সদরে অন্দরে-এমপির সুপারিশে ভর্তি হলে যোগ্যরা কোথায় যাবে by মোস্তফা হোসেইন

নপ্রতিনিধি জনস্বার্থকে প্রাধান্য দেবেন এটাই কাম্য। জনপ্রতিনিধি হওয়ার আগে তিনি এমনি প্রতিশ্রুতি জনগণকেও দিয়ে থাকেন। জনগণ তাঁর এই প্রতিশ্রুতিতে বিশ্বাস করে এবং তাঁকে নিজেদের প্রতিনিধি হিসেবে নির্বাচিত করে। কিন্তু আমাদের এখানে ব্যতিক্রম ছাড়া সবাই প্রতিশ্রুতির কথা ভুলে যান। নির্বাচিত হওয়ার পর নিজেকে নিয়েই অধিকতর ব্যস্ত হয়ে পড়েন। নিজের প্রতিশ্রুতির কথা বেমালুম ভুলে যান। নিজের আখের গোছাতে হেন কাজ নেই, যা করতে চান


না তিনি। এটা আমাদের এখানকার জনপ্রতিনিধিদের অধিকাংশের ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য বলে জনগণের পক্ষ থেকেই অভিযোগ করা হয়ে থাকে। কিন্তু এভাবে তিনি যদি বৈধ এবং অবৈধভাবে শুধু নিজেরটাই চিন্তা করেন এবং জনস্বার্থকে উপেক্ষা করেন, তাহলে তার সঙ্গে মাসলম্যানের পার্থক্য থাকে কোথায়? এর মাত্রা ও পরিমাণও দিনোত্তর বেড়ে যাচ্ছে। আমাদের জাতীয় সংসদ সদস্যরা রাষ্ট্র থেকে যে পরিমাণ ব্যক্তিগত সুবিধা পেয়ে থাকেন, তার কতটা রাষ্ট্রের জন্য প্রয়োজন, কতটা একান্তই তার ব্যক্তিগত প্রয়োজন, তা ভেবে দেখার প্রয়োজন দেখা দিয়েছে এ মুহূর্তে। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনক হচ্ছে, এ নিয়ে কেউ টুঁ-শব্দটিও করতে চাইছে না। এমনকি এ নিয়ে প্রশ্ন তোলার যে প্লাটফর্ম, সেখানেও গোপন আঁতাত থাকে। বিশেষ করে এমপিদের অনাকাঙ্ক্ষিত সুবিধা বৃদ্ধি হলেও সরকারবিরোধী শিবির থেকে তেমন টুঁ-শব্দটি করা হয় না। এমনকি যেসব রাজনৈতিক দলের কোনো এমপি নেই, তাঁরাও ভবিষ্যতে এমপি হওয়ার আশা পোষণ করে হয়তো এ বিষয়টি নিয়ে তেমন উচ্চবাচ্য করেন না। আর যদি কোনো দল করেও তাহলে তাঁর স্বর এতই অনুচ্চ থাকে যে এটা তাঁদের সভামঞ্চ ছাড়িয়ে জনতার কান পর্যন্ত পেঁৗছাতে পারে না। কিংবা তাদের সাংগঠনিক শক্তি এতই দুর্বল যে তা সরকার তাঁদের বক্তব্যকে গুরুত্ব না দিয়েও পার পেয়ে যায়। এত দিন মানুষ হৈচৈ করেছে শুল্কমুক্ত দামি গাড়ি আমদানি নিয়ে। গরিব দেশটির কোটি কোটি টাকার বৈদেশিক মুদ্রা ব্যয় করে এমপিদের শুল্কমুক্ত গাড়ি আমদানির সুযোগ করে দেওয়া হয়েছে। সাধারণ মানুষের এতে কী উপকার হয়েছে সেই প্রশ্ন কিন্তু ক্ষমতাসীন কিংবা ক্ষমতার কাছাকাছি কেউই করেনি। যে কারণে ক্ষমতার অপব্যবহার করে তাঁরা একের পর এক অপ্রয়োজনীয় এবং বৈধ ও অবৈধ উপায়ে সুবিধা ভোগ করছেন।
সর্বশেষ সুবিধা হিসেবে উল্লেখ করা যায় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে শিক্ষার্থী ভর্তির জন্য এমপিদের জন্য ২ শতাংশ কোটা নির্ধারণের প্রস্তাবটি। এই প্রস্তাব সংসদীয় স্থায়ী কমিটির মাধ্যমে মন্ত্রণালয়ে চলে গেছে, যা শিগগির কার্যকর হতে যাচ্ছে বলে সংবাদ প্রকাশ হয়েছে। তাই পরিপত্রটি জারি হওয়ার বিষয়টি এখন সময়ের ব্যাপার মাত্র। এদিকে প্রস্তাবটি পরিপত্র আকারে প্রকাশের আগেই রাজধানীর বড় বড় স্কুলগুলোতে এমপি মহোদয়রা একের পর এক ভর্তির সুপারিশ করতে শুরু করেছেন। এই সুপারিশ অবশ্য আগেও করা হতো। তখন হয়তো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের প্রধানরা তা আমলে না এনেও নিজেদের কাজ করে নিতে পারতেন। সেই ক্ষমতার প্রয়োগ রাজধানীর বড় স্কুলগুলোর প্রধানরা করতেন বলেই মানুষের বিশ্বাস। সে জন্য যেসব শিশু ভর্তি পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হতে পারত না, তাদের মধ্যে তেমন ক্ষোভ থাকত না। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের প্রধানদের এই ক্ষমতাকে খর্ব করার জন্যই এবার এমপিরা এটি পরিপত্র আকারে প্রকাশ করিয়ে নিতে যাচ্ছেন, যাতে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো এমপিদের সুপারিশ রাখতে বাধ্য হয়।
এমপিদের যদি এ কোটা দেওয়া হয়, তাহলে এটি প্রতিষ্ঠিত হবে যে শিক্ষাগত যোগ্যতার জন্য এমপির ছেলেমেয়ে হওয়াও একটি মাপকাঠি। এই যোগ্যতা বিচারে যদি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানকে শিক্ষার্থী ভর্তি করতে হয়, তাহলে শিক্ষার মান কোন পর্যায়ে নেমে যাবে এবং সমাজে তার প্রভাব কী হতে পারে, তা এখনই চিন্তা করা উচিত।
এরই মধ্যে রাজধানীর প্রতিষ্ঠিত বিভিন্ন স্কুলে তাঁদের সুপারিশ এমনভাবে শুরু হয়েছে, যা রীতিমতো ভীতিকর বলে জানা গেছে। একটি স্কুলে যদি ২০০ শিক্ষার্থী ভর্তি করা হয়, তাহলে পাঁচজন এমপি ২ শতাংশ করে ভর্তির সুপারিশ করলে ২০টি আসন ছেড়ে দিতে হবে এমপিদের জন্য। আর এ ২০টি আসন চলে যাবে মেধাবী শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে। আরো ৪৪ জন যাবে অন্যান্য কোটায়। তাহলে সেখানে মোট আসন চলে যাবে ৬৪টি। সংগত কারণেই স্পষ্ট হয়ে ওঠে, ২০০টি আসনের মধ্যে আমজনতার সন্তানরা পাবে মাত্র ১৩৬টি। স্পষ্টত বলতে হবে, এ ৬৪টি আসন যাচ্ছে শিক্ষাগত যোগ্যতার পরিবর্তে কোটা প্রথায়। আরো সোজা কথায়, অযোগ্যরা এ সুযোগটি লাভ করবে যোগ্যদের খেদানোর মাধ্যমে।
এমপির ছেলেমেয়েদের টেন্ডার ব্যবসায়ীর কাতারে ফেলার জন্য রাষ্ট্র যদি আইনানুগ সুবিধা তৈরি করে, তাকে জনস্বার্থবিরোধী বললেও কম বলা হবে। এর বিরুদ্ধে জনপ্রতিরোধ তৈরি হবে_এমন সম্ভাবনাও নেই। কারণ, জনগণের ক্ষমতা পাঁচ বছরে একবার আসার কথা। সেখানে এ ক্ষমতা প্রয়োগ করতে গিয়ে সুবিধাভোগী এমপিকে যদি প্রত্যাখ্যানও করে, তাহলেও তাঁদের কোনো ক্ষতি হবে না। কারণ, ইতিমধ্যে তিনি সুবিধা পেয়ে গেছেন। তাঁর বিএমডাবি্লউতে চড়ে সন্তানকে স্কুল থেকে বাড়ি পেঁৗছাতে আর কোনো অসুবিধা হবে না। কিন্তু যে শিশুটির নিজ মেধাগুণে ভর্তি হওয়ার সুযোগ পাওয়ার কথা থাকার পরও ভর্তি হতে পারেনি, তার জীবন ঠিকই ভিন্নদিকে মোড় নেবে।
শিক্ষা খাতকে সুষ্ঠুভাবে পরিচালিত করতে হলে কোটা প্রথাকে ভেঙে সাজানো প্রয়োজন। এখন যেমন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের কর্মচারী, শিক্ষকদের পোষ্যদের জন্য কোটা আছে, মন্ত্রণালয়ের কর্মচারী-কর্মকর্তাদের জন্য কোটা আছে_সেগুলো সম্পূর্ণ বাতিল করতে হবে। শুধু প্রতিবন্ধী, উপজাতীয় ও মুক্তিযোদ্ধাদের সন্তানদের জন্য ভর্তির সুবিধা রেখে বাকি সব কোটা বন্ধ করে দিয়ে শিক্ষার সুযোগকে প্রতিযোগিতামূলক করা হোক। মুক্তিযোদ্ধাদের সন্তানদের মধ্যে খুব কমসংখ্যকেরই এখনো স্কুলে ভর্তির বয়স আছে। ফলে এ কোটা থাকলেও তা কার্যকর হতো খুবই কম। এর পরও মুক্তিযোদ্ধাদের প্রতি সম্মান জানানোর জন্য এই কোটা আরো কয়েক বছর রেখে দেওয়ার যুক্তি রয়েছে। প্রতিবন্ধীদের জন্য কোটা থাকলেও স্কুলগুলোতে প্রতিবন্ধী শিক্ষার্থীর সংখ্যা খুবই কম হওয়ার কারণে তার প্রভাবও মেধাবীদের ওপর পড়বে কম।
এমপিদের জন্য কোটা নির্ধারণের পক্ষে যে যুক্তি দেখানো হয়েছে, তা মোটেও সংগত নয়। বলা হয়েছে, এমপিদের কাছে স্কুলে ভর্তি করানোর উদ্দেশ্যে প্রতিবছরই অনেকে সুপারিশের জন্য যায়, সে জন্য তাঁদের কোটা নির্ধারণ করে দিতে হবে। অযোগ্য কোনো শিক্ষার্থীকে এমপির সুপারিশের যোগ্য বানিয়ে দেওয়ার বিধানকে কোনোভাবেই মেনে নেওয়া যায় না। এমপির কাজ নিশ্চয়ই অযোগ্যকে যোগ্যতার সার্টিফিকেট দেওয়া নয়। আর সেই অকাজটিকেই তিনি কেন আইনানুগ ভিত্তির ওপর প্রতিষ্ঠিত করতে চাইছেন, সেটাই এ মুহূর্তে প্রশ্ন।
সংসদীয় স্থায়ী কমিটিতে কিভাবে এ ধরনের প্রস্তাব পাস হয়, তাও ভেবে দেখা দরকার। তাঁদের যুক্তি, কর্মচারীদের কোটা থাকলে এমপিদের কেন থাকবে না। পাল্টা বলা যায়, এমপিদের ও কর্মচারীদের কারোরই কোটা রাখার প্রয়োজন নেই। কোটা হোক যোগ্যদের জন্য। যোগ্যতার ভিত্তিতেই ভর্তির সুযোগ দিতে হবে। সুপারিশে নয়।
mhussain_71@yahoo.com

No comments

Powered by Blogger.