ঘুড়িযাত্রা by শোয়ায়েব মুহাম্মদ

নাইওর-ফিরতি কনের মতো মন খারাপ করা বিকেলে টুকু বৈদ্যবাড়ি পৌঁছায়—সে আর তার স্বামী। সকালেই যাত্রা করেছিল তারা। দুপুরে দাওয়াত ছিল আমির হোসেনদের বাড়িতে। টুকুকে এ বৈদ্যের খবর দিয়েছিল আমির হোসেন। তাদের পেছনের বাড়ি বৈদ্যের। টুকুর স্বামীর সঙ্গে বিদেশ থাকে সে। টুকু নয়, আসলে টুকুর স্বামীকেই খবরটা প্রথম দেয় আমির হোসেন। বৈদ্যবাড়িতে ঢোকার মুখেই চোখে পড়ে অনেকখানি নীলের মধ্যে এক টুকরো সাদা মেঘের মতো উঠোন। বৈদ্য অমল পারিয়াল বসে আছে উঠোনের এক কোনায়। সামনে টেবিল। টেবিলের পর রোগী বসার চেয়ার। হাতের ডান পাশে আরও লোকের বসার জন্য বেঞ্চি। টুকু বাড়িতে ঢুকেই বৈদ্যকে নমস্কার দেয়। নমস্কারের শব্দে ঘর থেকে দুজন মহিলা উঁকি দিয়ে দেখে তাকে। বৈদ্য টুকুকে তার সামনের চেয়ারে বসতে বলে। ভেতর থেকে উঁকি দিয়ে দেখা মহিলাদের একজন পান নিয়ে আসে। পানের প্লেট তার দিকে এগিয়ে দিয়ে বৈদ্য বলে, ‘পান খান।’ টুকু বলে, সে পান খায় না। পেকে ওঠা বেলের পেট-রং বিকেল বৈদ্যবাড়ির উঠোন ছাপিয়ে কোনার অর্জুনগাছের চুড়োয়। বৈদ্য টুকুকে বলে, ‘এটা পান না, ওষুধ মা।’ সে পান না খেয়ে বৈদ্যের কাছে বাড়ি ঘুরে দেখার অনুমতি চায়। আর তার স্বামী বসে থাকে বৈদ্যের পাশে।
২. উঠোনের পাশে যত্ন করে লাগানো তুলসীগাছ। টুকু তুলসীগাছ দেখে। পাতাগুলো হাতের পিঠ দিয়ে ছোঁয়। যে মহিলা প্লেটে পান এনেছিল, সে এসে তার পাশে দাঁড়ায়। তুলসীগাছের পাশেই গভীর নলকূপ। একটু দূরে কৃষ্ণচূড়াগাছ। তাতে পাশে দাঁড়ানো বউয়ের সিঁথির সিঁদুর রং—লাল ফুল ফোটা। লাল ফুল দেখে টুকুর খুব ভালো লাগে। সে ভাবে, তার বাড়িতে তিনটে গাছ লাগাবে পাশাপাশি—জারুল, সোনালু আর কৃষ্ণচূড়া। লাল, বেগুনি আর হলুদ ফুল ফুটবে চৈত্রে। ফুলের রং দেখে আকাশে ঘোরাঘুরি করতে করতে ক্ষণিকের জন্য দাঁড়িয়ে পড়বে চলন্ত মেঘেরা। দাঁড়িয়ে পড়া মেঘেদের ছায়া পড়বে তার বাড়িতে। সে দিনগুলোতে তার সঙ্গে হয়তো দেখা করতে আসবে বীরু...। স্বামীর বাড়ি আসার প্রথম দিকে উঠোনে তার বাগান করার শখ ছিল। বর্ষায় লাগিয়ে ছিল জিনিয়া। বীরুই তাকে বিচি এনে দিয়েছিল। সারা বাড়ি যেন খলখল করে হাসছিল জিনিয়ার রং। এ সময় এক দেবর তাকে বলে, ‘বাগানে ফুল ফুটায়ে কী লাভ? নিজের ফুল তো ফোটে না!’ শুনে বীরুর চোখ জল-ছলছল। টুকু ভাবে, বাড়িতে তিনটে গাছ লাগালে বাড়ির মানুষের মনও মেঘময় হবে। আকাশে ঘুরে বেড়ানো কোনো মেঘ হবে মন খারাপ করা, কোনোটা মন ভালো করা...আহা! তখন সে হয়তো উঠোনজুড়ে আঁকবে অনেক তরমুজ। চোখ বন্ধ করলেই সেই আঁকা তরমুজ চুরি হয়ে যাবে। আর চোরকে খুঁজতে খুঁজতে সে এসে দাঁড়াবে বাঁধানো ঘাটে।
পুকুরের ভাবনায় অথবা বৈদ্যবাড়ির নলকূপ দেখে টুকুর খুব জল খেতে ইচ্ছে করে। নলকূপ থেকে হাতের আঁজলায় জল নিয়ে পান করে সে। জলপান শেষ হলে সঙ্গের মহিলা তাকে বাড়ি ঘুরিয়ে দেখায়। ঢুকতেই পূর্বদিকে বৈদ্যের পড়ার ঘর। তার উল্টো দিকে দুটো ঘরের একটা বন্ধ—স্টোররুম। পাশের ঘরের চৌকাঠে এক বুড়ো মহিলা বসে। টুকুর সঙ্গী মহিলা বলে, ‘বৈদ্যের মা।’ বাড়ি দেখতে দেখতে এবার সঙ্গের মহিলাকে পরিচয় জিজ্ঞেস করে টুকু। মহিলা বলে, সে বৈদ্যের বড় বউ। সারা বাড়ি ঘুরে দেখে টুকু। গোবরজলে নিকানো পরিষ্কার উঠোন। তার একদিকে ঢেঁকিছাঁটা চালের গুঁড়ি শুকাতে দেওয়া। নতুন কোথাও গেলে বাড়ি ঘুরে ঘুরে দেখতে খুব ভালো লাগে তার। ‘আপনার ছেলেসন্তান কয়জন?’—সঙ্গী বৈদ্যের বড় বউকে জিজ্ঞেস করে টুকু। মহিলার মুখে কালো তুলসীর মতো ছাইরঙের মেঘ ভর করে। কয়েক মুহূর্ত থাকে। তারপর মৃদু হেসে সে বলে, ‘ভগবান পাঠান নাই।’ টুকুর মন খারাপ হয়ে যায়। বৈদ্য অমল পারিয়াল চেয়ারে বসে পঞ্জিকা ঘাঁটছে। সারা বাড়ি ঘুরে বৈদ্যের পড়ার ঘরের সামনে দাঁড়ায় টুকু। ঘরের ভেতর অনেক বই। সে খোলা ঘরের ভেতরে ঢুকতে চাইলে বৈদ্যের ছোট বউ বলে, ‘বাইরের লোকের পড়ার ঘরে ঢোকার অনুমতি নাই।’ টুকু ঘরে ঢুকে বৈদ্যের বই দেখে। বড় বউয়ের মনে হয়, এই মেয়েটা অন্য রোগীদের মতো মনমরা নয়।
৩. অমল পারিয়াল ছেলেপেলে না-হওয়া দম্পতির চিকিৎসক। এ জেলা তো ও জেলা, বহু দূর থেকে তার কাছে লোক আসে। সারা বাড়ি ঘুরেটুরে এখন বৈদ্যের সামনে বসা টুকু। বৈদ্য তার দিকে তাকায়। মেঘের গায়ে সে সময় গাঢ় রক্তের লাল রং। প্লেটের পানটা এখনো টেবিলে রাখা। ‘আপনের বিয়া হৈছে কয় বছর?’—বৈদ্য টুকুকে জিজ্ঞেস করে। তার চোখে চোখ রেখে হেসে দেয় টুকু। বলে, ‘সাত বছর।’ ‘ডাক্তার দেখাইছেন?’ টুকুর ঘোরাঘুরির ফাঁকে তার স্বামী বৈদ্যকে সব বৃত্তান্তই বলেছে। টুকু বলে, ‘বুড়িগঙ্গায় নৌকায় ভাসা এক বেদেনি দেড় কেজি চাল নেবে বলে ওষুধ দিয়ে গেছে। ছয় মাসের গ্যারান্টি। ছয় মাস পর দেখা করে চাল নিয়ে যাবে।’ বৈদ্য তার দিকে তাকিয়ে সামনের খোলা পঞ্জিকা বন্ধ করে। স্বামীকে বলে, ‘আপনের বউয়ের ওপর জিনের আসর আছে।’ এবার সে টুকুকে টাকি মাছের রক্তে লেখা তাবিজ দেয়। ভাবলেশহীন মুখে বলে, ‘তাবিজটা কবরস্থানের মাটি দিয়ে ঘরে রাখতে হবে।’ টুকু ভাবে, অনেক দিন সে টাকি মাছ দেখেনি। সে রান্না করা টাকি মাছ খায় না কিন্তু টাকির ভর্তা খায়। বৈদ্য স্বামীকে বলে যে ঘনিষ্ঠ কেউ টুকুকে বান মেরেছে। শোল মাছের মাথার ওপর সে বান কাটতে হবে। এ সময় সে শর্ত দেয়, ‘বান কাটানি আর রক্তে লেখা তাবিজ দিছি বলে শোল আর টাকি মাছ খাওয়া আজীবন হারাম।’ ‘আমি এমনিতেও শোল আর টাকি মাছ খাই না।’—টুকু বলে। বৈদ্য তাকে ৪১ দিনের গ্যারান্টি দেয়। সঙ্গে কিছু ওষুধ। পরপর তিন দিন খেতে হবে।
৪. তারা যখন বৈদ্যের বাড়ি থেকে বের হচ্ছে, আকাশে তখন মেঘ জমেছে—দুধের ওপর সর জমার মতো। ধনমুড়ি আর তিলনারী—দুটো গ্রাম পেরিয়ে অনেকখানি পথ হাঁটে টুকুরা। দুই গ্রামেই অনেক চালতাগাছ। সব বাড়িতেই একাধিক। টুকুর চালতাগাছ দেখে ভালো লাগে, আবার মনও খারাপ হয়। এই গ্রামে এত চালতাগাছ আর তার বাড়িতে একটাও চালতাগাছ নেই। চালতা অথবা চালতার আচার খুব কার্যকর মেয়েলি অসুখের জন্য। সে মনে মনে বলে, এবার বৃক্ষমেলা থেকে বাড়ির জন্য একটা চালতাগাছ কিনব। ধনমুড়ি থেকে হাঁটতে হাঁটতে তিলনারী পেরিয়ে এলেও তারা কোনো রিকশা পায় না। টুকু সামনের দিকে তাকায়। আকাশে গাঢ় রক্তের লাল রং, সরের মতো জমে ওঠা মেঘ পেরিয়ে তার তখন বীরুর চোখ মনে পড়ে—বীরুর চোখ জল-ছলছল। পথের ধারে ঘাট বাঁধানো বড় একটা দিঘি। দিঘি দেখে টুকু থমকে দাঁড়ায়। তার খুব মুখ ধুতে ইচ্ছে করে। পাশে দাঁড়ানো স্বামীকে বলে, ‘আমি একটু মুখ ধুই?’ লাফিয়ে লাফিয়ে ঘাটের সিঁড়ি টপকে টুকু একেবারে শেষ ধাপে যায়। তার মুখে জলের আর্দ্রতার ছোঁয়া। এ সময় নেমে আসা সন্ধ্যার আলোয় দিঘির টলটলে জলের দিকে তাকালে হঠাৎ তার মনে হয়, দিঘির জলে যেন বীরুর মুখখানি ভাসছে। জলে ভিজে ওঠে তার চোখ। টুকু দিঘির জলে নিজের ভেজা চোখ ধোয়। চোখমুখ ধুয়ে ঘাটের চাতালে তাকিয়ে স্বামীকে দেখে। এই সন্ধ্যা, দিঘির টলটলে জল, বৈদ্যবাড়ি অথবা এ পথ—কিছুই ভালো লাগে না তার। টুকু ভাবে, এ মুহূর্তে তার হয়তো এই জীবনটাকেই ভালো লাগছে না। অনেক দূর থেকে একটা রিকশা আসার শব্দ শোনা যায়। দেখা যায় হারিকেনের মৃদু আলো।

No comments

Powered by Blogger.