চাহিদার ৯০% মেটায় এখন দেশীয় কাগজের চোঙা-নল by শুভংকর কর্মকার

সুতার মিল ও পাটকলের সুতা অথবা কাপড় কিংবা কাগজ পেঁচিয়ে-মুড়িয়ে রাখতে ধারক হিসেবে ব্যবহূত হয় পেপার কোণ ও টিউব। পেপার কোণ হলো কাগজের পুরুস্তর দিয়ে তৈরি চোঙাকৃতির ধারকবিশেষ। টিউব হলো একইভাবে তৈরি গোলাকৃতির নল। দেশের সুতাকল, পাটকল ও বস্ত্র কারখানাগুলোর ক্রমবর্ধমান চাহিদা মেটাতে গত এক দশকে স্থানীয়ভাবে গড়ে উঠেছে এই শিল্প। সরকারের কিছু ইতিবাচক পদক্ষেপও এ খাতটির বিকাশে সহায়তা করেছে।


ফলে সুতাকল ও পাটকলগুলোর অন্যতম ‘পশ্চাদমুখী সংযোগ’ শিল্প হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে এই চোঙা-নলের উৎপাদন। দেশীয় চাহিদার প্রায় ৯০ শতাংশ মেটানো হচ্ছে স্থানীয় উৎপাদন দিয়েই।
অবশ্য সাম্প্রতিক সময়ের সুতা ব্যবসায় দুরবস্থার নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে এ খাতটিতে। অনেক ব্যবসায়ী ব্যবসা বন্ধ করে দিতে বাধ্য হয়েছেন।
এ খাতের ব্যবসায়ীদের অভিযোগ, চোঙা-নল সরবরাহ করলেও সুতার মিলমালিকেরা দীর্ঘদিন টাকা আটকে রাখেন। আবার মূল কাঁচামাল কাগজের দামদর অনেকটা ইচ্ছেমতো নিয়ন্ত্রণ করেন কাগজ ব্যবসায়ীরা। ফলে কাগজ ও আঠা দিয়ে এসব চোঙা ও নলের উৎপাদন ব্যাহত হয়।
দেশে একসময় হাতে তৈরি হতো কাগজের নল ও চোঙা। তবে ১৯৯৫ সাল থেকে দুই-তিনটি প্রতিষ্ঠান বিদেশ থেকে যন্ত্র আমদানি করে এগুলো তৈরি শুরু করে। সেই ধারাবাহিকতায় দেশের বিভিন্ন জায়গায় বর্তমানে দুই শতাধিকের বেশি প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠেছে। এরাই এখন দেশের প্রায় ৩০০ স্পিনিং মিল ও ১২০টি পাটকলের অধিকাংশটিতে পেপার কোণ ও টিউব সরবরাহ করছে। আর এ খাতটি ঘিরেই দেশে গড়ে উঠেছে একাধিক কাগজকল।
হালচিত্র: বাংলাদেশ পেপার কোণ অ্যান্ড টিউব ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যাসোসিয়েশন (বিপিসিটিএমএ) সূত্র জানায়, সমিতির নিবন্ধিত প্রতিষ্ঠানের সংখ্যা ৮৪। এসব প্রতিষ্ঠান বছরে প্রায় ৮০ কোটি পিস পেপার কোণ ও ৮০ হাজার মেট্রিক টন টিউব তৈরি করছে। আর এসব কাজের সঙ্গে যুক্ত আছেন ২৫ হাজারের বেশি মানুষ। এখন খাতটিতে বার্ষিক ৫০০ কোটি টাকার বেশি লেনদেন হয়।
সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা জানান, পাটকল কিংবা বস্ত্র কারখানায় কাগজের নলের সরবরাহ নিয়ে তেমন একটা সমস্যা নেই। এখানে চাহিদাও সীমিত। তবে স্পিনিং মিলগুলোর জন্য অধিক হারে প্রস্তুতকৃত পেপার কোণ নিয়েই ঝামেলায় আছেন ব্যবসায়ীরা। তাঁরাই বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন।
বিপিসিটিএমএর এক নেতা জানান, গত অর্থবছরে হঠাৎ আন্তর্জাতিক বাজারে তুলা ও সুতার দাম বেড়ে যায়। দাম আরও বাড়তে পারে—এ আশঙ্কায় তখন সুতার মিলমালিকেরা বিপুল পরিমাণ তুলা আমদানি করেন। চড়া দামের তুলা দিয়ে উৎপাদিত সুতার দামও বেশি হয়। একই সময় পোশাকশিল্পের মালিকেরা দেশি সুতা না কিনে ভারতসহ অন্যান্য দেশ থেকে কম মূল্যের সুতা আমদানি করেন। ফলে ওই সময় প্রায় আড়াই লাখ টন সুতা অবিক্রীত থেকে যায়। এসব কারণে বর্তমানে দেশে সুতা উৎপাদন কমে যাওয়ায় স্বাভাবিকভাবে পেপার কোণ ব্যবসায়ও ধস নামে।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, ২০০৬ সালে সরকার এসআরও জারি করে পেপার কোণ ও টিউব আমদানিতে শুল্কমুক্ত সুবিধা দেয়। এ সময় দেশের সুতা উৎপাদকেরা ভারত ও ইন্দোনেশিয়া থেকে এসব পণ্য আমদানি করতেন। পরে পেপার কোণ ও টিউব ব্যবসায়ীরা দেন-দরবার করলে গত বছর সরকার এক প্রজ্ঞাপনের মাধ্যমে পেপার কোণ ও টিউব আমদানিতে ৫ শতাংশ হারে শুল্ক আরোপ করে।
বিপিসিটিএমএর সাধারণ সম্পাদক এস এম সালাউদ্দিন প্রথম আলোকে বলেন, সরকারের প্রজ্ঞাপনের পর ব্যবসায়ীরা সুতা উৎপাদনকারীদের চাহিদা মেটাতে বিপুল পরিমাণ পণ্য উৎপাদন শুরু করেন। কিন্তু সুতার ব্যবসায় হঠাৎ মন্দাভাব চলে এলে পেপার কোণ ব্যবসায়ীরা ব্যাপক ক্ষতিগ্রস্ত হন। অনেক ক্রেতাই তখন কার্যাদেশ বাতিল করেন। বর্তমানে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে প্রায় ১০ কোটি টাকার পেপার কোণ অবিক্রীত আছে।
সালাউদ্দিন আরও বলেন, ছয় মাসের বেশি এসব চোঙা ও নল ফেলে রাখলে তা নষ্ট হয়ে যায়। আবার ছয় মাস ধরে সংরক্ষণের ব্যয়ও বেশি।
বিপিসিটিএমএর সাধারণ সম্পাদক আরও বলেন, কাগজ ব্যবসায়ীরা তাঁদের খেয়ালখুশিমতো দাম বাড়ান ও কমান। এখন দেশের নিম্নমানের কাগজ প্রতি টন ৩২ হাজার টাকা দরে কিনতে হচ্ছে। কিন্তু এর চেয়ে ভালো মানের কাগজ শুল্কমুক্ত আমদানি করলে খরচ পড়ত ২৮ হাজার টাকা।
ক্ষতিগ্রস্ত একজন ব্যবসায়ী জানান, অবিক্রীত থাকায় সাড়ে তিন লাখ পিস পেপার কোণ নষ্ট হয়ে যায়। নতুন করে কার্যাদেশ না পাওয়ায় শেষ পর্যন্ত ব্যবসা বন্ধ করে দিতে বাধ্য হয়েছেন তিনি। এতে প্রতিষ্ঠানটির ২৫০ জন কর্মচারী চাকরি হারিয়ে বেকার হন। ক্ষতি হয় প্রায় ১০-১২ লাখ টাকা।
অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি মো. ইমাম হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, স্থানীয়ভাবে উৎপাদিত কাগজের শক্তিমত্তা অনেক কম। এটাই বিদেশের উন্নত মানের কাগজের সঙ্গে পার্থক্য। শুধু এ কারণেই রপ্তানি মানসম্পন্ন পেপার কোণ ও টিউব তৈরি করতে পারেন না দেশীয় উৎপাদকেরা।
ইমাম হোসেন আরও বলেন, স্থানীয় ব্যবসায়ীরা উন্নত মানের পণ্য সরবরাহ করতে না পারায় অনেক সুতার মিলমালিকেরা কম-বেশি এসব নল বা চোঙা আমদানি করেন। যদিও এই সংখ্যা মোট চাহিদার ১০ শতাংশের মতো। সরকার যদি শুল্কমুক্তভাবে কাগজ আমদানির সুযোগ দেয়, তবে দেশের বর্তমান প্রযুক্তি দিয়েই উন্নত মানের পেপার কোণ ও টিউব উৎপাদন করা সম্ভব।

No comments

Powered by Blogger.