সাক্ষাৎকার তাওয়াক্কুল কারমান-আরব বিপ্লব ছিনতাই হতে দেব না by ফাতেমা নাইব

বার শান্তিতে নোবেল পুরস্কার পেয়েছেন তিন নারী। নারীদের নিরাপত্তায় অহিংস আন্দোলন এবং শান্তি প্রতিষ্ঠায় তাদের পূর্ণ অংশগ্রহণের অধিকার আদায়ে বিশেষ ভূমিকার জন্য তাদের নোবেল শান্তি পুরস্কার দেওয়া হয়েছে বলে নোবেল কমিটির পক্ষ থেকে গত শুক্রবার ঘোষণা করা হয়েছে। পুরস্কার বিজয়ীদের দু'জন লাইবেরিয়ার এবং একজন ইয়েমেনের। তারা হলেন লাইবেরিয়ার প্রেসিডেন্ট ইলেন জনসন সিরলিফ, একই দেশের শান্তি আন্দোলনের নেত্রী
লেমাহ গবোই এবং ইয়েমেনের নারী অধিকার ও একনায়কতন্ত্রবিরোধী গণতান্ত্রিক আন্দোলনের কর্মী তাওয়াক্কুল কারমান। তাদের মধ্যে তাওয়াক্কুল কারমানের সাক্ষাৎকার নিয়েছেন আলজাজিরার ফাতমা নাইব। আলজাজিরা থেকে
ভাষান্তর করেছেন সুভাষ সাহা


সেই ফেব্রুয়ারিতে ইয়েমেনে লৌহমানব আবু সালেহর একনায়কত্ববাদী শাসনের বিরুদ্ধে গণঅভ্যুত্থান শুরু হওয়ার পর থেকে পরিবর্তনের স্কয়ারের তাঁবুতেই সদ্য নোবেল শান্তি পুরস্কার বিজয়ী তাওয়াক্কুল কারমান অবস্থান করছেন। তাঁবু ছেড়ে গেলেই তাকে গ্রেফতার করা হতে পারে_ এ আশঙ্কায় তিনি এভাবেই মাসের পর মাস কাটিয়ে দেন।
নোবেল শান্তি পুরস্কার লাভের পর আলজাজিরাকে তার প্রতিক্রিয়া জানাতে গিয়ে তিনি বলেন, টিভি সংবাদ শোনার আগ পর্যন্ত এ ব্যাপারে কিছুই জানতেন না। এমনকি তার নাম যে এই শান্তি পুরস্কারের শর্টলিস্টে স্থান পেয়েছে_ সে সম্পর্কেও তিনি অবগত ছিলেন না। 'এটা আমার কাছে সম্পূর্ণ বিস্ময়ের ব্যাপার। এই পুরস্কার বিজয়ে কেবল যে আপ্লুত হয়েছি তা নয়, স্বাধীনতা ও মর্যাদা প্রতিষ্ঠার স্বপ্নের জন্যও এই পুরস্কার বিজয় আমাকে আন্দোলিত করেছে।' পেশায় সাংবাদিক ও মানবাধিকার কর্মী তিন সন্তানের জননী কারমান তার এই পুরস্কারকে ইয়েমেনি বিপ্লব ও আরব বিপ্লবের জন্য উৎসর্গ করেন। ইয়েমেনি বিপ্লবের অনেক আগে থেকেই তিনি নারী অধিকার ও মানবাধিকার প্রতিষ্ঠার দাবিতে সোচ্চার ছিলেন। অন্যায়ের বিরুদ্ধে দু'বছর আগে তার প্রতিষ্ঠিত সংগঠন 'উইমেন জার্নালিস্ট উইদাউট চেইন'-এর ব্যানারে তিনি নারী সাংবাদিকদের নিয়ে সাপ্তাহিক নিয়মিত প্রতিবাদ আন্দোলনে নেতৃত্ব দেন। ইয়েমেনের জনগণ একনায়ক সালেহর শাসনের অবসান দাবিতে ফুঁসে উঠলে তার আন্দোলন আরও তীব্র হয়। রাজধানী সানায় নিয়মিতভাবে কারমানের নেতৃত্বে পরিবর্তনের স্কয়ারে অবস্থান ধর্মঘট অনুষ্ঠিত হয় এবং সে সময় তিনি ছাত্র বিক্ষোভেও নেতৃত্ব দেন। মানবাধিকার ও গণতন্ত্রের প্রতি তার অবিচল আস্থার কারণে সরকারের কোপানলে পড়তে হয় তাকে এবং এ বছর তিনি অন্তত দু'বার কারাবরণ করেন। কিন্তু শত নির্যাতনেও অধিকার আদায়ের আন্দোলন থেকে তাকে নিবৃত করা যায়নি।
নোবেল শান্তি পুরস্কার ঘোষণার পরপরই আলজাজিরার পক্ষ থেকে ফাতমা নাইবের নেওয়া তার সাক্ষাৎকারের বিস্তারিত নিম্নে প্রকাশ করা হলো :
আলজাজিরা : নোবেল পুরস্কার বিজয়ের পর আপনি কি মনে করেন, ইয়েমেনি কর্তৃপক্ষ আপনাকে নাজেহাল করতে পারে? পুরস্কারপ্রাপ্তি কি আপনার প্রতি কর্তৃপক্ষের অধিক দৃষ্টি নিবদ্ধের কারণ হবে? আপনার এই পুরস্কারপ্রাপ্তি ইয়েমেনি জনগণের প্রত্যাশা পূরণে কীভাবে কাজ করবে?
কারমান :প্রথমেই আমি স্পষ্ট করতে চাই, ইয়েমেনে এখন দৃষ্টিগ্রাহ্য কোনো কর্তৃপক্ষ নেই। এখানে নামমাত্র একটা সরকার আছে, সাবেক ক্ষমতাচ্যুত নেতা রয়েছেন। এই সরকার ইতিমধ্যে যে ভয়ানক কাজকারবার করেছে তার চেয়ে বেশি কিছু তাদের পক্ষে আর করা সম্ভব নয়। ইয়েমেনি জনগণের বিরুদ্ধে তারা তাদের বর্বরোচিত ক্ষমতা প্রয়োগ করেছে এবং অনেক মানুষ হত্যা করেছে।
আমি ব্যক্তিগতভাবে এ ধরনের নির্যাতনের শিকার হয়েছি। আমাকে আটক করে হত্যার হুমকি পর্যন্ত দেওয়া হয়েছে। বলা যায়, মৃত্যুর দুয়ার থেকে আমি ফিরে এসেছি। আমার জনগণ, দেশ ও যে আদর্শে বিশ্বাস করি তার জন্য আমি আমার নিজেকে ইতিমধ্যে উৎসর্গ করেছি।
নোবেল শান্তি পুরস্কার ভবিষ্যতে আমার করণীয়কে নির্দেশ করছে। আমরা ইয়েমেনি বিপ্লবের সময় যে পথ গ্রহণ করি, সে পথ ধরে এগিয়ে যেতে এটা অনুপ্রেরণা জোগাবে। এখন পরবর্তী পদক্ষেপ হবে দেশকে পুনর্গঠন করা এবং এটাই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। ৩৩ বছর ধরে সালেহর একনায়কত্ববাদী শাসনে বিধ্বস্ত হয়ে পড়া ইয়েমেনকে আমরা পুনর্গঠন করব। নারী-পুরুষ, বৃদ্ধ-যুবা নির্বিশেষে সবাই কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে দেশ পুনর্গঠনে হাত লাগাব।
আলজাজিরা :নোবেল পুরস্কার ঘোষণার সময় আপনি কোথায় ছিলেন?
কারমান :সে সময় আমি পরিবর্তনের স্কয়ারের মাঝামাঝি অবস্থিত আমার তাঁবুতে ছিলাম। নমিনেশন থেকে পুরস্কারপ্রাপ্তি পর্যন্ত কোনো কিছুই আমার জানা ছিল না। এই সংবাদটা আমার কাছে ছিল পুরোপুরি বিস্ময়কর। আমি যখন টিভি চ্যানেলের নিউজে সংবাদটা শুনি তখন বিস্ময়ে 'হাঁ' হয়ে যাই।
এটা বিপ্লবের জন্য উপহার ও এই উপহার বিশ্বের সব পরিবর্তনের স্কয়ারের জন্যও। আমার সন্তানদের জন্যও এ পুরস্কার, কারণ তারা আমাকে সমর্থন জুগিয়েছে ও আমার অনুপস্থিতির কারণে আমাকে মিস করেছে। আমার স্বামী, আমার মা-বাবা, আমার ভাই-বোন, বন্ধু ও বিপ্লবের সহযোদ্ধা_ যারা সেই শুরু থেকে আমাকে সমর্থন জুগিয়েছেন, তাদের সবার উদ্দেশে আমি পুরস্কার উৎসর্গ করলাম।
আলজাজিরা :আপনি কি মনে করেন, ইয়েমেনি মহিলারা নির্যাতিত বলে বিশ্বে যে ধারণা বদ্ধমূল হয়ে আছে, আপনার পুরস্কারপ্রাপ্তিতে সে ধারণায় কোনো পরিবর্তন ঘটবে?
কারমান :আরব, বিশেষ করে ইয়েমেনি মহিলারা সত্যিকারভাবে কী, আর তাদের ভূমিকাই বা কী_ তারা তা করে দেখিয়েছে।
আমাদের যথেষ্ট সামর্থ্য রয়েছে এবং বিপ্লবে অংশগ্রহণের মাধ্যমে আমাদের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা আমরা তুলে ধরেছি। ইয়েমেনি মহিলারা এই বিপ্লবের প্রতিটি অংশেই গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে। এজন্য নারী-পুরুষ নির্বিশেষে আমাদের সবাইকে দায় শোধ করতে হয়েছে। অনেককে জীবন পর্যন্ত উৎসর্গ করতে হয়েছে। নতুন ইয়েমেনি সরকারেও এ দেশের মহিলারা অংশগ্রহণ করবে।
আলজাজিরা :সেই গণঅভ্যুত্থান শুরুর লগ্ন থেকেই আপনি ইয়েমেনি রাজধানী সানায় অবস্থিত পরিবর্তনের স্কয়ারে ঘুমাচ্ছেন। বিপ্লবের পুরুষ সঙ্গীরা আপনার সম্পর্কে কী ভাবেন?
কারমান :গত ১৮ ফেব্রুয়ারি গণঅভ্যুত্থান শুরুর দিন থেকে আমি এখানে আছি। যতদিন পর্যন্ত গণতান্ত্রিক, বেসামরিক ও আধুনিক ইয়েমেন পুনর্গঠন করতে না পারব ততদিন আমরা এখানেই অবস্থান করব। এই স্কয়ার ইতিমধ্যে একটা সমাজের জন্ম দিয়েছে। যেখানে নারী-পুরুষ, বৃদ্ধ-যুবা সবাই রয়েছেন। এখানে যারা রয়েছেন তারা প্রত্যেকে পরস্পরকে প্রকৃত সম্মান করেন। নতুন ইয়েমেন গঠনে আমাদের সামর্থ্য সম্পর্কেও আমরা নিঃসন্দেহ।
আলজাজিরা :আল কায়দা ও সন্ত্রাসবাদের দোহাই দিয়ে যে সরকার এখনও আবু সালেহর প্রতি আনুগত্য দেখাচ্ছে, তাদের ব্যাপারে আপনার বক্তব্য কী?
কারমান :এই নোবেল পুরস্কারপ্রাপ্তি প্রমাণ করেছে যে, বিশ্ব আমাদের সংগ্রামকে সম্মান ও সমর্থন করে। আর সালেহ সরকারই হলো ইয়েমেনে সত্যিকার সন্ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করার জন্য দায়ী। সালেহর শাসনাধীনে আল কায়দা বিকশিত হওয়ার সুযোগ পায়। কিন্তু জনগণের সত্যিকার শাসনে আমরা এই সন্ত্রাসবাদকে বিদায় করে দেব এবং আমি জানি, আমরা সন্ত্রাসবাদমুক্ত ইয়েমেন কায়েমে সক্ষম হবো।
আলজাজিরা :আপনি কি মনে করেন, শান্তিপূর্ণ বিপ্লব ইতিবাচক ফল বয়ে নিয়ে আসতে সক্ষম হবে?
কারমান :হ্যাঁ, শান্তিপূর্ণ বিপ্লবই ইয়েমেনের জন্য একমাত্র সমাধান। রাস্তায় শান্তিপূর্ণ মিছিল এর একমাত্র সমাধান। মহাত্মা গান্ধী, নেলসন ম্যান্ডেলা ও মার্টিন লুথার কিংয়ের অহিংস আন্দোলন থেকে আমি শিক্ষা গ্রহণ করেছি। সেখান থেকেই অহিংস আন্দোলনের ধারণা আমার মধ্যে গড়ে ওঠে। এই ত্রয়ী শান্তিপূর্ণ আন্দোলনের পথপ্রদর্শক এবং তাদের কাছ থেকেই আমি এ আন্দোলনের জন্য আত্মিক শক্তি লাভ করি। তাদের কাছে আমি ঋণী।
আলজাজিরা :তিউনিসিয়া, মিসর, লিবিয়া, বাহরাইন ও সিরিয়ার মতো আরব দেশগুলোর বিপ্লব থেকে আপনার কী উপলব্ধি হয়েছে?
কারমান :আমরা এসব বিপ্লব থেকে অনেক কিছু শিখেছি। তারাও আমাদের কাছ থেকে অনেক কিছু শিখতে পেরেছে বলেই আমার বিশ্বাস। এটা এমন একটা সংগ্রাম, এমন একটা বিপ্লব যা মানুষকে অত্যাচারের মুখোমুখি দাঁড়াতে উদ্বুদ্ধ করে। এটা আরবের নবজাগরণ ও আরব বিপ্লব। এখন আমাদের একে অপরের কাছ থেকে শিখতে হবে যে, কেবল সরকার পরিবর্তন করাই যথেষ্ট নয়, আমরা কীভাবে তাকে ফলদায়ক করতে পারব তাও শিখতে হবে।
আমরা এরপর কী করব সে সম্পর্কেও আমাদের জানতে হবে। আরব বিশ্বের সব যুবককে পুনর্গঠিত ও পুনরায় জোটবদ্ধ করতে হবে। গণতন্ত্র, সাম্য, ন্যায়বিচার ও স্বাধীনতার প্রকৃত সংগ্রাম কেবল শুরু হলো। আমাদের বিপ্লবকে ছিনতাইয়ের হাত থেকে রক্ষা করতে হবে।

No comments

Powered by Blogger.