মসৃণ নুড়ির সন্ধানরত এক বিজ্ঞানী by আসিফ

৬৯৬ সাল। সুইস গণিতজ্ঞ জোহান বার্নোলি 'ব্রাকিস্টোকর্ন প্রবলেম' নামে একটি অসমাধিত সমস্যা তারসহযোগীদের উদ্দেশে উত্থাপন করেন। ছয় মাস সময়ের মধ্যে তাদের সমাধান করে দেওয়ার কথাও বলেন। সমস্যাটিকে এভাবে বলা যায় : 'পরস্পর থেকে বিচ্যুত দুটো বিন্দুর সংযুক্ত রেখা বরাবর শুধুমাত্র মহাকর্ষের প্রভাবাধীন একটি বস্তুর সবচেয়ে স্বল্পতম সময়ে পতন নিরূপণ।' আসলে এটি ছিল একটি চ্যালেঞ্জ। পরে জার্মান গণিতজ্ঞ লিবনিজ


সমস্যাটির সমাধানের জন্য আরও এক বছর অর্থাৎ মোট দেড় বছর সময় দেওয়ার জন্য অনুরোধ করেন। অথচ সমস্যাটি নিউটনকে জানানো হয় ১৬৯৭ সালের ২৯ জানুয়ারি বিকেল ৪টায় এবং নিউটন পরদিন সকালে কাজে যাবার আগেই সমস্যাটির সমাধান করেন। আর এ কাজ করতে গিয়ে তিনি গণিতশাস্ত্রের 'ক্যালকুলাস অব ভ্যারিয়েশন ' নামে নতুন একটি শাখা আবিষ্কার করেন। নিউটনের অনুরোধে এ সমাধান নিউটনের নাম উল্লেখ না করে পত্রিকাতে ছাপানো হয়। পত্রিকায় সমাধানটি দেখলে বার্নোলির মন্তব্য ছিল, অ ষরড়হ রং শহড়হি নু রঃং পষধংি অর্থাৎ সিংহকে চেনা যায় তার থাবা দেখে। রোগাটে পিতা-মাতার স্নেহবঞ্চিত, ঝগড়াটে এবং অসামাজিক চিরকুমার নিউটন, কার্ল সাগানের ভাষায়, সম্ভবত বিজ্ঞানের ইতিহাসে সবচেয়ে প্রতিভাধর ব্যক্তি ছিলেন। দার্শনিক ও গণিতবিদ দেকার্ত এবং দার্শনিক ও পরীক্ষণবিদ বেকনের দ্বৈত-চিন্তাধারার সমন্বয় ঘটেছিল নিউটনের মধ্যে।

প্রকৃতি ছিল নিউটনের কাছে খোলা বইয়ের মতো
নিউটনের বেশির ভাগ বুদ্ধিবৃত্তিক উৎকর্ষ সাধিত হয়েছিল যুক্তিবাদ ও রহস্যবাদের টানাপড়েনে। তার একটি উদাহরণ এভাবে দেওয়া যায়_ ১৬৬৩ সালে ২০ বছর বয়সে তিনি স্টোয়ারব্রিজের মেলায় গিয়েছিলেন। গভীর আগ্রহে তিনি সেখান থেকে জ্যোতিষশাস্ত্রের ওপর পড়ার জন্য একটি বই কেনেন এবং একটানা বইটি পড়ে যেতে শুরু করলেন যতক্ষণ পর্যন্ত না বোঝার কোনো অসুবিধা হলো। তারপর এক জায়গায় ত্রিকোণমিতি না জানার কারণে বুঝতে অসুবিধা হচ্ছিল। ফলে তাকে ত্রিকোণমিতির ওপর একটি বই কিনতে হলো। কিন্তু নিউটন শিগগিরই নিজেকে আবিষ্কার করলেন যে, তিনি জ্যামিতির যুক্তিপ্রমাণ বুঝতে অক্ষম। অগত্যা খুঁজে বের করতে হলো ইউক্লিডের 'এলিমেন্টস অব জিওমেট্রি' গ্রন্থটি এবং তা পড়া শুরু করলেন। এর দু'বছর পরেই প্লেগ মহামারীর সময় উলসথর্পে তিনি ডিফারেন্সিয়াল ক্যালকুলাস আবিষ্কার করেন। আইনস্টাইন মন্তব্য করেছিলেন, 'প্রকৃতি হলো নিউটনের কাছে খোলা বইয়ের মতো যার ভাষা তিনি পড়তে পারতেন।' তিনি আমাদের হাজার বছরের গড়ে ওঠা ধ্যান-ধারণার মধ্যে পরিবর্তন ঘটিয়ে দিয়েছিলেন। তার মধ্যে সমন্বয় ঘটেছিল পরীক্ষণবিদ, তত্ত্ববিদ, যন্ত্রবিদ ও একজন বড় মাপের শিল্পীর। তিনি আজও আমাদের সামনে দাঁড়িয়ে আছেন একজন নিঃসঙ্গ অতিমানব হিসেবে।
অণু-পরমাণুর জগতের বাইরে, আলোর গতির তুলনায় যথেষ্ট ধীরগতিসম্পন্ন বস্তুর ক্ষেত্রে, কৃষ্ণগহ্বর ও নিউট্রন নক্ষত্রের মতো জায়গাগুলো ছাড়া অন্য জায়গাগুলোতে নিউটনীয় তত্ত্বের সঙ্গে আধুনিক পদার্থবিজ্ঞানের দুই স্তম্ভ কোয়ান্টাম বলবিজ্ঞান ও আপেক্ষিক তত্ত্ব ফলাফলে কোনো পার্থক্য নেই। তাই বলা যায়, আধুনিক পদার্থবিজ্ঞানের ধারণাগুলো নিউটনের ধারণার আরও বিস্তৃত রূপ, যা দিয়ে জগতকে আরও ভালোভাবে অনুধাবন করা সম্ভব। ১৬৪২ সালের ২৫ ডিসেম্বর, বড়দিনে ইংল্যান্ডের লিঙ্কনশায়ারের উলস্থর্প নামের একটি গ্রামে এক কৃষক পরিবারে নিউটনের জন্ম। আগামীকাল তার জন্মবার্ষিকী উপলক্ষে গভীরভাবে স্মরণ করছি।

No comments

Powered by Blogger.