জলপীড়িত জীবনের অভিসম্পাত by সোহেল নওরোজ

পিচঢালা মসৃণ সড়কের ওপর প্রবহমান উতলা নদী! কোথাও হাঁটু আবার কোথাও কোমরপানি, জোরালো স্রোত। দীর্ঘদিনের অযত্ন-অবহেলায় পুষে রাখা ক্ষোভ যেন ভাসিয়ে দিয়েছে নদীসংলগ্ন জনপদ। জলের সঙ্গে যুদ্ধ করে জলপীড়িত মানুষের দুঃসহ দিনাতিপাত। এর মধ্যেই নিরুপায় মানুষের গন্তব্যে যাওয়া-আসা। প্রয়োজনের তাগিদ বলে কথা! বাস-মোটর থামিয়ে যাত্রী নামিয়ে দিচ্ছে। কাপড় গুটিয়ে চটি-জুতা হাতে কেউ হেঁটেই নদী পার হচ্ছে।


দিনের বেলা ভ্যানে করে যাত্রী, প্রয়োজনীয় পণ্য, গরু-ছাগল ও মোটরযান পার করছে মানুষ। জলমগ্ন রাস্তায় ঝাঁকি জাল, পোলো, বানা কিংবা বড়শি নিয়ে অনেকেই মাছ শিকারে ব্যস্ত। এটাই এখন দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের জেলা খুলনা ও সাতক্ষীরার বেশ কিছু উপজেলার চিত্র। টানা বৃষ্টিতে কপোতাক্ষ, বেতনা ও শালিখাসহ কয়েকটি নদ-নদীর উপচেপড়া পানিতে তালা উপজেলার অধিকাংশ এলাকা ও সাতক্ষীরা শহরের একাংশ তলিয়ে গেছে। এতে সাতক্ষীরা-খুলনা মহাসড়কের বেনেরপোতা, মির্জাপুর ও আঠারমাইল এলাকার প্রায় আট কিলোমিটার সড়ক পানিতে তলিয়ে রয়েছে দুই মাসেরও অধিক সময় ধরে। গত দুই মাসেও সাতক্ষীরার সঙ্গে খুলনার সরাসরি যোগাযোগ স্থাপিত হয়নি। বন্ধ রয়েছে খুলনার কয়রা ও পাইকগাছা উপজেলার সঙ্গে সারা দেশের সড়ক যোগাযোগ। অভ্যন্তরীণ যোগাযোগও ভেঙে পড়েছে।
দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের মানুষের জলপীড়ার বাস্তব ও করুণ চিত্র খুব কাছ থেকে প্রত্যক্ষ করে বুঝেছি, সীমাহীন দুর্যোগে জনজীবন ওষ্ঠাগত। জলক্লিষ্ট মানুষদের কাছে না মরে বেঁচে থাকাটাই মুখ্য, জীবনের আসল রূপ। ঘর থেকে পা বাড়ালেই পানি। স্কুলমাঠ হাঁটুপানির নিচে। নিকটস্থ জল-নিরাপদ স্কুল ও মাদ্রাসাগুলোকে আশ্রয়কেন্দ্র বানানো হয়েছে। কেবল শিক্ষা প্রতিষ্ঠান নয়, খুলনা-সাতক্ষীরা সড়কের খোলা আকাশের নিচে রাস্তার ওপর আশ্রয় নিয়েছে বহু মানুষ। কবে তারা বাড়ি ফিরবে_ কেউ বলতে পারে না। যেখানে নারী-পুরুষ-শিশুদের সঙ্গে আশ্রয় নিয়েছে গৃহস্থ পশু-পাখি। প্রয়োজনীয় সহযোগিতার অভাবে এদের দিন কাটছে অনাহারে-অর্ধাহারে। বেঁচে থাকার একমাত্র উপায় সরকারি-বেসরকারি সাহায্য প্রয়োজনের তুলনায় অপ্রতুল। ঘা-পাচড়াসহ নানা ধরনের পানিবাহিত রোগে আক্রান্ত হচ্ছে শিশুরা।
জলাবদ্ধতা সমস্যা দীর্ঘস্থায়ী হওয়ার জন্য স্থানীয়রা চিংড়ি ঘের মালিক, পানি উন্নয়ন বোর্ডের গাফিলতি ও দুর্নীতি, এডিবির অকার্যকর পরামর্শ, অসৎ রাজনীতিক ও ঠিকাদারদের দায়ী করছেন। ড্রেজিং কাজে ধারাবাহিকতার অভাব, পানি উন্নয়ন বোর্ডের অপতৎপরতায় পাটকেলঘাটা ব্রিজ পর্যন্ত কপোতাক্ষ খাত পুরোপুরি বন্ধ হয়ে গেছে। জলাবদ্ধতা ক্রমশ ভাটিতে সম্প্রসারিত হচ্ছে। যত দক্ষিণের নদী, খাল পলি জমে ভরাট হচ্ছে, জলাবদ্ধতাও সমান্তরালে ভাটি এলাকায় প্রসারিত হচ্ছে। পানিসম্পদ মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা যায়, ২৪০ কিলোমিটার দৈর্ঘ্যের কপোতাক্ষ নদ যশোর, খুলনা ও সাতক্ষীরার মধ্য দিয়ে প্রবাহিত, যার ক্যাচমেন্ট এরিয়া ১ দশমিক ২ লাখ হেক্টর। এ নদের অববাহিকায় জলাবদ্ধতা ও পলি ভরাট অনেক পুরনো সমস্যা, বর্তমানে যেটি প্রধান সমস্যা হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে। জলাবদ্ধতা এ এলাকার কৃষি উৎপাদন, মৎস্য চাষ, প্রাণিসম্পদ ও জীববৈচিত্র্য, কর্মসংস্থানের সুযোগ তথা জনগণের সার্বিক আয়ের ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলেছে। নাব্যহারা নদ-নদী দিয়ে পানি নিষ্কাশন না হওয়ায় স্থায়ী জলাবদ্ধতায় চলতি মৌসুমে আমন চাষের লক্ষ্যমাত্রা অর্জিত হবে না।
যে কোনো ধরনের অবহেলা-অদূরদর্শিতা আমাদের আরও বিপর্যয়ের মধ্যে ঠেলে দেয়। জনপদ ও জনজীবনে বয়ে আনে সীমাহীন দুর্ভোগ। তাই যথাযথ ও সামগ্রিক পরিকল্পনা এবং সমন্বি্বত উদ্যোগের মাধ্যমে আক্রান্ত এলাকার মানুষের জলাবদ্ধতা থেকে মুক্তি এবং আর্থ-সামাজিক উত্তরণের পথ খুঁজতে হবে। অগ্রাধিকারের ভিত্তিতে কপোতাক্ষ নদ সংস্কার করে দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের জলাবদ্ধতা সমস্যার সমাধান করা জরুরি।

No comments

Powered by Blogger.