নোবেল শান্তি পুরস্কার-নারী জাগরণের নতুন প্রেরণা

হিংসা ও বিদ্বেষকবলিত পৃথিবীতে পরম আরাধ্য হলেও শান্তি অধিকাংশ সময়েই অধরা ও দুর্লভ অভিজ্ঞতা। তাই শান্তির সামান্যতম সম্ভাবনাতেও শান্তিকামী মানুষেরা দু'হাত তুলে নিজেদের সমর্থন জানাতে কার্পণ্য করে না। কিন্তু শান্তির পথ অনেক সময়েই কুসুমাস্তীর্ণ নয়, বরং অধিকাংশ সময়েই তা কণ্টকাকীর্ণ। শান্তি প্রতিষ্ঠার জন্য জনগোষ্ঠীগুলোর নিরন্তর সংগ্রাম, আত্মত্যাগ ও রক্তপাতের দীর্ঘ ইতিহাস বারবার সে কথাই বলে যায়।


যুদ্ধবিধ্বস্ত আফ্রিকার দেশে দেশে শান্তি প্রতিষ্ঠার তীব্র সংগ্রামের ইতিবৃত্ত যেমন বিশ্ববাসীর জানা, তেমনি আরব বিশ্বে শান্তি প্রতিষ্ঠার জন্য সাধারণ জনগণের সাম্প্রতিক আত্মত্যাগের ইতিহাসও যাপন করে চলেছে সকলে। এই প্রেক্ষাপটে সবার চোখ ছিল নরওয়েজিয়ান নোবেল কমিটির দিকে। নিজেদের মতো করে নোবেল শান্তি পুরস্কারের পূর্বাভাস দেওয়ার চেষ্টাও চলছিল। তাতে কখনও আলোচনায় আসছিলেন তিউনিসিয়ার কোনো ব্লগার, মিসরের কোনো রাজনৈতিক কর্মী বা সিরিয়ার কোনো অনলাইন অ্যাক্টিভিস্ট। এই প্রথমবারের মতো লোকে কোনো বিশ্বনেতা বা পরিচিত ব্যক্তিত্বের বদলে সাধারণ একটি নাম ভাবতে শুরু করেছিল। মানুষের এ ভাবনা খুব ভুল প্রমাণিত হয়নি। অতিপ্রত্যাশিতভাবেই নোবেল শান্তি পুরস্কারের ঘোষণায় জানা গেল, এবার তিন নারী পুরস্কারে ভূষিত হয়েছেন। আর তাদের দু'জন অত্যন্ত সাধারণ নারী। নিজেদের সাধারণ কর্মী বলে পরিচয় দিতেই তারা গর্ববোধ করেন। লাইবেরিয়ার লেমাহ গবোই ও ইয়েমেনের তাওয়াক্কুল কারমান নারী জাগরণের সক্রিয় কর্মী। শান্তি প্রতিষ্ঠার জন্য নারীশক্তির ঐক্য ও নারী অধিকার আদায়ের জন্য তাদের দু'জনের সংগ্রাম চলমান। শান্তি পুরস্কার বিজয়ী তৃতীয় নারী ইলেন জনসন সিরলিফ লাইবেরিয়ার প্রেসিডেন্ট হলেও তারও লক্ষ্য সেই নারী জাগরণ ও নারী অধিকার আদায়। অর্থনীতিবিদ হিসেবে খ্যাত এই নারী যুদ্ধবিধ্বস্ত লাইবেরিয়াকে একত্রিত করেছেন। উন্নয়ন ও অগ্রগতির নিভে যাওয়া প্রদীপ নতুন করে জ্বালিয়েছেন। এক মেয়াদ শেষ করে আবারও তিনি নির্বাচনে দাঁড়িয়েছেন। ইলেন জনসন সিরলিফের সহযোগী লেমাহ গবোই তরুণ নেতৃত্বের প্রতিভূ। পশ্চাৎপদ লাইবেরিয়ার উন্নয়নের জন্য তিনি সেখানকার মুসলিম ও খ্রিস্টান নারীদের ঐক্যবদ্ধ করেছেন। তাদের নিয়ে জোরদার আন্দোলন করে যুদ্ধের বিরুদ্ধে নিজেদের মনোভাব জানিয়েছেন। আর সেই আন্দোলনের ফলেই ক্ষমতাসীন হতে পেরেছেন সিরলিফ। লাইবেরিয়ার মতো দেশের নারী আন্দোলনের এ দুই পথিকৃতের সম্মাননা বিশ্বের সব দেশের নারীর জন্য অনন্য অনুপ্রেরণার উৎস হয়ে থাকবে। পুরস্কারের প্রতিক্রিয়ায় লেমাহ গবোই বলেছেন, 'আমি মহান কিছু করিনি। কিন্তু এটি আমার হাতের ছোট প্রদীপটিকে আলো জোগাবে। আমার প্রদীপটিকে অন্ধকারে জাগিয়ে রাখবে।' এমনই এক অন্ধকার জগতের আরেক প্রতিনিধি তাওয়াক্কুল কারমান। বহু বছরের দুঃশাসন যে আরব বিশ্বকে এক বদ্ধ অচলায়তনে পরিণত করেছে সেখানে তীব্র শোষণ, বঞ্চনা ও নিপীড়নের মধ্য থেকে এ সাংবাদিক নারী অধিকার আদায়ের জন্য সোচ্চার হয়েছেন, গণতন্ত্র ও স্বাধীনতার কথা বলেছেন। আজ সবাই জানেন, আরব বিশ্বের সাম্প্রতিক জাগরণ, যাকে আরব বসন্ত নামে অভিহিত করা হচ্ছে তাতে নারীর বড় অংশীদারিত্ব আছে। তিউনিসিয়া, মিসর, ইয়েমেন, লিবিয়া, সিরিয়া হয়ে আরব জাগরণ নাড়া দিয়েছে পুরো আরব বিশ্বকে। বিশ্বের নানা প্রান্তে সে জাগরণ দোলা দিচ্ছে। বলা হচ্ছে, এ জাগরণ পৃথিবীকে নতুন এক যুগের সামনে উপস্থিত করেছে। আরব জাগরণে নাম জানা-না জানা বহু মানুষের আত্মত্যাগ ও সংগ্রাম আছে। সেই বহু মানুষের একেক জন প্রতিনিধির নাম ক্রমে আমরা জানতে পারছি। কারমান তাদের অন্যতম। কারমানের বিশিষ্টতা ইতিমধ্যে সবাইকে আকৃষ্ট করেছে। তিনি মুক্তচিন্তার ইসলামপন্থি। বিশেষজ্ঞদের মতে, তাকে স্বীকৃতি দিয়ে নোবেল কমিটি এই সত্য সকলের সামনে উপস্থাপন করল যে, একজন ইসলামপন্থি নারী গণতন্ত্রের সংগ্রামে জড়িত থাকতে পারেন, আর ইসলাম নারী স্বাধীনতার বিপক্ষে নয়, নয় গণতন্ত্র ও শান্তির বিপক্ষ শক্তিও। সব মিলিয়ে এবারের নোবেল শান্তি পুরস্কার বিশ্বের নারীদের জন্য একটি প্রয়োজনীয় বার্তা নিয়ে এসেছে। বাংলাদেশের নারীদের জাগরণের জন্যও এটি অনুপ্রেরণাদায়ক বলেই বিবেচিত হবে।

No comments

Powered by Blogger.