ভিক্ষুক এক মুক্তিযোদ্ধা by মনিরুল ইসলাম মনির

কাত্তরের মহান মুক্তিযুদ্ধে জীবনবাজি রেখে অংশগ্রহণ করেছিলেন আবেদ আলী (৭৫)। স্বপ্ন ছিল— একটি স্বাধীন মানচিত্র ও স্বাধীন পতাকা অর্জন। দেশ স্বাধীন হলো। পতাকাও পেলেন লাল সবুজের। কিন্তু এই বীরমুক্তিযোদ্ধার যুদ্ধ যেন শেষ হলো না। তাই জীবনযুদ্ধের জন্য তিনি এখন বেছে নিয়েছেন ভিক্ষাবৃত্তি।

ভাগ্যাহত এ মুক্তিযোদ্ধা থাকেন নালিতাবাড়ী উপজেলার পোড়াগাঁও ইউনিয়নের আন্ধারুপাড়া গ্রামে। ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধে আবেদ আলী ১১নং সেক্টরে আবদুল গফুর কোম্পানিতে যুদ্ধ করেছেন। তার মুক্তিযোদ্ধা সনদ নং ম-৪৭৩৭৬। বর্তমানে তার সংসারে স্ত্রী, পুত্রবধূ, ৩ নাতি-নাতনিসহ ৬ সদস্য রয়েছে। ৪ বছর আগে ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যু হয়েছে একমাত্র ছেলে আবদুুর রহমানের। সেই ছেলের চিকিত্সা করতে গিয়েই নিজের শেষ সম্বল বাড়িভিটাটুকুও বিক্রি করেছেন তিনি। নিজেও ২ বছর ধরে প্যারালাইসিসের রোগী। ঠিকমতো হাঁটতে পারেন না। ফলে স্ত্রী, পুত্রবধূ, নাতি-নাতনিসহ খেয়ে না খেয়ে অতিকষ্টে জীবনের ঘানি টানছেন তিনি। স্বাধীনতার ৪০ বছরে এসেও জীবনযুদ্ধ শেষ হলো না হতভাগা এ মুক্তিযোদ্ধার। বাধ্য হয়েই জীবনের শেষ প্রান্তে এসে তিনি জীবন বাঁচানোর তাগিদে একহাতে লাঠি ভর করে ভিক্ষাবৃত্তি করতে ঘুরে বেড়ান গ্রাম আর হাট-বাজারে।

মানুষের দ্বারে দ্বারে ঘুরে ধান-চাল, টাকা পয়সা সংগ্রহ করেন তিনি। আর তাই নিজেকে মুক্তিযোদ্ধা বলে পরিচয় দিতেও সংকোচ বোধ করেন আবেদ আলী। বিষয়টি তার কাছে যেমনি লজ্জার তেমনি ভয়েরও। কারণ, মুক্তিযোদ্ধা বলে কেউ ভিক্ষা দিতে চাইবে না হয়তো। যুদ্ধের সময় অন্যের অনিষ্ট থেকে বিরত থাকার শপথ বুকে ধারণ করে আজও তিনি পথ চলেন। তাই অক্ষম এই মুক্তিযোদ্ধা সকাল হলেই সৃষ্টিকর্তার মুখপানে তাকিয়ে বেরিয়ে পড়েন মানুষের দুয়ারে। সারাদিন ভিক্ষাবৃত্তি করে ২-৩ কেজি চাল আর ধানের মৌসুমে ৫-১০ কেজি ধান পান। আর মুক্তিযোদ্ধা ভাতা পান ২ হাজার টাকা প্রতিমাস। তাও আবার ৩ মাস পর পর। ভিজিএফ-এর সাহায্যও তার ভাগ্যে জোটে না। তাই ভিক্ষাবৃত্তি আর মুক্তিযোদ্ধা ভাতা দিয়েই বর্তমান দুর্মূল্যের বাজারে ৬ সদস্যের সংসারের ঘানি টানছেন তিনি। নিজের বসতবাড়ি না থাকায় সদ্যনির্মিত নাকুগাঁও গুচ্ছগ্রাম আশ্রয়ণ কেন্দ্রে একটি ঘর চেয়েছিলেন। কিন্তু এই অভাগার কপালে তাও জোটেনি। ফলে এখন ঠাঁই নিয়েছেন অন্যের বাড়িতে। আন্ধারুপাড়া গ্রামের মৃত সাহেব উল্লাহ মণ্ডলের বাড়িতে স্থানীয় ভাষায় ওয়ালা (অন্যের বাড়িতে) থাকেন। দুঃখভরা কণ্ঠে আবেদ আলী বলেন, দেশ স্বাধীন কইরা কী পাইলাম?
উপজেলা মুক্তিযোদ্ধা কমান্ড কাউন্সিলের কমান্ডার শাহাব উদ্দিন জানান, আবেদ আলী একজন প্রকৃত ভিক্ষুক। মুক্তিযোদ্ধা ভাতা ব্যতীত তিনি আর কিছুই পান না। ফলে ভিক্ষা করে তিনি সংসার চালান। নাকুগাঁও গুচ্ছগ্রামে তার নামে একটি ঘর বরাদ্দের জন্য আমি তালিকা দিয়েছিলাম। কিন্তু উপজেলা প্রশাসন ওই তালিকা থেকে তাকে বাদ দিয়েছে।

No comments

Powered by Blogger.