মাদক-নেশার রাজ্যে সিসা সেবন by অরূপ রতন চৌধুরী


সুপ্রাচীনকাল থেকে নেশা মানুষকে তাড়া করে বেড়াচ্ছে। সকালে নাশতার টেবিলে, সারা দিন কাজের ফাঁকে কিংবা বিকেলের কর্মক্লান্ত সময়ে একজন ধূমপায়ী একটা সিগারেট ধরান। বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই নিতান্ত অভ্যাসের বশে। সিগারেটের নেশা যেন অনেকটা অবিচ্ছেদ্যভাবে মিশে আছে অনেকের জীবনযাত্রায়। কিন্তু বিজ্ঞানাগারে যন্ত্রপাতি যা দেখতে পায়, তা একজন ধূমপায়ীর চোখ যদি দেখতে পেত সাম্প্রতিক আবিষ্কৃত সিগারেটের আরও কিছু ক্ষতিকর


প্রভাব, তবে সে সত্যিই চমকে উঠত। চেরনোবিলের পারমাণবিক দুর্ঘটনার কথা আমরা শুনেছি। ভয়াবহ এই দুর্ঘটার প্রত্যক্ষ এবং পরোক্ষ ফলাফল আমরা জানি। সম্প্রতি বিজ্ঞানীরা দেখেছেন, সিগারেট ছেড়ে দেওয়ার পাঁচ বছর পরও ধূমপায়ীদের দেহের তেজস্ক্রিয় বিকিরণকারী তপ্ত কেন্দ্র রয়েছে পূর্ণমাত্রায়। কিন্তু আজকের প্রসঙ্গ সেই সিগারেট ধূমপান নয়, অন্য কিছু।
বর্তমান নেশার জগতের আলোড়ন সৃষ্টিকারী ইয়াবা, হেরোইন ও ফেনসিডিলের সঙ্গে যুক্ত হয়েছে নতুন আরেকটি মাদকের নেশা, নাম তার ‘সিসা’। সিসা কি মাদকদ্রব্য? তরুণ ছেলেমেয়েদের একটি বিরাট অংশ আজ এই সিসায় অভ্যস্ত হয়ে উঠেছে কেন? আরব বিশ্বের অধিকাংশ দেশে এটি অনেক আগে থেকেই জনপ্রিয়। সম্প্রতি আমি বিশ্ব ডায়াবেটিস কংগ্রেসে একটি প্রবন্ধ উপস্থাপন করতে যাই দুবাই শহরে। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশ থেকে প্রায় ১৪ হাজার প্রতিনিধি চার দিনব্যাপী এই কংগ্রেসে যোগদান করেন। তবে দিনব্যাপী শুধু সেমিনার, প্রদর্শনী আর পোস্টারে বৈজ্ঞানিক আলোচনা হয়।
চার দিনের মধ্যে একটি রাত ছিল ‘সাফারি নাইট’। তাই উৎসাহী হয়ে যাওয়ার জন্য প্রস্তুতি নিলাম। তৃতীয় দিন সন্ধ্যায় সবাইকে জিপ গাড়িতে করে বালুর মধ্য দিয়ে প্রায় এক ঘণ্টা ঘুরিয়ে নামাল আরেকটি বালুময় মরুভূমিতে, যেখানে আগমনের সঙ্গে সঙ্গে সেই আরবি কায়দা চা পরিবেশন করা হলো। তারপর নৈশভোজের মেনুতে বিভিন্ন মাংসের রান্না আর ভাত, রুটি পরিবেশন করা হলো—সবকিছুই ছিল বালুর ওপরে।
তারপর শুরু হলো আরবি নৃত্য—সবাই মাতোয়ারা, এভাবে চলল প্রায় দুই ঘণ্টা। কিন্তু সব শেষ আয়োজনটা আমাকে অবাক করল। দেখলাম, সারি সারি সোফার মতো করে গদি আর কোলবালিশ, আর সঙ্গে একটি করে হুক্কা সাজানো আছে। যেখানে বসে সবাই সেই বর্তমান সময়ের আলোচিত সিসাতে ধূমপান শুরু করেছে। ভাবলাম, তারা তো তাদের ঐতিহ্য দেখাতেই নিয়ে এসেছে, সুতরাং এটা বিচিত্র কিছু নয়।
সিসা গ্রহণের উন্মত্ততা সেদিন প্রথম আমি অবলোকন করলাম। তবে ব্যতিক্রম যে বিষয়টা আমি দেখলাম, সেটা হচ্ছে এই সিসা গ্রহণের ক্ষেত্রে পুরুষদের চেয়ে নারীরাই বেশি আসক্ত। বাংলাদেশের যেসব অভিজাত এলাকার রেস্তোরাঁতে এখন সিসা গ্রহণ চলছে, তাতেও কিন্তু একই দৃশ্য দেখা যায়। এখানেও ছেলেদের সঙ্গে মেয়েরাও সমানতালে সিসা ধূমপান করে যাচ্ছে।
বিজ্ঞানীদের মতে, এই সিসা এক ধরনের মাদকদ্রব্য। মাদক গ্রহণকারীদের কাছে সম্প্রতি এই সিসা অত্যন্ত জনপ্রিয় হয়ে যাচ্ছে। সম্প্রতি যুক্তরাজ্যের স্বাস্থ্য বিভাগ ও মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ কেন্দ্রের এক গবেষণায় জানা যায়, একবার সিসা সেবনে একটি সিগারেটের চেয়ে চার থেকে পাঁচ গুণ বেশি কার্বন মনো-অক্সাইড গ্রহণ হয়ে থাকে এবং এই উচ্চমাত্রার কার্বন মনোক্সাইড গ্রহণের ফলে মস্তিষ্কের ক্ষতি অনেক বেশি হতে পারে, সেই সঙ্গে ওই ব্যক্তি যে কোনো সময় অচেতন হয়ে পড়তে পারেন। এই সিসা গ্রহণ করা হয়ে থাকে হুক্কার নলের মতো একটি পানির পাইপ দিয়ে। বলা হয়, ফলের সুগন্ধযুক্ত তামাককে কয়লা দিয়ে পোড়ানো হয়, যেটা থেকে ধোঁয়া বের হয়ে থাকে। নাক, মুখ দিয়ে ধোঁয়া বের করার জন্য নলের নিচে পানির মাধ্যমে ধোঁয়া টানতে হয়। এই ধোঁয়া মুখের ভেতর থেকে মাথার ব্রেনে এবং রক্তের মাধ্যমেও শরীরে বিভিন্ন জায়গায় যেতে পারে। তবে রক্তের মাধ্যমে সবচেয়ে বেশি যে রাসায়নিক পদার্থটি আমাদের সিসা গ্রহণকারী তরুণ যুবসমাজকে ক্ষতিগ্রস্ত, রোগাক্রান্ত ও পঙ্গু করে দিতে পারে তা হচ্ছে কার্বন মনোক্সাইড (বিষাক্ত পদার্থ)।
গবেষণায় দেখা যায়, সিসা গ্রহণকারী প্রতি সেশনে ৪০ থেকে ৭০ পিপিএম (পার্টস পার মিলিয়ন) কার্বন মনোক্সাইড শ্বাস-প্রশ্বাসের সঙ্গে টেনে নেয়, তবে মারাত্মক ব্যাপারটি হলো এই ৪০-৭০ পিপিএম কার্বন মনোক্সাইডের প্রায় ৮ থেকে ১২ ভাগই রক্তের সঙ্গে মিশে যায়। গবেষণার এই ফলাফল আমাদের আতঙ্কিত করে। এসব গবেষণা থেকে সহজেই অনুমান করা, সিসা গ্রহণ কখনোই নিরাপদ নয় বরং স্বাস্থ্যের জন্য একটি মারাত্মক হুমকি।
ইদানীং অনেকে এই সিসা গ্রহণকে জীবনের একটা স্বাভাবিক ফুর্তি হিসেবে নিচ্ছে, কখনোই এটাকে ক্ষতিকর বলে ভাবছে না। তাই অনেক পার্টি বা নাইট ক্লাবেও এর জনপ্রিয়তা দিন দিন বাড়ছে। বেশির ভাগ সিসা গ্রহণকারী মনে করে, এটা সিগারেট, গাঁজা অথবা মাদকের মতো ক্ষতিকর নয়। অন্যদিকে বিজ্ঞানীরা বলছেন, সিগারেটের চেয়ে সিসা গ্রহণকারীদের ক্ষতি ৪০০-৫০০ গুণ বেশি। সিসা গ্রহণকারীদের যে শুধু এর রাসায়নিক পদার্থগুলোই ক্ষতিগ্রস্ত করবে তা নয়, এই হুক্কার প্রতিটি নলের ব্যবহার যারা করছে অর্থাৎ একটি নল দিয়ে সবাই যেভাবে এক জায়গায় বসে একের পর এক টানছে তাতে নলের জীবাণুগুলোও ব্যক্তি থেকে ব্যক্তিদের মধ্যে ছড়াচ্ছে। ফলে এই তরুণ যুবসমাজের মধ্যে মারাত্মক ব্যাধি যক্ষ্মাসহ অন্যান্য সংক্রামক রোগ খুব দ্রুত ছড়িয়ে পড়তে পারে, সেটাও এখন দুঃশ্চিন্তার বিষয়।
মনে রাখতে হবে, আসক্তি ও পরিবার দুটোই অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িত। মাদকাসক্ত ব্যক্তির আসক্তিজনিত অস্বাভাবিক আচার-ব্যবহারের প্রভাবে পরিবারের সদস্যরা মানসিকভাবে বিপর্যস্তও অসুস্থ হয়ে পড়তে পারেন। এর ফলে নেশা গ্রহণ না করেও আসক্ত ব্যক্তির পাশাপাশি তার পরিবারের সদস্যদের মধ্যেও আসক্ত ব্যক্তির ন্যায় আচরণগত অসংগতি দেখা দিতে পারে। একে বিশেষজ্ঞরা কো-এডিকেশন বলে চিহ্নিত করেছেন। কখনো এই বিপর্যয় এতটা নাজুক অবস্থা ধারণ করে যে আসক্ত ব্যক্তির চিকিৎসার পূর্বে বা তার পাশাপাশি ক্ষতিগ্রস্ত সদস্যদের নিরাময় প্রয়োজন হয়ে পড়ে।
তাই এখন সময় এসেছে প্রশ্ন করার—‘সিসা’ গ্রহণকে আমরা কি উৎসাহিত করব? নাকি প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেব?
অধ্যাপক ড. অরূপ রতন চৌধুরী: সদস্য, জাতীয় মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ বোর্ড সভাপতি, মানস।
prof.arupratanchoudhury@yahoo.com

No comments

Powered by Blogger.