ্ধাপরাধের বিচার হলো তেমন একটি বিষয়। এ ব্যাপারে সিপিবির নেতারা যুগপৎ আন্দোলনের যে প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন, আমরা তাকে স্বাগত জানাই। তবে এই যুগপৎ কত দিন স্থায়ী হবে, সে ব্যাপারে সন্দেহ আছে। পরিস্থিতি অনুকূল দেখলেই আওয়ামী লীগ নেতারা মুখ ফিরিয়ে নেবেন। আওয়ামী লীগের ভেতরেরই একটি মহল কমিউনিস্ট নাম শুনলে তিনবার তওবা করেন এবং এখনো সাবেক ও বর্তমান সিপিবির নেতাদের বিরুদ্ধে লাগাতার অপপ্রচার চালাচ্ছে।
১৪ দলের বৈঠকেও যুদ্ধাপরাধের বিচার বানচাল করতে বিএনপি ও জামায়াতে ইসলামী যে ষড়যন্ত্র করছে, তা প্রতিহত করতে সারা দেশে সাংগঠনিক শক্তি জোরদারের তাগিদ দেওয়া হয়েছে। খুবই আশাব্যঞ্জক খবর।
পত্রপত্রিকায় এই খবর পাঠ এবং টিভি চ্যানেলে শোনার সময় ২০০৪ সালে ১৪ দল গঠনের সময় আওয়ামী লীগের তৎকালীন সাধারণ সম্পাদক আব্দুল জলিলের সেই বিখ্যাত উক্তির কথা মনে পড়ল। তিনি বলেছিলেন, ‘১৪ দল একসঙ্গে আন্দোলন করছে, একসঙ্গে নির্বাচন করবে এবং একসঙ্গে সরকার গঠন করবে।’
একসঙ্গে আন্দোলন করে ১৪ দল জয়ী হয়েছে এবং সরকারও গঠন করেছে। তবে সেটি ১৪ দলের সরকার নয়, আওয়ামী লীগের। নির্বাচনে জাসদ ও ওয়ার্কার্স পার্টির জন্য গুটি কয়েক আসন ছেড়ে দিলেও অন্য কোনো দলকে একটি আসনও দেওয়া হয়নি। গণতন্ত্রী পার্টির সভাপতি নুরুল ইসলামকে মনোনয়ন দেওয়া হলেও রহস্যজনকভাবে তিনি পুত্রসহ নিজের ফ্ল্যাটে অগ্নিদগ্ধ হয়ে মারা যান নির্বাচনের আগেই। এটি কি নিছকই দুর্ঘটনা? পরবর্তীকালে সংরক্ষিত আসনে ন্যাপ থেকে আমেনা আহমেদ ও কবি রুবী রহমানকে সাংসদ করা হয়েছে। ১৪ দলের সরকার বলতে ওটুকুই। আওয়ামী লীগের বাইরে ১৪ দল থেকে যে একজন মন্ত্রী নেওয়া হয়েছে, তিনি ‘এক নেতা এক দল’ দিলীপ বড়ুয়া। শেখ হাসিনার অনুরোধে তিনি নির্বাচনে প্রার্থী হননি। এ কারণে তাঁকে মন্ত্রী করা হয়েছে। কিন্তু ওয়ার্কার্স পার্টি ও জাসদ থেকে মন্ত্রী হওয়ার মতো উপযুক্ত লোক খুঁজে পাননি তিনি, কিংবা নিজ দলের জ্যেষ্ঠ নেতাদের মধ্যে থেকেও। প্রধানমন্ত্রী দলের তরুণ ও তাঁর প্রতি অন্ধ অনুগতদের নিয়ে যখন মন্ত্রিসভা গঠন করেন, সবাই তাঁকে স্বাগতই জানিয়েছিলেন। কিন্তু তারুণ্যের সঙ্গে মেধা ও অভিজ্ঞতার যে সংমিশ্রণ থাকা দরকার, তা অনেকেরই নেই। আর বর্তমান শাসনব্যবস্থায় প্রধানমন্ত্রী একাই যখন সবকিছু দেখভাল করেন, তখন অন্যদের গুরুত্ব থাকে না। কে মন্ত্রী হলেন, কে হলেন না তাতেও খুব একটা যায়-আসে না।
সিপিবি ও ১৪ দলের সঙ্গে শেখ হাসিনার বৈঠকের কথা শুনে এক সাংবাদিক সহকর্মী মন্তব্য করেন, ‘তাহলে কি আওয়ামী লীগ বিপদে পড়েছে?’ জিজ্ঞেস করলাম, ‘কেমন?’ তিনি বললেন, ‘আওয়ামী লীগ বিপদে না পড়লে কখনো ঐক্য করে না।’ ১৯৭২ সালে যখন ন্যাপ ও কমিউনিস্ট পার্টির পক্ষ থেকে ঐক্য করা ও জাতীয় সরকার গঠনের দাবি জানানো হলো, তখন আওয়ামী লীগ সেই দাবি আমলেই নেয়নি। আওয়ামী লীগ নেতারা মাঠে-ময়দানে ঐক্য নিয়ে ব্যঙ্গ-বিদ্রূপ করতেন। কিন্তু যখন চারদিকে দুর্যোগ ঘনিয়ে এল, দেশের অর্থনৈতিক অবস্থা খারাপ হতে লাগল, নকশালপন্থীদের উৎপাত বাড়ল, তখন আওয়ামী লীগ ঐক্যের তাগিদ অনুভব করল এবং গঠিত হলো গণতান্ত্রিক ঐক্যজোট—গজ। কিন্তু তত দিনে দেশের সর্বনাশ যা হওয়ার হয়ে গেছে।
পঁচাত্তরের রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর আওয়ামী লীগ আন্দোলনের স্বার্থে বহুবার সমমনা ও অসমমনাদের সঙ্গে ঐক্য করেছে। আবার দলীয় স্বার্থে ঐক্য ভেঙেছে। ১৯৯১ সালের নির্বাচনের আগে ৮ দলীয় জোটের আসন ভাগাভাগি নিয়ে আওয়ামী লীগ নেতারা যে তেলেসমাতি কাণ্ড ঘটিয়েছিলেন, তাতেই ফলাফল নির্ধারিত হয়ে গিয়েছিল। তখন আওয়ামী লীগ নেতারা ৩০০ আসনেই জয়ের স্বপ্ন দেখছিলেন। কিন্তু ১০০ আসনেও জিততে পারেননি। স্বীকার করি, কোনো কোনো ক্ষেত্রে শরিকদের অযৌক্তিক দাবি ছিল। কিন্তু নির্বাচন হওয়ার আগেই আওয়ামী লীগের শীর্ষস্থানীয় নেতারা যখন সম্ভাব্য মন্ত্রিসভায় কে কোন দপ্তর নেবেন, সেই হিসাব-নিকাশ করতে মশগুল ছিলেন, তখন মানুষ নির্বাচনে আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধেই সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছে।
কিন্তু এখন রাজনীতিতে যে বিপদের কথা শোনা যাচ্ছে, তা কি আওয়ামী লীগের না সরকারের? বিপদটা যদি এমন হতো যে, আওয়ামী লীগ তার নির্বাচনী কর্মসূচি বাস্তবায়ন করতে বাধার সম্মুখীন হচ্ছে, পদ্মা সেতু বা পার্বত্য চুক্তি বাস্তবায়নে বিরোধী দল বাধা দিচ্ছে, তিস্তার পানি বণ্টনে তারা সহযোগিতা করছে না, তাহলে অবশ্যই দেশবাসী আওয়ামী লীগের পক্ষে শক্ত অবস্থান নিত। আর যদি বিষয়টি এমন হয়, আওয়ামী লীগ নিজের খোঁড়া খাদে পা দিয়েছে, একটার পর একটা নির্বাচনী প্রতিশ্রুতি ভঙ্গ করে চলেছে, তাহলে কেন মানুষ তার পক্ষে দাঁড়াবে? আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীরা, সাংসদেরা সারা দেশে যে জবরদখল চালাচ্ছেন, তার দায় কেন নেবে শরিকেরা?
আওয়ামী লীগ যদি বাহাত্তরের সংবিধান পুনঃপ্রতিষ্ঠা করার উদ্যোগ নিত, ঘুষ-দুর্নীতি বন্ধে কঠোর পদক্ষেপ নিত, দেশের মানুষই তা অবশ্যই সমর্থন করত। কিন্তু যেখানে ছাত্রলীগ ক্যাম্পাসে ক্যাম্পাসে তাণ্ডব চালাচ্ছে, যুবদল ও আওয়ামী লীগের কর্মীরা টেন্ডারবাজি, দখলবাজি ও চাঁদাবাজি করছে, সেখানে মানুষ কেন আওয়ামী লীগকে সমর্থন করবে? কেন তার পাশে এসে দাঁড়াবে?
আওয়ামী লীগ এখন যে বিপদে পড়েছে, সেটি দেশি-বিদেশি চক্রান্তের ফল কতটা, আর কতটা নিজেদের তৈরি, তা-ও খতিয়ে দেখা প্রয়োজন। কিছুদিন আগেও যেসব অর্থনীতিবিদ, ব্যবসায়ী দেশের অর্থনীতি সঠিক অবস্থায় আছে বলে সার্টিফিকেট দিতেন, তাঁরা এখন প্রমাদ গুনছেন। সরকারের নীতির সঙ্গে দ্বিমত পোষণ করছেন। উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন ব্যবসায়ীরাও।
গত তিন বছরে যুদ্ধাপরাধের বিচারকাজ শুরু করা এবং কৃষি, শিক্ষা খাত ছাড়া সরকারের কোথায় সাফল্য আছে? পররাষ্ট্রনীতিতে তারা লেজেগোবরে অবস্থা করে ফেলেছে। আগের একটি লেখায় মালয়েশিয়ায় অবৈধ শ্রমিকদের বৈধতাদানকে সরকারের অন্যতম সাফল্য বলে উল্লেখ করেছিলাম। এর প্রতিবাদ জানিয়েছেন মালয়েশিয়ায় বসবাসকারী এক বাঙালি অভিবাসী শ্রমিক। তিনি ই-মেইলে জানিয়েছেন, ‘এটি মালয়েশিয়া সরকারের নীতির কারণে হয়েছে। বাংলাদেশের মতো পাকিস্তান ও অন্যান্য দেশের শ্রমিকেরাও এই সুযোগ পেয়েছেন। অতএব, এতে সরকারের কোনো কৃতিত্ব নেই।’
ক্ষমতায় এসে আওয়ামী লীগ দুটি ক্ষেত্রে সাফল্য দাবি করে এসেছিল—পররাষ্ট্রনীতি ও অর্থনৈতিক ব্যবস্থাপনা। তিন বছর পর এসে দেখা গেল, এ ক্ষেত্রেও সরকারের অর্জন খুবই সামান্য। বাংলাদেশ জঙ্গিবাদের আস্তানা বলে যে দুর্নাম ছিল, সরকার তা ঘুচিয়েছে বলে দাবি করে। আমরা এ দাবির সঙ্গে দ্বিমত করছি না। কিন্তু এই জঙ্গিবাদের বিরুদ্ধে সবচেয়ে সোচ্চার ও উদ্বিগ্ন দুটি দেশ যুক্তরাষ্ট্র ও ভারতের সঙ্গে কেন সরকারের টানাপোড়েন চলছে? মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী হিলারি ক্লিনটন প্রধানমন্ত্রীকে যে চিঠি দিয়েছেন কিংবা পররাষ্ট্রমন্ত্রীর সঙ্গে বিরস বদনে বৈঠক করেছেন; তাতে প্রমাণিত হয় না, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের আস্থা অর্জনে সরকার সক্ষম হয়েছে।
কূটনীতি হলো কৌশল ও স্বার্থের লড়াই। সেই লড়াইয়ে জিততে হলে কেবল সদিচ্ছা ও ব্যক্তিগত সম্পর্কই যথেষ্ট নয়। কূটনীতিতে নিজের হাতে থাকা অস্ত্রটি প্রতিপক্ষের হাতে তুলে দিলে লাভবান হওয়ার সম্ভাবনা খুবই কম। ভারতের সঙ্গে সম্প্রতি যে টানাপোড়েন লক্ষ করা যাচ্ছে, তার কারণ আমরা ভারতের সব দাবি মেনে নিয়েছি, তারা আমাদের ন্যায়সংগত দাবিও নাকচ করতে চাইছে। সব মিলিয়ে মনে হচ্ছে ‘দিল্লি হনুজ দূর অস্ত।’
ক্ষমতার তিন বছরের মাথায় এসে মনে হচ্ছে, সরকার নিজে সংকটে পড়েছে, দেশকেও সংকটে ফেলেছে। এই সংকটটি যদি নিছক রাজনৈতিক হতো, ১৪ দলসহ সুহূদেরা আওয়ামী লীগকে উদ্ধার করতে পারত। কিন্তু সংকটটি যখন অর্থনৈতিক এবং আওয়ামী লীগের নিজেরই সৃষ্ট, তখন তাকেই সমাধান খুঁজে বের করতে হবে। কেননা দেশটা চালাচ্ছে আওয়ামী লীগই।
সোহরাব হাসান: কবি, সাংবাদিক।
sohrab03@dhaka.net

No comments

Powered by Blogger.