নিশীথ সূর্যের দেশে বাংলার বীরগাথা by আবুল কালাম মুহম্মদ আজাদ

দ্মাপারের রাজশাহী আর নরওয়ের ক্রিস্টিয়ানস্যান্ড। সাত সমুদ্র তেরো নদীর ওপারের দুটি শহর ‘বন্ধু’ হলো কীভাবে? কীভাবেই বা বাংলাদেশের অসামান্য বীরত্বগাথা রচিত হলো নিশীথ সূর্যের দেশে? পড়ুন এবারের মূল রচনায়। ১৯৭১ সাল। যুদ্ধ চলছে। সারা দুনিয়ার সাংবাদিকদের দৃষ্টি পূর্ব পাকিস্তানের দিকে। যুদ্ধপরিস্থিতি ‘কাভার’ করতে তাঁরা ছুটে আসছেন। সেই দলে আছেন নরওয়ের একজন। নাম অডভার মুন্কস গার্ড। সবার দৃষ্টি যখন ঢাকার


দিকে, তখন অডভার চলে গেলেন রাজশাহী। টানা নয় মাস তিনি এই রাজশাহী থেকেই পাঠালেন যুদ্ধের খবর। রাজশাহীর মানুষের মুক্তিসংগ্রামের খবর লিখতে লিখতে, শহরের আনাচকানাচে ঘুরতে ঘুরতে কোনো এক ফাঁকে ভিনদেশি মানুষটি ভালোবেসে ফেললেন রাজশাহী নামের শহরটাকে। যুদ্ধের শেষে তিনি যথারীতি ফিরে যান নিজ দেশে। কিন্তু ভুলতে পারেন না যুদ্ধের সময়েও রাজশাহীর মানুষের দিলখোলা আতিথেয়তার কথা, আন্তরিকতার কথা। অডভার দেশে ফিরে গিয়েছিলেন। আর তাঁর মন পড়ে ছিল পদ্মাপারের এক শহরে। সে কারণেই সম্ভবত তিনি ভাবছিলেন অন্য একটা কিছু। ভাবছিলেন, কী করে তাঁর নিজের শহর ক্রিস্টিয়ানস্যান্ড ও রাজশাহীর মধ্যে একটা আত্মীয়তা গড়ে তোলা যায়। আজ অডভার মুন্কস গার্ড নেই। কিন্তু দেরিতে হলেও সত্যি হয়েছে তাঁর স্বপ্ন। নিশীথ সূর্যের দেশ নরওয়ের ক্রিস্টিয়ানস্যান্ড সিটি এখন রাজশাহী মহানগরের ‘সিস্টার সিটি’। নরওয়ের দক্ষিণের এই শহরেই তৈরি হয়েছে আবহমান বাংলা ও যুদ্ধবিজয়ী বীর বাঙালির বীরত্বগাথা নিয়ে একটি সুদীর্ঘ ম্যুরাল। গত ২৪ অক্টোবর এটি উন্মোচন করা হয়েছে, যেখানে জীবন্তু হয়ে আছে আমাদের বাংলাদেশ ও মুক্তিযুদ্ধের বীরত্বগাথা।

ক্রিস্টিয়ানস্যান্ডে স্মরণীয় একদিন
সেদিন ছিল জাতিসংঘ দিবস। ক্রিস্টিয়ানস্যান্ডে বেরিয়েছে ভিন্নধর্মী এক শোভাযাত্রা। শোভাযাত্রার অগ্রভাগে আছেন দুই শহরের মেয়র। বিউগল বাজছে। রাজশাহীর মেয়র এ এইচ এম খায়রুজ্জামান ও ক্রিস্টিয়ানস্যান্ড সিটির মেয়র অরভিড ব্রুনডেকগন। দুজনের হাতেই বন্ধুতের প্রতীক গোলাপ ফুল।
আর তাঁদের পেছনে পেছনে দুই দেশের পতাকা হাতে স্থানীয় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীদের দীর্ঘ সারি।
‘সেটা একটা অন্য রকম দিন ছিল। শুধু শোভাযাত্রাই নয়, আয়োজন করা হয় এক মনোজ্ঞ সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের। দুই দেশের ভৌগোলিক দূরত্বের কথা তখন আমাদের কারও মনে ছিল না। ক্রিস্টিয়ানস্যান্ড সিটির মেয়র অরভিড ব্রুনডেকগন বলছিলেন, রাজশাহী তাঁদের অনেক পুরোনো বন্ধুশহর। এই ম্যুরালের মাধ্যমে তাঁরা রাজশাহীসহ বাংলাদেশকে কাছ থেকে জানার সুযোগ পেয়েছেন। এই সিটির মানুষকে বাংলাদেশ সম্পর্কে জানার এত বড় সুযোগ করে দেওয়ায় তিনি রাজশাহী সিটি করপোরেশনের কাছে কৃতজ্ঞতাও প্রকাশ করেন।’ ২৪ অক্টোবরের অসাধারণ সেই অভিজ্ঞতা বর্ণনা করছিলেন রাজশাহীর মেয়র। তিনি আরও বলছিলেন, ‘আমাদের প্রিয় মাতৃভূমি বাংলাদেশ, বাঙালি জাতির হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ অর্জন মুক্তিযুদ্ধসহ পুরো বাংলাদেশকে বিদেশের মাটিতে প্রতিষ্ঠা করতে পেরে আমি অত্যন্ত আনন্দিত। এ ছবি শত বছর ধরে সে দেশে বাংলাদেশের প্রতিনিধিত্ব করবে। পুরো আয়োজনের জন্য আমরা ক্রিস্টিয়ানস্যান্ড সিটির কাছে কৃতজ্ঞ।’

শিল্পীর কথা
ম্যুরাল তৈরি করতে নরওয়ে গিয়েছিলেন রাজশাহীর ইসমাইল হোসেন ও তাঁর মিস্ত্রি সইবুর রহমান। তবে তাঁর সঙ্গে ঢাকায় এ কাজে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছেন তাঁর ওস্তাদ মাহমুদুর রহমান। সহযোগিতা করেছেন দিব্য, তুহিন ও আরিফ। তাঁদের সবার নামই শিল্পী হিসেবে ম্যুরালে লেখা রয়েছে। ইসমাইল হোসেন বলছিলেন, ‘২০০৯ সালের কথা। আমি রাজশাহী সিটি করপোরেশনের মেয়রকে একটি শিল্পকর্ম উপহার দিতে এসেছিলাম। সে সময় মেয়র আমাকে এ কাজের প্রস্তাব করেন। এ জন্য তিনি প্রথমে আমাকে একটি ড্রয়িং তৈরি করতে বলেন। ড্রয়িং দেখেই মেয়র খুশি হন। তারপর আমরা ঢাকায় বসে পাঁচ মাসে কাজটি শেষ করে ফেলি। এটা রং-তুলিতে করা যেত, কিন্তু আমরা তা করিনি। কাজ শেষ করে ৪৭টি কার্টনে ভরে সব প্রস্তুত করে রেখেছিলাম। তারপর দুই দেশের আনুষ্ঠানিকতা সম্পন্ন করতে দেড় বছর সময় চলে যায়।’ রাজশাহী সিটি করপোরেশন ২০১০ সালের ডিসেম্বর মাসে জাহাজে করে কার্টনগুলো নরওয়ে পাঠায়। ইসমাইল ও সইবুর রহমান নরওয়ে যান।
‘সেখানে কীভাবে যেন খবর রটে যায়। স্থানীয় পত্রিকার সাংবাদিকেরা ছুটে আসেন। সেখানকার কাগজের এক পাতাজুড়ে আমাদের কাজের ছবি ছাপা হলো। নরওয়েপ্রবাসী বাংলাদেশিরা অনেকে এসেছিলেন।’ বলছিলেন ইসমাইল।
মাহমুদুর রহমান ও ইসমাইল হোসেন ঢাকাভিত্তিক ডিএনআই স্টুডিওর স্বত্বাধিকারী। তাঁরা ম্যুরাল নির্মাণ করে থাকেন।

বন্ধুত্বের ইতিহাস
সাংবাদিক অডভার মুন্কস গার্ডই রচনা করেছিলেন দুই নগরের বন্ধুত্বের সেতুবন্ধ। তিনি ছিলেন রাজশাহী খ্রিষ্টান মিশন হাসপাতালের তৎকালীন তত্ত্বাবধায়ক ইউ এন মালাকারের ঘনিষ্ঠ বন্ধু। মালাকারের মাধ্যমে রাজশাহীতে ক্রিস্টিয়ানস্যান্ড ফ্রেন্ডশিপ কমিটির কার্যক্রম শুরু হয়। ইউ এন মালাকার অবসর নেওয়ার পর রাজশাহী খ্রিষ্টান মিশন হাসপাতালের তত্ত্বাবধায়ক হিসেবে প্যাট্রিক বিপুল বিশ্বাস দায়িত্বভার গ্রহণ করেন। অডভার মুন্কস গার্ড ১৯৮৭ সালে প্যাট্রিক বিপুল বিশ্বাসকে ক্রিস্টিয়ানস্যান্ড ফ্রেন্ডশিপ কমিটির পক্ষে নরওয়েতে আমন্ত্রণ জানান। বিপুল বিশ্বাস নরওয়ে থেকে ফিরে এসে রাজশাহী শহরের কিছু গণ্যমান্য ব্যক্তিকে নিয়ে ১৯৮৯ সালে সাত সদস্যের একটি কমিটি গঠন করেন। এর নাম দেওয়া হয় ‘রাজশাহী-ক্রিস্টিয়ানস্যান্ড ফ্রেন্ডশিপ কমিটি’। এই কমিটি রাজশাহী ও ক্রিস্টিয়ানস্যান্ডের সম্পর্কের ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। ২০০৮ সালে প্যাট্রিক বিপুল বিশ্বাসকে সভাপতি করে ১১ সদস্যের নতুন কমিটি পুনর্গঠিত হয়। বর্তমানে এই কমিটিই কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছে। এই কমিটি দুই শহরের বন্ধুত্বকে আরও গভীর করার লক্ষ্যে কাজ করছে; রাজশাহী সিটি করপোরেশনের বর্তমান পরিষদ বাংলার ইতিহাস, ঐতিহ্য ও সংস্কৃতিকে নরওয়েবাসীর কাছে পরিচিত করিয়ে দিতে উদ্যোগ গ্রহণ করে।
ম্যুরালের ফলক উন্মোচনের দিন দুই শহরের পক্ষ থেকে উপস্থিত ছিলেন অনেকেই। ছিলেন প্যাট্রিক বিপুল বিশ্বাস ও তাঁর স্ত্রী শিখা বিশ্বাস, অধ্যাপক খালেকুজ্জামান, সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব ফেরদৌস হাসান প্রমুখ। শুধু ছিলেন না সেই বাংলাদেশপ্রেমী সাংবাদিক অডভার মুন্কস গার্ড, যিনি এই দুই নগরের বন্ধুত্বের স্বপ্ন দেখেছিলেন। পাঁচ বছর আগে তিনি পাড়ি জমিয়েছেন অন্য ভুবনে।

ফিরে দেখা বাংলাদেশ
ম্যুরালটির আয়তন এক হাজার ১০৫ বর্গফুট। এটি স্থাপন করা হয়েছে ক্রিস্টিয়ানস্যান্ড সিটির জনসমাগমমুখর একটি জায়গায়, যেখানে সারা বছর বিভিন্ন অনুষ্ঠান লেগেই থাকে। আসে সারা পৃথিবীর পর্যটকেরা। এর এক হাজার বর্গফুটজুড়ে আছে বাংলাদেশের ইতিহাস-ঐতিহ্যের ১৪ রকমের ছবি এবং ১০৫ বর্গফুটে আছে এর শিরোনাম। ছবিতে বাঁ দিক থেকে রয়েছে বায়ান্নর ভাষা আন্দোলন, বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক সাতই মার্চের ভাষণ, মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন প্রবাসী সরকারের মন্ত্রী ও জাতীয় চার নেতা—এ এইচ এম কামরুজ্জামান, সৈয়দ নজরুল ইসলাম, তাজউদ্দীন আহমদ ও ক্যাপ্টেন মুনসুর আলী, ’৭১-এর রণাঙ্গন, তৎকালীন রেসকোর্স ময়দানে (বর্তমান সোহ্রাওয়ার্দী উদ্যান) পাকিস্তানি বাহিনীর পক্ষে লে. জেনারেল এ এ কে নিয়াজির আত্মসমর্পণ, মুক্তিসেনাদের বিজয়োল্লাস, স্মৃতিসৌধ, শহীদ মিনার, সংসদ ভবন প্রভৃতি দৃশ্যাবলি। আছে তালগাছে ঝুলে থাকা বাবুই পাখির বাসা, বাংলার কৃষকসহ নানা দৃশ্য। এসব দেখে একনজরে পুরো বাংলাদেশকে চেনা যায়।
স্বাভাবিকভাবেই আবেগে আপ্লুত নরওয়েপ্রবাসী বাঙালিরা। টেলিফোনে কথা হয় নরওয়েপ্রবাসী বাংলাদেশি শরীফুল ইসলামের সঙ্গে। তিনি নরওয়ের ক্রিস্টিয়ানস্যান্ড সিটিতে থাকেন। ম্যুরালটা তাঁর বাসার খুব কাছেই। বাংলাদেশ থেকে ফোন পেয়েই শরীফুলের গলায় পাওয়া যায় সেই আবেগ। বললেন, ‘আমার স্ত্রী-কন্যাকে আমি কোনো দিন আমার প্রিয় জন্মভূমি বাংলাদেশ দেখাতে পারিনি। আজ আমি আমার বাংলাদেশকে কাছে পেয়েছি। আমার স্ত্রী-কন্যারা দেখছে বাঙালির স্বাধিকার আন্দোলনের গৌরবগাথা, আবহমান বাংলার বটতলার মেলা, কৃষক-তাঁতি-জেলের জীবনসংগ্রামের ছবি—এই তো আমার বাংলাদেশ।’

No comments

Powered by Blogger.