এডওয়ার্ড সাঈদ, ব্রতচারী নৃত্য ও সেক্যুলার শিক্ষা by ফাহমিদ-উর-রহমান

রস্লম এডওয়ার্ড সাঈদের মশস্লর কেতাব ঙত্রবহঃধষরংস সম্পর্কে এখন বাংলাদেশের অনেকেই জানেন। বিশেষ করে যারা শিল্প-সাহিত্য জগতের খোঁজখবর কিছুটা রাখেন। সাঈদ সাহিত্যের অধ্যাপক ছিলেন। কিন্তু ঠিক সাহিত্যের কারণে তার জগতজোড়া খ্যাতি বিস্তৃত হয়নি। তার খ্যাতির মূলে আছে ঙত্রবহঃধষরংস বইটি। এ বইতে তিনি প্রথাগত কোনো সাহিত্য আলোচনা করেননি, বরং পশ্চিমা শিল্প সংস্কৃতির অন্তর-বাহির বিশ্লেষণ করে তিনি এখানে আরব তথা ইসলাম জগতের প্রতি পাশ্চাত্যের ঘৃণা, বিদ্বেষ ও বর্ণবাদী দৃষ্টিভঙ্গির উত্স ও মনোজাগতিক কাঠামোকে বিচার করতে চেয়েছেন।
পশ্চিমারা ইসলামী সভ্যতাকে কীভাবে দেখে এবং ওই দেখার ভেতর দিয়ে ইসলাম প্রধান জনগোষ্ঠীকে কীভাবে তারা শত্রুজ্ঞান করে তার একটি ধারণা তিনি আমাদের দিয়েছেন। সেই ধারণাগুলো আবার কী করে আমাদের সামাজিক ক্রিয়াকলাপ, রাজনীতি, সাংস্কৃতিক চিন্তাকে নিয়ন্ত্রণ করে তার কথাও তিনি বলেছেন। জীবদ্দশায় সাঈদ বিস্তর লেখালেখি করেছেন, বিশেষ করে ফিলিস্তিন সমস্যা, ইসলাম ও ইসলাম প্রধান জনগোষ্ঠীর প্রতি পাশ্চাত্যের বর্ণবাদী ও ঔপনিবেশিক দৃষ্টিভঙ্গি এবং আরবদের নিয়ে মার্কিন-ইস্লদি লবির কূটরাজনীতির স্বরূপ উন্মোচনে তার ক্লান্তি ছিল না। সাঈদের সবচেয়ে বড় কাজ হচ্ছে আরব তথা ইসলাম জগত নিয়ে কীভাবে পশ্চিমারা জ্ঞানের নতুন তত্ত্ব তৈরি করেছে এবং ইসলামী জনগোষ্ঠীর চিন্তা, কল্পনা, অনুভবকে আবদ্ধ করার শিকল তৈরি করেছে তার জারিজুরি তিনি ফাঁস করে দিয়েছেন। একই সঙ্গে রাজনৈতিক-সাংস্কৃতিকভাবে উপনিবেশবাদ, সাম্রাজ্যবাদ বিরোধিতার উপর জোর দিয়েছেন। ফলে বর্ণবাদ, ঔপনিবেশিকতা, সাম্প্রদায়িকতা এবং সাংস্কৃতিক আত্মপরিচয়ের লড়াই সম্পর্কে নতুন করে ভাবার অনেক সুবিধা হয়েছে।
সম্প্রতি বাংলাদেশের কয়েকজন বিদ্বান ও পণ্ডিত ব্যক্তি মিলে একটি শিক্ষানীতি প্রণয়ন করেছেন যার উদ্দেশ্য হিসেবে বলা হয়েছে দেশে একটা সেক্যুলার শিক্ষা ব্যবস্থা গড়ে তোলা। সম্ভবত: তাদের উদ্দেশ্য হচ্ছে এই ব্যবস্থা চালু করে তারা একটা ‘সেকুলার বাংলাদেশ’ গড়ে তুলবেন। বাংলাদেশের এই শ্রেণীর পণ্ডিতরা সেকুলারিজমের মাহাত্ম্যে এমনই বুঁদ হয়ে আছেন যে, তারা কথায় কথায় পাশ্চাত্যের অনুকরণে আমাদের জীবনকে গড়তে চান। সেকুলারিজম বলতেই তারা উদারনীতি, সহনশীলতা, প্রগতিশীলতা, অসাম্প্রদায়িকতা, পারস্পরিক সহাবস্থানের মতো কতকগুলো কেচ্ছা আমাদের সামনে জোরেশোরে খাড়া করেন। এর বিপরীতে ধর্ম বিশেষ করে ইসলামকে অসহনশীল, গোড়া, প্রগতি ও মুক্তবুদ্ধির বাধক এবং মধ্যযুগীয় প্রমাণ করার জন্য রীতিমত ডনকুইকজোটের মতো মল্লযুদ্ধে নেমে পড়েন। অন্যথায় তাদের প্রগতিশীলতার তকমা ছুটে যায় আর কি। আসলে তারা এক মানসিক দাসত্বের বন্ব্দনে আবদ্ধ হয়ে আছেন।
মনে হয় আমরা নতুন এক আইয়ামে জাহেলিয়ার যুগে প্রবেশ করেছি, যেকালে এডওয়ার্ড সাঈদ পড়লে আমাদের কিছুটা কাজে লাগতে পারে। কারণ, যা কিছু ইসলাম আর ইসলামী সংস্কৃতি, মূল্যবোধ ও বিশ্বাসের সঙ্গে জড়িত তার প্রতি ঘৃণা, ন্যক্কার ও শত্রুতার উত্স খুঁজতে হবে ঔপনিবেশিকতা এবং পাশ্চাত্যের বর্ণবাদী সংস্কৃতি ও চিন্তার মধ্যে। আমাদের শস্লরে শিক্ষিত মধ্যবিত্ত, তথাকথিত আধুনিক, প্রগতিশীল ও সেক্যুলার লোকজনের শিরায় বইছে এই বিষ। কারণ, এই শ্রেণীর জন্ম ঔপনিবেশিকতার ঔরসে। তাদের চিন্তার ভিত তৈরি হয়েছে ঔপনিবেশিকতার ছককাটা কাঠামোর মধ্যে। সেই কারণেই আজ দেখছি ঘোরতর ইসলাম বিদ্বেষ ও ইসলাম প্রধান জনগোষ্ঠীর সংস্কৃতির প্রতি নির্বিচারে আমূল ঘৃণার বহিঃপ্রকাশ ঘটছে। না হলে মাদ্রাসা শিক্ষা, আরবি শিক্ষা প্রভৃতির প্রতি এই শ্রেণীর ন্যক্কার আজ গোপন কিছু বিষয় নয়, অথচ আধুনিক শিক্ষা ও ইংরেজি মাধ্যম শিক্ষার প্রতি এদের প্রীতি লক্ষ্য করার মতো। মাদ্রাসা শিক্ষা নাকি আমাদের পিছু টেনে ধরেছে—প্রগতিবাদীদের এই সমালোচনা কবুল করেই বলছি তাহলে ঔপনিবেশিক আধুনিক শিক্ষা কি আমাদের গোলামে পরিণত করছে না—সে বিতর্ক কে করবে? আমরা কথায় কথায় মাদ্রাসা শিক্ষার সংস্কার চাই কিন্তু আধুনিক শিক্ষা বিনা বিচারে গ্রহণ করি কোন যুক্তিতে? আধুনিক শিক্ষার ঔপনিবেশিক ও সাম্রাজ্যবাদী ভিত্তি সম্পর্কে আমাদের সেক্যুলার ভাবুকরা নীরব কেন? মাদ্রাসাগুলো নাকি সন্ত্রাসবাদ প্রজননের ক্ষেত্র। এগুলোতে নাকি ওসামা বিন লাদেনের ব্যাঙ্গাচিরা কিলবিল করছে। প্রগতিবাদীদের এই প্রচারণা বিশ্লেষণ করলে বোঝা যাবে ইসলাম ও ইসলাম প্রধান জনগোষ্ঠী নিয়ে আজকে আন্তর্জাতিক রাজনীতির যে মেরুকরণ ঘটছে সেই মেরুকরণে এরা সাম্রাজ্যবাদীদের স্রেফ হাতের পুতুল মাত্র। ইরাক আফগানিস্তানে সেক্যুলার পশ্চিমা সভ্যতার সন্তানরা লাখ লাখ মানুষকে ইতোমধ্যে খুন করেছে—এ নিয়ে আমাদের এই প্রগতিশীল শ্রেণীর কোনো নীতিগত প্রতিক্রিয়া না থাকলেও আজ যদি মাদ্রাসার তালেব এলেমরা ইরাক, আফগানিস্তানের এই হলোকসেল্টর বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানাতে রাজপথে নেমে আসে তবে মাদ্রাসা নিয়ে গণমাধ্যমগুলোতে এই শ্রেণীর রগরগে কেচ্ছাকাহিনী প্রকাশ করতে দ্বিধা জাগবে না।
এই শ্রেণীর বিশ্বাস আধুনিক শিক্ষা নাকি উন্নতির একমাত্র মডেল। মাদ্রাসা শিক্ষার বিপরীতে আধুনিক শিক্ষার উপর এ ধরনের নির্বিচার বিশ্বাসও এক ধরনের অন্ব্দতা—যা মেনে নেয়া যায় না। মাদ্রাসা হচ্ছে ইসলামের বুনিয়াদী শিক্ষার জায়গা। আসল কথা হচ্ছে এখান থেকে যে মন তৈরি হয় তা আর যাই হোক আজকের সেক্যুলার বিশ্বব্যবস্থাকে সমর্থন করে না। এই কারণেই পশ্চিমা সাম্রাজ্যবাদ ও তার দেশজ সেক্যুলার মিত্রদের মাদ্রাসা শিক্ষার প্রতি এত ন্যক্কার। এদের লেখা পড়লে এদের কথা শুনলে হাতে পায়ে শিকল পরা গোলামীর কণ্ঠস্বরই শুনতে পাই। সম্প্রতি প্রকাশিত ও বস্ল সমালোচিত শিক্ষা নীতিতে এসব কণ্ঠস্বরই আমরা পুনর্বার শুনতে পেয়েছি মাত্র। শিক্ষা সম্পর্কে এদের কাছে মৌলিক, বিশ্লেষণমূলক ও স্বাধীন মতামত আশা করা অনেকটা কাঁঠালের আমসত্ত্বের মতো ব্যাপার আর কি।

শিক্ষা ব্যবস্থাকে সেক্যুলারিকরণ করার জন্য এসব ‘পণ্ডিত’ ব্যক্তিরা ছাত্রছাত্রীদের ব্রতচারী নৃত্য ও দর্শনে উদ্বুদ্ধ করার কথা বলেছেন। সেক্যুলারিজম প্রতিষ্ঠার সঙ্গে ব্রতচারী দর্শনের সম্পর্কটা কি, তা এসব ‘পণ্ডিতকুল’ আমাদের খোলাসা করে কখনও বলেননি।
ব্রতচারী আন্দোলনের প্রবর্তক ছিলেন গুরু সদয় দত্ত। ইনি ব্রিটিশ আমলের আইসিএস হয়েছিলেন এবং সেকালের ডিসিল্ট্রক্ট ম্যাজিসেল্ট্রটসহ সরকারের বিভিন্ন উচ্চপদে অধিষ্ঠিত ছিলেন। সেকালে গুরু সদয় দত্তকে ব্রিটিশ সরকারের খুব কাছের মানুষ হিসেবে মনে করা হতো।
ব্রত কথাটার অর্থ হচ্ছে দেবতার আরাধনা। সেই হিসেবে ব্রতচারী কথাটার মানে দাঁড়াচ্ছে দেবতার আরাধনাকারী। বিশ শতকের প্রথমভাগে বাঙালি হিন্দু সমাজে ধর্মীয় জাতীয়তাবাদের এক প্রবল উত্থান আমরা দেখতে পাই। প্রাচীন হিন্দু ধর্মীয় শক্তি সাধনার ধারাকে পুনরুজ্জীবিত করে সেদিন বাঙালি হিন্দু যুবকরা দলে দলে ব্রিটিশবিরোধী স্বাধীনতা সংগ্রামে ঝাঁপিয়ে পড়ে। অনুশীলন, যুগান্তরের মতো বিপ্লবী দলগুলো এ সময়ই তৈরি হয়। সূর্যসেন, ক্ষুদিরাম এদেরই সৃষ্টি। এরা মন্দিরে গিয়ে কালিমূর্তিকে সামনে রেখে এবং গীতা স্পর্শ করে বিপ্লবে দীক্ষা নিতেন। ব্রিটিশরা এদের টেররিসল্ট বলত। এসব বিপ্লবীর আত্মত্যাগকে ছোট করার কিছুই নেই। কিন্তু এদের আন্দোলন কোনোভাবেই সেক্যুলার জাতীয়তাবাদী আন্দোলন ছিল না। মওলানা আজাদ লিখেছেন—এসব আন্দোলনকারী ব্রিটিশ বিরোধিতার পাশাপাশি মুসলিম বিরোধীও ছিল। সেই হিসেবে এই আন্দোলনের চরিত্র ছিল সাম্প্রদায়িক।
গুরু সদয় দত্তের ব্রতচারী আন্দোলনের প্রেরণার উত্সও ছিল প্রাচীন হিন্দু ধর্মীয় শক্তি সাধনার ধারা। এই আন্দোলনে তিনি নৃত্য, সঙ্গীত, শরীরচর্চার উপর জোর দিয়েছিলেন এবং উদ্দেশ্য হিসেবে জ্ঞান, শ্রম, স্বাস্থ্য জ্ঞান, সঞ্চয়শীলতা, সত্যনিষ্ঠা, সংযম, নিরভিমানিতা, প্রফুল্লভাব, অধ্যবসায়, শিষ্ট ব্যবহার, আত্মনির্ভরতা, সমাজ সংস্কার প্রভৃতি বিষয়ের কথা বলা হয়েছিল।
ব্রতচারী নৃত্যের মধ্যে বস্ল রকমের নৃত্যের সমন্বয় করা হয়েছিল। এর মধ্যে কাঠি নৃত্য, ঢালি নৃত্য, কীর্তন নৃত্য, মাদল পূজা নৃত্য, ব্রত নৃত্য, রায় বেঁশে নৃত্য ছিল অন্যতম। এগুলোকে আবহমান ও প্রাচীন ভারতের ছন্দধারার এক বিশেষ রূপ হিসেবে দেখা হতো।
ব্রতচারী সঙ্গীতের মধ্যে অন্যতম সঙ্গীত ছিল কীর্তন, যা হচ্ছে এক ধরনের হিন্দু ধর্মীয় সঙ্গীত। সেদিনের এই নৃত্য ও সঙ্গীতের অনেক কিছুই ছিল হিন্দু ধর্মীয় ভাবরসে পূর্ণ। সে হিসেবে এর জাতীয় চরিত্র খোঁজা নিরর্থক। এ কারণে ব্রতচারী আন্দোলন সেকালে বাঙালি হিন্দু সমাজের মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল। বাঙালি মুসলিম সমাজে এর তেমন কোনো আবেদন দেখা যায়নি। যদিও গুরু সদয় দত্ত এটাকে বলতেন দেশজ ধরনের বয়স্কাউট বা গার্লস গাইড আন্দোলন। প্রশাসনিক সুবিধার কারণে দত্ত মহাশয় এই আন্দোলন বাংলার স্কুল-কলেজগুলোতে প্রবেশ করানোর চেষ্টা করেছিলেন। আবার নানা রকম সরকারি সাহায্যও তিনি পেয়েছিলেন।
ব্রতচারী আন্দোলনের সঙ্গে স্বদেশি আন্দোলনের সবচেয়ে বড় তফাত্ ছিল এটা ব্রিটিশ বিরোধী ছিল না। ব্রিটিশ গোয়েন্দারা এ আন্দোলনের মাধ্যমে হিন্দু যুবক ও তরুণদের স্বদেশি আন্দোলন থেকে দূরে রাখার কৌশল গ্রহণ করেছিল। এ ধরনের একটা হিন্দু ধর্মাশ্রিত আন্দোলনের অংশ ব্রতচারী নৃত্যকে কীভাবে সেক্যুলার শিক্ষার উপাদান হিসেবে গ্রহণ করা যেতে পারে তা বোঝা বেশ দুষ্কর। এ দেশে সেক্যুলারিজম মানে আবশ্যিকভাবে ইসলাম বিরোধী হওয়া এবং অন্য ধর্মের প্রতি সুশীল আচরণ করা। এখানে আমরা দেখেছি বিভিন্ন সময় স্কুল পর্যায়ে আরবি ও ইসলামী শিক্ষার প্রচলনের বিরুদ্ধে ছাত্র আন্দোলনকে লেলিয়ে দেয়া হয়েছে যার নেপথ্যে সেক্যুলারিসল্টরাই কাজ করেছে। আরও মজার ব্যাপার হচ্ছে সেক্যুলারিজম প্রতিষ্ঠার জন্য বিভিন্ন সময় বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠান থেকে ইসলাম ও মুসলমান সম্পর্কিত নামগুলো উত্খাত করা হয়েছে অথচ অন্যান্য ধর্মীয় শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো অক্ষত রয়ে গেছে। সেক্যুলারিজমের আড়ালে এই বিপরীত আচরণ কেন? এর উত্সও খুঁজতে হবে ঔপনিবেশিকতার জঠরে। এদেশে সেক্যুলারিজম নামের সাম্রাজ্যবাদী জ্ঞানতত্ত্বের বহিঃপ্রকাশও ঘটেছিল ইউরোপীয় ঔপনিবেশিকদের হাত ধরে এবং এর প্রথম কনজিউমার ছিল উনিশ শতকীয় কলকাতার বাবু বুদ্ধিজীবীরা যারা সেক্যুলারিজম ও সাম্প্রদায়িকতার যুগপত্ চর্চা করেছিল। তাই এদেশে সেক্যুলারিজমের বিশেষ চরিত্র হচ্ছে একদিকে পাশ্চাত্য সভ্যতার মডেলকে বিনা সমালোচনায় গ্রহণ করা, অন্যদিকে কলকাতার বাবু সংস্কৃতির গোলামি করা। ওই গোলামির খাসিলত থেকেই ব্রতচারী নৃত্যের আজ আমাদের সমাজে অনুপ্রবেশ ঘটছে।

সেক্যুলারিজম একটা ইউরোপীয় ঘটনা। ইউরোপীয় সমাজ বিকাশের ধারায় সেখানে এই ধারণার বিকাশ। ইউরোপে সেক্যুলারিজমের বাড়বাড়ন্তের একটা কারণ হলো সেখানকার রোমান চার্চের স্বৈরতন্ত্রী আচরণ। রোমান চার্চ ইউরোপের অধিকাংশ জমির মালিক হয়ে সামন্তপ্রভুতে পরিণত হয়েছিল। ধর্মীয় চিন্তার ক্ষেত্রে কোনো ভিন্নমত চার্চ সহ্য করতে প্রস্তুত ছিল না। চার্চের চোখে যারাই অবিশ্বাসী তাদেরই সমাজচ্যুত করা হতো, এমনকি পুড়িয়ে মারাও হতো। চার্চের এই দণ্ডকে ইনকুইজিসন বলা হতো। চার্চের এই অত্যাচারের হাত থেকে মুক্তি পাওয়ার জন্য ইউরোপের মানুষ সেক্যুলারিজমের দিকে ঝুঁকেছিল।
চার্চের উগ্রতা থেকে প্রতিক্রিয়াবশত আরেক ধরনের উগ্রতার জন্ম হলো। ইউরোপের মানুষ ধর্মকে প্রান্তিক অবস্থানে ঠেলে দিল এবং ধর্ম ও জাগতিক বিষয়কে পৃথক করে ফেলল। ইউরোপের মানুষ ধর্ম থেকে অনেকটা সরে এলো। নাস্তিকতার বাড়বাড়ন্ত হলো। তাদের কাছে ধর্মীয় নীতিনৈতিকতা, মূল্যবোধ, স্বর্গের প্রতিশ্রুতি, আত্মার মুক্তি প্রভৃতির চেয়ে জাগতিক বিষয়গুলো বেশি মূল্যবান হয়ে উঠল এবং তারা জীবনকে যেভাবে উপভোগ করতে চায়—তার উপর কোনো প্রতিবন্ব্দকতা সৃষ্টি হতে দিতে রাজি ছিল না। এ কারণে সেক্যুলারিজমের বাংলায় আরেকটি অর্থ করা হয়েছে—ইহজাগতিকতাবাদ। এটাকে রাষ্ট্রবিজ্ঞানে ব্যাখ্যা করা হয়েছে এভাবে : রাষ্ট্র শুধু জনগণের ইহজাগতিক কল্যাণের বিষয়ে খোঁজ-খবর রাখবে। পারলৌকিক বা আধ্যাত্মিক কোনো বিষয়ে সম্পৃক্ত হবে না। এ প্রক্রিয়ায় ধর্মের সীমাকেও বেঁধে দেয়া হলো। ধর্ম ব্যক্তির ব্যক্তিগত বিষয় হিসেবে স্বীকৃতি পেল। পশ্চিমে সেক্যুলারিজমের বিকাশের এই ইতিহাস দিয়ে মুসলিম সমাজকে ব্যাখ্যা করা নিরেট বোকামি ছাড়া কিছু নয়। কারণ, ইসলামের ইতিহাসে চার্চের ইনকুইজিসনের মতো ঘটনা নেই। মুসলিম সমাজে বস্লত্ব, উদারতা, সহনশীলতার নজিরও ভূরি ভূরি। বাংলাদেশের সেক্যুলার পণ্ডিতরা ইসলাম ও পশ্চিমা সমাজের এই পার্থক্য সম্পর্কে যথেষ্ট সচেতন বলে মনে হয় না। তাই এসব লোক যখন রাষ্ট্রদর্শন নির্ধারণের কথা বলে তখন আমাদের মনে রাখতে হবে এদের দ্বারা কল্যাণের চেয়ে অকল্যাণের সম্ভাবনাই বেশি।
আবার ইসলাম ইউরোপীয় অর্থে কোনো ব্যক্তিগত বিশ্বাসের নাম নয়। এর যেমন আধ্যাত্মিক বিষয় আছে, তেমনি আছে জাগতিক বিষয়। ইসলামী আইন যাকে শরিয়া বলা হয়, তার একটা বড় অংশই দৈনন্দিন জীবনের চ্যালেঞ্জগুলোকে মোকাবেলার জন্যই প্রণীত হয়েছে।
ইসলামের নবী জ্ঞানার্জনের জন্য চীন দেশে যাওয়ার কথাও বলেছিলেন। চীনে তিনি কোনো আধ্যাত্মিক জ্ঞান অর্জনের জন্য যেতে বলেননি। অবশ্যই জাগতিক জ্ঞানের প্রয়োজনীয়তার উপরই তিনি গুরুত্ব দিয়েছিলেন। সেই অর্থে ইসলাম একটা সেক্যুলার বা জাগতিক ধর্মও বটে। বাংলাদেশে যেসব পণ্ডিত সেক্যুলারিজমের মাহাত্ম্যকে বর্ণনা করতে গিয়ে উদারতা, সহনশীলতার গজদন্ড মিনার তৈরি করে ফেলেন তাদের সেক্যুলারিজমের উল্টো পিঠ চোখে পড়ে না। সেক্যুলারিজমের উদারতা, সহনশীলতা আমরা ভালোমত টের পেয়েছি সাম্রাজ্যবাদ-ঔপনিবেশিকতার কালে। সেক্যুলার পশ্চিমা সভ্যতার সন্তানরাই তো যত রকমের জুলুম, শোষণ, পরজাতি পীড়নের মত ও পথ বেছে নিয়েছে। আণবিক বোমা, ক্লাসল্টার বোমা, নাপাম বোমা কোনো মাদ্রাসা শিক্ষিত মৌলবাদীর আবিষ্কার নয়। আফগানিস্তানে, ইরাকে লাখ লাখ মানুষকে খুন করার পরও যদি সেক্যুলার সহনশীলতার মাজেজা আমাদের চোখ খুলতে না পারে তাহলে আমাদের ভবিষ্যত্ বলে কিছু নেই।
সেক্যুলারিজমের মতো সেক্যুলার আধুনিক শিক্ষা যে আমাদের সন্তানদের ভবিষ্যেক নির্বিঘ্ন করতে পারবে এরকম তথ্য আমাদের সেক্যুলার ভাবুকরা কোথায় পেলেন? এখন আমেরিকা কী চায় সেটাই বড় কথা। এ অবস্থায় মনুষ্যত্ব ও মানুষের গুরুত্ব কোথায়? এরই নাম কি সেক্যুলারিজম?
সেক্যুলার শিক্ষার গুণে আজকের মার্কিন সমাজ একটা বন্দুকবাজ সমাজে পরিণত হয়েছে। দাঙ্গা-হাঙ্গামা, খুন-খারাবি, ধর্ষণ এখন আর সেখানে আকস্মিক ঘটনা নয়। আমরা কি এরকম অবস্থায় ফিরে যেতে চাইছি। তথাকথিত সেক্যুলার শিক্ষার প্রভাব কি আমাদের সমাজেও কিছু কিছু পড়ছে না? আমাদের সমাজ ভাঙছে, পরিবার ব্যবস্থা ভঙ্গুর হয়ে যাচ্ছে, মানবীয় সম্পর্কের মূল্যবোধগুলো ক্ষয়িষ্ণু হয়ে পড়ছে। দয়ামায়া প্রেমপ্রীতির জায়গায় স্থান নিচ্ছে আত্মস্বার্থপরতা, বিচ্ছিন্নতা আর ভোগবাদিতা।
সেক্যুলার শিক্ষা আমাদের কিছু জাগতিক চাহিদা মিটিয়েছে কিন্তু এর বিনিময়ে আমাদের হারাতেও হয়েছে অনেক কিছু। ড্রাগ, অ্যাবরশন, ফিদ্ধ সেক্স, লিভ টুগেদারের মতো সংস্কৃতিগুলো এখন আমাদের কানে বাজে। আমরা এখন বৃদ্ধাশ্রমের কথাও শুনছি। বলাবাস্লল্য এগুলো

No comments

Powered by Blogger.