ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কে নিরাপত্তা নেই by হকিকত জাহান হকি

সংঘবদ্ধ একটি সন্ত্রাসী চক্রের দখলে ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়ক। চক্রের সদস্যরা দীর্ঘদিন ধরে গুরুত্বপূর্ণ এ মহাসড়কে চুরি, ডাকাতি, ছিনতাই ও লুটপাটের রাজত্ব কায়েম করেছে। বিশেষ করে শতভাগ রফতানিমুখী তৈরি পোশাক চুরি, ছিনতাই হচ্ছে অহরহ। অনেক সময় রফতানি চালানের পুরো অংশ বা আংশিক ছিনতাই, ডাকাতি করা হচ্ছে। এতে রফতানিকারকরা আর্থিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন। একই সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ক্রেতারা কেনার আদেশ বাতিল করছেন, ক্ষুব্ধ


হচ্ছেন। বাংলাদেশ থেকে মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছেন অনেক ক্রেতা। হাইওয়ে পুলিশ ও মহাসড়ক সংলগ্ন থানা পুলিশ এ সন্ত্রাসী তৎপরতা বন্ধ করতে ব্যর্থ হয়েছে। এতে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে দেশের অর্থনীতি।
সূত্র জানায়, কাভার্ডভ্যান থেকে কৌশলে চুরির কারণে বিদেশি ক্রেতাদের কাছে পণ্য যাচ্ছে কম। ক্রেতারাও নিয়মিত আপত্তি জানাচ্ছেন। এ নিয়ে পরে আর ক্রেতাদের ক্ষতিপূরণ দেওয়া হয় না। এতে একদিকে ক্রেতারা আর্থিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন, অন্যদিকে বিদেশে বাংলাদেশের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন
হচ্ছে।
জানা গেছে, বিশেষ করে কুমিল্লা থেকে চট্টগ্রাম পর্যন্ত সড়কে সংঘবদ্ধ একটি সন্ত্রাসী চক্র দীর্ঘদিন থেকে রফতানি পণ্য চুরি, ছিনতাইয়ের ঘটনা ঘটিয়ে আসছে। মাঝে মধ্যে তারা বেপরোয়া হয়ে ওঠে। ওইসব সন্ত্রাসীর খবর নতুন নয়। সংশ্লিষ্ট থানা পুলিশের কাছে এসব ঘটনা অজানা নয়। হাইওয়ে পুলিশ তাদের ক্ষমতা অনুযায়ী স্থানীয়ভাবে গড়ে ওঠা এসব অপকর্মের হোতাদের খুঁজে বের করে শাস্তি দিতে পারে না।
ঢাকা মহানগর, সাভার, আশুলিয়া, গাজীপুর, টঙ্গী, নারায়ণগঞ্জসহ সব গার্মেন্ট শিল্প এলাকায় ওইসব সন্ত্রাসীর নেটওয়ার্ক রয়েছে। কখন কোন গার্মেন্ট ফ্যাক্টরি থেকে চট্টগ্রাম অভিমুখে মালবাহী ট্রাক ছেড়ে যায়_ যথাসময়ে সে খবর পেয়ে যায় চক্রের সদস্যরা। একইভাবে বিদেশ থেকে পোশাক শিল্পের কাঁচামাল চট্টগ্রাম বন্দর থেকে ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে নেওয়া হয় এ মহাসড়ক দিয়েই। আমদানি করা মালপত্রও চুরি-ছিনতাই হয় একই কায়দায়। প্রায় ৩০০ কিলোমিটার ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কটি দেশের অর্থনীতির জন্য অতি গুরুত্বপূর্ণ হলেও ব্যবসায়ীরা বারবার ক্ষতির শিকার হচ্ছেন এ সড়কেই।
পোশাক শিল্প মালিকদের সংগঠন বিজিএমইএর সভাপতি সফিউল ইসলাম মহিউদ্দিন সমকালকে বলেন, দীর্ঘদিন ধরে একটি শক্তিশালী চক্র ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কে রফতানি পণ্য চুরি ও ছিনতাই করছে। তাদের এ অপকর্মের কারণে রফতানিকারকদের অনেকের রফতানি আদেশ বাতিল হয়ে যাচ্ছে। ক্রেতাদের কাছে কম পণ্য যাচ্ছে। এতে বিদেশে বাংলাদেশের ভাবমূর্তি চরমভাবে ক্ষুণ্ন হচ্ছে। দেশের এ ক্ষতি কোনোভাবেই পুষিয়ে নেওয়া সম্ভব নয়। তিনি বলেন, চুরি-ডাকাতির সঙ্গে জড়িতদের খুঁজে বের করে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দিতে হবে। তিনি বলেন, পোশাক শিল্প খাতটি খুবই অনুভূতিপ্রবণ। সন্ত্রাসী চক্রের কারণে এ খাত কখনও বড় ধরনের ক্ষতির মুখোমুখি হলে তা আর পুষিয়ে নেওয়া সম্ভব হবে না।
হাইওয়ে পুলিশের ডিআইজি হুমায়ুন কবীর সমকালকে বলেন, ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কে রফতানি পণ্য চুরি ও ছিনতাই ঠেকাতে সংশ্লিষ্ট রফতানিকারকদের বেশি সতর্ক হতে হবে। চালক গাড়ি কীভাবে কোনো সড়ক দিয়ে নিয়ে যাচ্ছে তা ঘরে বা অফিসে বসে কম্পিউটারে মনিটর করার জন্য মালবাহী ট্রাক অথবা কাভার্ডভ্যানে গ্গ্নোবাল মনিটরিং সিস্টেম (জিপিএস) স্থাপন করা প্রয়োজন। এতে গাড়ি নির্দিষ্ট সড়ক দিয়ে না গিয়ে অন্য কোনো পথে গেলে মালিক তাৎক্ষণিক ব্যবস্থা গ্রহণ করতে পারবেন। একইভাবে গাড়িতে মালপত্র বোঝাই করার পর চালককে তা বুঝিয়ে দিয়ে পরে তা জাহাজে বোঝাই করার আগে চালকের সামনে কনসিল গুডস ডিটেক্টরের মাধ্যমে চেক করা প্রয়োজন। তাতে তাৎক্ষণিকভাবে চুরি হওয়া মালপত্রের তথ্য পাওয়া যাবে। রফতানি পণ্য চুরি-ছিনতাইয়ের হোতাদের খুঁজে বের করার জন্য সংশ্লিষ্ট জেলা পুলিশ সুপারের তদারকিতে তদন্ত হওয়া দরকার। তদন্তে সন্ত্রাসী, ছিনতাইকারীদের চিহ্নিত করে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া যায়।
রিও ফ্যাশন
একই দিন আগারগাঁও সরকারি বালক উচ্চ বিদ্যালয়ের সামনে থেকে রিও ফ্যাশন ওয়্যার লিমিটেডের ১ কোটি ১৮ লাখ টাকার ৬৮ হাজার গজ কাপড়ের একটি কাভার্ডভ্যান ছিনতাই করে নিয়ে যাওয়া হয়। এ ঘটনায় শেরেবাংলা নগর থানায় একটি মামলা হয়েছে। ছিনতাই হওয়া ৬৮ হাজার গজ কাপড় না পাওয়া গেলে সংশ্লিষ্ট বিদেশি ক্রেতা রফতানি আদেশ বাতিল করে দিতে পারেন বলে জানা গেছে।
দ্যাটস ইট নিট ফ্যাশন
জানা গেছে, ১৯ ডিসেম্বর গভীর রাতে ঢাকার কেরানীগঞ্জের অমৃতপুর এলাকা থেকে হা-মীম গ্রুপের দ্যাটস ইট নিট ফ্যাশন লিমিটেডের প্রায় ৩ কোটি টাকার মালপত্রসহ প্রতারক চক্রের সাত সদস্যকে আটক করে পুলিশ। প্রতারক চক্রের সদস্যরা হলো_ মোঃ বাবুল হোসেন, গিয়াসউদ্দিন, মোঃ হারুন, সাইদুল হোসেন, রুবেল, আবদুল বারেক ও মোঃ মিজান। ওইদিন রাতে রাজধানীর তেজগাঁও গোডাউন থেকে ঢাকা মেট্রো-ট-১৪-২৯৮৬ নম্বরের একটি ট্রাকে হা-মীম গ্রুপের দ্যাটস ইট ফ্যাশন লিমিটেডের বয়েজ শর্ট প্যান্টের ৯৭২টি কার্টন ওঠানো হয়। চট্টগ্রামগামী ট্রাকটির চালক বাবুল হোসেন প্রতারক চক্রের সহায়তায় এ মালপত্র আত্মসাৎ করার জন্য কেরানীগঞ্জে নিয়ে যায়। পরে একটি কারখানার ভেতর ট্রাকটি নিয়ে কার্টনগুলো খুলে ৯ হাজার ৭২০টি বয়েজ শর্ট প্যান্ট আলাদা করার সময় কেরানীগঞ্জ মডেল থানার সহকারী উপ-পরিদর্শক সহিদুল্লাহ কায়সার গোপন সংবাদের ভিত্তিতে কারখানার ভেতর যান। এ সময় প্রতারকরা পালিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করলে তাদের আটক করা হয়। এ ঘটনায় দ্যাটস ইট নিট ফ্যাশন লিমিটেডের প্রশাসনিক কর্মকর্তা মোঃ সালাউদ্দিন বাদী হয়ে একটি মামলা করেছেন।
জানা গেছে, দীর্ঘদিন ধরে রফতানি পণ্য চুরির সঙ্গে জড়িত মহাসড়কের পাশের ৯ সন্ত্রাসীকে চিহ্নিত করে তাদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণের দাবি জানিয়ে চট্টগ্রাম আন্তঃজেলা ট্রাক ও কাভার্ডভ্যান মালিক সমিতির পক্ষ থেকে বেশ আগে প্রধানমন্ত্রীর কাছে স্মারকলিপি পেশ করা হলেও এ ব্যাপারে কোনো ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়নি। চট্টগ্রাম শহরের নিমতলী ও মহাসড়ক সংলগ্ন কুমিল্লা, গৌরীপুর, চান্দিনা, চৌদ্দগ্রাম, ফেনী, সীতাকুণ্ড কুমিরাসহ কিছু এলাকায় ওইসব সন্ত্রাসীর অবস্থান।
৯ সন্ত্রাসীর মধ্যে রয়েছে_ চট্টগ্রামের নিমতলার মোঃ সাইফুদ্দিন ওরফে সাইদ্দা ও পিচ্চি মাসুদ, কুমিল্লা জেলার চৌদ্দগ্রাম উপজেলার গুণবতী বাজারের রূপদা, (তিনি ফেনীর মাস্টারপাড়া ও পরশুরামেও থাকেন) পূর্ব ডেকরা গ্রামের মফিজ, ছাপালিয়া গ্রামের সুমন, একই গ্রামের নয়ন, রাজনকরা গ্রামের আজিজ, দামারপাড়া গ্রামের সোহাগ ও রাজবল্লভপুরের সোহাগ।
বিজিএমইএ সূত্র জানায়, ঢাকার গাজীপুর থেকে ওনাস ডিজাইন লিমিটেডের পোশাক চট্টগ্রাম বন্দরে পেঁৗছানোর সময় মহাসড়ক থেকে ২৪ হাজার ২২৮ পিস পোশাক চুরি হয়। এ ঘটনায় চট্টগ্রাম বন্দর থানায় জিডি করা হয়। পরে একই কারখানার ট্রাক থেকে আরও ৮ হাজার ৬৪০ পিস পোশাক চুরি হয়। এ ঘটনায়ও চট্টগ্রাম বন্দর থানায় জিডি করা হয়। সাভারের হেমায়েতপুরের একেএইচ ফ্যাশন লিমিটেডের পোশাকভর্তি একটি কাভার্ডভ্যান কুমিল্লার মিয়া বাজার সংলগ্ন সড়ক থেকে ছিনতাই হয়। এ কাভার্ড ভ্যানে ৬ হাজার ৩০ পিস তৈরি পোশাক ছিল। এ ঘটনায় সাভার থানায় অভিযোগ করা হয়। সাভারের জিন্স প্লাস লিমিটেডের ৩০ লাখ গজ (২১৫ রোল) কাপড়, গাজীপুরের ঐশী ফ্যাশন (প্রাঃ) লিমিটেডের ৬ হাজার ৮৮৬ পিস সোয়েটার, সোয়ান গার্মেন্টের ১৯ হাজার ৪৬৪ গজ কাপড়, আশুলিয়ার অনন্ত গার্মেন্টের ৭ হাজার ২০৬ গজ কাপড়, ঢাকার কাঁচপুরের এসএফ ফ্যাশনের সাড়ে ৩ হাজার পিস পোশাক এবং গাজীপুরের গিভেন্সি, কটন ক্লাব গার্মেন্টের পোশাক চুরির ঘটনা ঘটেছে। এসব ঘটনায় আলাদাভাবে সংশ্লিষ্ট থানায় মামলা করা হয়েছে।

No comments

Powered by Blogger.