শিশুস্বাস্থ্যে ঝুঁকি বাড়ছেঃ বিশেষ স্বাস্থ্য প্রকল্প বাস্তবায়ন জরুরি

‘ফাইট নিউমোনিয়া, সেভ এ চিলড্রেন’—এ প্রতিপাদ্য সামনে রেখে ২ নভেম্বর পালিত হলো বিশ্ব শিশু নিউমোনিয়া দিবস। প্রতিবারের মতো বাংলাদেশেও দিবসটি পালন করেছে সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান। এ উপলক্ষে রাজধানীর প্যান প্যাসিফিক সোনারগাঁও হোটেলে আয়োজিত অনুষ্ঠানে প্রতিপাদ্য বিষয়টি বাস্তবায়ন করতে বিভিন্ন করণীয় বিষয় সম্পর্কে দিকনির্দেশনা দিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা। প্রতি বছরই স্বাস্থ্য সম্পর্কিত বিভিন্ন দিবস উপলক্ষে এ ধরনের অনুষ্ঠানের আয়োজন করে মূল্যবান পরামর্শ দেয়া হয়। কিন্তু কাজের কাজ তেমন কিছুই হয় না।
আনুষ্ঠানিক ফাইলপত্রে আটকে থাকে গৃহীত সব প্রস্তাবনা। শিশু স্বাস্থ্যসেবা দূরের কথা, সারাদেশে সাধারণ চিকিত্সাসেবার গুণগত কোনো পরিবর্তন হয় না। প্রকৃত প্রস্তাবে দেশের সার্বিক স্বাস্থ্যসেবার ব্যবস্থাপনা এতটাই দুর্দশাগ্রস্ত যে, এর উন্নয়নে সরকার তথা সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ আদৌ কোনো চিন্তা-ভাবনা করে কিনা তাও রীতিমতো গবেষণার বিষয়। এ অবস্থায় শিশুদের স্বাস্থ্যঝুঁকি ক্রমশ বাড়ছে। নিউমোনিয়াসহ বিভিন্ন রোগে ভুগে বেড়ে যাচ্ছে শিশু মৃত্যুর হার। বিশেষজ্ঞদের দেয়া তথ্য মতে, নিউমোনিয়া রোগে আক্রান্তের সংখ্যা বিবেচনায় বাংলাদেশের অবস্থান বিশ্বে পঞ্চম। দেশে প্রতি বছর প্রায় ৬০ লাখ লোক নিউমোনিয়ায় আক্রান্ত হয়। এর মধ্যে পাঁচ বছরের কম বয়সী ৫০ হাজারের মতো শিশু নিউমোনিয়ায় আক্রান্ত হয়ে মারা যায়। এ সংখ্যা হাম, ম্যালেরিয়া ও অন্যান্য রোগে মৃত্যুর চেয়েও বেশি। শিশুরোগ বিশেষজ্ঞ জাতীয় অধ্যাপক এমআর খান জানিয়েছেন, দেশে প্রতি ঘণ্টায় নিউমোনিয়ায় আক্রান্ত হয়ে মারা যায় ছয়টি শিশু। তবে রোগটি সহজেই নিরাময় সম্ভব। এখন প্রশ্ন হচ্ছে, যে রোগটি এখন আর মারাত্মক পর্যায়ে নেই, সে রোগে ঘণ্টায় ছয়টি শিশু মারা যায় কেন? এ প্রশ্নের উত্তর লুকিয়ে রয়েছে চিকিত্সা ব্যবস্থাপনায় নানা অনিয়মের ভেতরে। পর্যাপ্ত হাসপাতাল নেই, ওষুধ-বিষুধ নেই, নেই প্রয়োজনীয়সংখ্যক শিশু রোগ বিশেষজ্ঞ। চিকিত্সা ছাড়াও রোগ প্রতিরোধের জন্য যে সচেতনতার দরকার তারও অভাব প্রকট। সচেতনতা বাড়াতে প্রচার-প্রচারণার দায়িত্ব মূলত স্বাস্থ্য অধিদফতরের। কিন্তু তাদের কর্মকাণ্ড এতটাই সীমাবদ্ধ যে, দেশের বেশির ভাগ মানুষ বিশেষত গ্রামাঞ্চলের মানুষ এ রোগের কারণ সম্পর্কেই অবহিত নয়। এ ক্ষেত্রে সরকারের পাশাপাশি বেসরকারি উদ্যোগও প্রায় শূন্যের কোটায়।
আমাদের দেশে ৯০ ভাগ শিশুর মৃত্যু ঘটে যথাযথ চিকিত্সার অভাবে। রাজধানীতে শেরেবাংলা নগরে বিশেষায়িত শিশু হাসপাতালটির ব্যবস্থাপনা নিয়ে রয়েছে বিস্তর অভিযোগ। বিশেষত জরুরি বিভাগে অনেক সময় ডাক্তার থাকেন না। ক্ষমতার পালাবদলে দুর্নীতি ও অনিয়মের অভিযোগ নিয়েই দিব্যি চলছে এ হাসপাতালটি। অন্যান্য হাসপাতালের অবস্থা আরও শোচনীয়। এই বেহালদশা টিকিয়ে রেখে শুধু ‘দিবস’ পালনের আনুষ্ঠানিকতা বাড়িয়ে ফায়দা নেই। এমনিতেই শিশুস্বাস্থ্যের পারিপার্শ্বিক শত্রুর শেষ নেই। বস্লমাত্রিক দূষণ, গুঁড়ো দুধসহ নানা জাতের ভেজাল-বিষাক্ত শিশু খাবার এবং আর্থ-সামাজিক নানা বিড়ম্বনার মধ্য দিয়ে বেড়ে উঠছে বেশির ভাগ শিশু। এ নিয়ে সরকার তথা সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ যথেষ্ট চিন্তা-ভাবনা করছে এমন বলারও ফুরসত নেই। সত্য যে, আর্থ-সামাজিক পরিবেশের উন্নয়ন রাতারাতি সম্ভব নয়। কিন্তু চিকিত্সার অভাব পূরণ মোটেই অস্বাভাবিক নয়। এ বিষয়টি অবশ্যই নিশ্চিত করতে হবে সরকারকে। আমরা জানি, নিউমোনিয়া প্রতিরোধের প্রাথমিক বিহিত ভিটামিন ‘এ’ ট্যাবলেট সেবন। সরকারিভাবে বিশেষত নিম্নবিত্তের লোকদের কাছে এ ট্যাবলেট পৌঁছে দেয়া দরকার। ঠিকমতো শিশুকে সেগুলো খাওয়ানো হচ্ছে কিনা তার তদারকিও নিশ্চিত করতে হবে। সর্বোপরি শিশু স্বাস্থ্যের ঝুঁকি কমাতে সচেতনতা বাড়ানোর জন্য বিশেষ স্বাস্থ্য প্রকল্প নিয়ে তা বাস্তবায়ন করতে হবে অগ্রাধিকার ভিত্তিতে।

No comments

Powered by Blogger.