অভিমত-নির্বাচন কমিশন গঠন: একটি বিকল্প প্রস্তাব by মোহাম্মদ কায়কোবাদ

নির্বাচন কমিশনারদের মেয়াদকাল শেষ হয়ে যাচ্ছে শিগগিরই। তাই গণমাধ্যমে পরবর্তী কমিশন গঠনের বিষয়ে খবরাখবর প্রকাশিত হচ্ছে। এ ব্যাপারে একটি সমঝোতায় আসার লক্ষে রাষ্ট্রপতি সব দলের সঙ্গে সংলাপ শুরু করেছেন। প্রথম দিন জাতীয় পার্টি ও জাসদ নেতারা তাদের মতামত জানিয়েছেন। যেকোনো জাতীয় আঞ্চলিক ও ব্যক্তিগত ইস্যুতে উভয় দলের পরস্পর বিপরীত অবস্থান গ্রহণের প্রেক্ষাপটে যেকোনো সংলাপের সাফল্য সম্পর্কে


সন্দেহ থেকেই যায়। পরমতসহিষ্ণুতা, পরের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হওয়া গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার অত্যন্ত উল্লেখযোগ্য পূর্বশর্ত। দুর্ভাগ্যজনকভাবে আমাদের এই গুণাবলির বড়ই অভাব। ফলে নিয়মিতভাবে গণতান্ত্রিক উত্তরণের পথে স্খলন হচ্ছে। যেকোনো ইস্যুতে একটি দলের মতামত জানা থাকলে অন্য দলের মতামত সহজেই অনুমান করা যায়। এমতাবস্থায় নির্বাচন কমিশন গঠনের বিষয়টি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এ কথা বলার অপেক্ষা রাখে না যে, এমনকি দুটি দলকে নিয়ে একসঙ্গে বসাও যথেষ্ট কঠিন হয়ে দাঁড়িয়েছে। ফলে সরকারের কিংবা নির্বাচন কমিশনের নানা আমন্ত্রণেও বিরোধী দল সাড়া দেয়নি। সম্ভবত কেবল সমঅধিকারের ভিত্তিতে যদি কোনো সংলাপ অনুষ্ঠিত হয়, তাহলে হয়তো উভয় দল সম্মত হবে। সেই বিবেচনায় রাষ্ট্রপতির সংলাপ উদ্যোগটি ভালো।
এর আগে জাতীয় দৈনিকের মাধ্যমে তত্ত্বাবধায়ক সরকার প্রতিষ্ঠার বিষয়েও একটা প্রস্তাব একাধিকবার দিয়ে সংশ্লিষ্ট বিজ্ঞমহলের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে ব্যর্থ হয়েছি। ‘একবার না পারিলে দেখ শতবার’ আপ্তবাক্যটি কার্যকারিতা সম্পর্কে নিশ্চিত না হলেও আবার একই রকম ফর্মুলার প্রস্তাব করছি।
বর্তমানের উভয় দলের মধ্যে দূরত্ব এত বেশি, অবিশ্বাসের শিকড়ে এমনভাবে প্রোথিত যে প্রধান নির্বাচন কমিশনার হিসেবে আওয়ামী লীগ যদি কট্টর বিএনপিপন্থী একজনের নাম অথবা বিএনপি যদি কট্টর আওয়ামীপন্থী কারও নাম প্রস্তাব করে বসে, তাহলেও অপর দল সন্দেহ করবে এবং সম্মত হতে পারবে না। সুতরাং নির্বাচনের প্রক্রিয়াটি হতে হবে সমতার ভিত্তিতে, যেখানে একজনের প্রস্তাব জানার পর অন্য দলের সিদ্ধান্ত পাল্টানোর সুযোগ থাকবে না। আর দেশের জন্য অতি গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্তগুলো যদি সাধারণ জনগণের চোখের সামনেই ঘটে, তাহলে গোটা প্রক্রিয়ায় স্বচ্ছতা যেমন নিশ্চিত হয়, ঠিক তেমনি তাতে সাধারণ মানুষের আস্থাও তৈরি হবে। দর্শক হিসেবে গোটা প্রক্রিয়ায় সাধারণ মানুষের অংশগ্রহণও পদ্ধতির গ্রহণযোগ্যতায় অবদান রাখবে। প্রকৃতপক্ষে অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচনের জন্য শক্তিশালী ও সবার আস্থাভাজন একটি নির্বাচন কমিশনের প্রয়োজনীয়তা অনস্বীকার্য। এই মুহূর্তে বর্তমান নির্বাচন কমিশনের মেয়াদ যেহেতু শেষ হচ্ছে, উভয় বড় দলের কাছে গ্রহণযোগ্য একটি নির্বাচন কমিশন গঠন নিয়মিত ছন্দপতনের গণতান্ত্রিক সংস্কৃতিকে জোরদার করতে উল্লেখযোগ্য অবদান রাখতে পারে। এবার আমরা মূল প্রস্তাবে আসি।
কোনো একটি ছুটির দিনে জাতীয়সহ অন্যান্য প্রাইভেট টিভি চ্যানেলের মাধ্যমে নির্বাচন কমিশন গঠনের গোটা প্রক্রিয়া সম্প্রচার করলে সাধারণ জনগণ উৎসব করে এই প্রক্রিয়ার সঙ্গে সম্পৃক্ত হতে পারে এবং এর নিরপেক্ষতার সাক্ষী হতে পারে।
উভয় দলের প্রতিনিধিরা তাঁদের কাছে গ্রহণযোগ্য ব্যক্তিদের তালিকাসংবলিত একটি সফট কপি নিয়ে টেলিভিশন প্রোগ্রামে অংশগ্রহণ করবেন। নামের বানান কিংবা অন্যান্য অসংগতি যাতে না থাকে, আমরা জাতীয় পরিচয়পত্রের তথ্যাদির ওপর আশ্রয় নিতে পারি। এবার একটি কম্পিউটার প্রোগ্রাম দিতে উভয় দলের তালিকার প্রথম ১০ জনের মধ্যে মিল খুঁজতে পারি। মিল পেয়ে গেলে তাঁকেই আমরা প্রধান নির্বাচন কমিশনার হিসেবে ঘোষণা দিতে পারি। আর তা পাওয়া না গেলে শুরু থেকে ২০ জন, ৩০ জন, ৪০ জনের তালিকার মধ্যে মিল খোঁজার চেষ্টা করব, যতক্ষণ না উভয় তালিকায় একজনের নাম পাওয়া না যায়। যেহেতু প্রক্রিয়াটি সম্পর্কে উভয় দলই পূর্বাহ্নে অবহিত হবেন এবং যেহেতু যতক্ষণ না মিল পাওয়া যায়, ততক্ষণ টেলিভিশন পর্দার সামনে উভয় দলের প্রতিনিধিদের থাকতে হবে। আমরা আশা করি, উভয় দলই উভয় দলের কাছে সম্ভাব্য গ্রহণযোগ্য ব্যক্তিদের দিয়ে তাদের তালিকা সমৃদ্ধ করব। প্রতিবারই যখন মিল পাওয়া যাবে প্রোগ্রামের সঞ্চালক সমগ্র দেশবাসীকে জানিয়ে দেবে। যেমন প্রথম ১৮০ জনের তালিকায়ও কোনো মিল খুঁজে পাওয়া গেল না। এর মধ্যে আবার টেলিভিশন চ্যানেলের ভ্রাম্যমাণ সংবাদদাতারা চলমান প্রক্রিয়ার ওপর নানা মন্তব্য করে অনুষ্ঠানটি হূদয়গ্রাহীও করতে পারেন।
এভাবে শুধু প্রধান নির্বাচন কমিশনার নয়, নির্বাচন কমিশনারদের একইভাবে স্বচ্ছভাবে নিরপেক্ষতা বজায় রেখে সব দেশবাসীর সামনে এই প্রক্রিয়ায় নিয়োগ দেওয়া সম্ভব। তবে প্রতিবার তালিকার দৈর্ঘ্য কত করে বৃদ্ধি করা হবে, এসব বিষয় অন্য রকম সিদ্ধান্তও গ্রহণ করা যেতে পারে। যদি কোনো সময় তালিকায় একাধিক প্রার্থী কমন হয়, তাহলে কাকে নেওয়া হবে, তার জন্যও নিয়মকানুন করে দেওয়া যেতে পারে। যেমন, উভয় তালিকায় ক্রমিক নম্বরের যোগফল সর্বনিম্ন কিংবা ক্রমিক নম্বরের ব্যবধান সর্বনিম্ন ইত্যাদিও টাইব্রেকের নিয়ম হিসেবে ব্যবহার করা যেতে পারে। তবে উভয় তালিকায় যে একই ব্যক্তির নাম রয়েছে, তার জন্য প্রয়োজন ভোটার নম্বর কিংবা জাতীয় পরিচয়পত্রের নম্বরের মতো গ্রহণযোগ্য একটি নিবন্ধন। বর্তমান সরকার ডিজিটাল বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার প্রত্যয় ঘোষণা করেছে। পৃথিবীর জনঘনত্বের ২৪ জন বেশি জনঘনত্বের দেশে, বিপুল চাহিদা ও সীমিত সম্পদের দেশে আমাদের প্রতিটি কর্মকাণ্ড উৎপাদনশীল হওয়ার বিকল্প নেই। যেকোনো ক্ষেত্রে উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধি, সর্বজনীন প্রযুক্তি হলো তথ্য ও যোগাযোগপ্রযুক্তি। এই প্রযুক্তি ব্যবহার করে আমাদের গণতান্ত্রিক সংস্কৃতি বিকাশের পথে গুরুত্বপূর্ণ, অন্তত বর্তমান সময়ের পরিপ্রেক্ষিতে নির্বাচন কমিশন গঠনে তথ্যপ্রযুক্তির ব্যবহারও হবে যুগোপযোগী।
মোহাম্মদ কায়কোবাদ: অধ্যাপক, বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় (বুয়েট) ও ফেলো, বাংলাদেশ একাডেমি অব সায়েন্সেস।

No comments

Powered by Blogger.