বন্ধুত্বের পথ বন্ধুর by রউফুল আলম

বাংলাদেশের মানুষ প্রাচীনকাল থেকেই অতিথিপরায়ণ। এ দেশের মানুষ অন্যকে খুব সহজে বিশ্বাস করে, কাছে টানে এবং আপন করে নেয়। কিন্তু দুর্ভাগ্য যে, অতিথিরা আখেরে আমাদের থালা, বাসন, পিঁড়ি সবই বল প্রয়োগে কেড়ে নিতে চেয়েছে। আমাদের আঘাত করেছে, শরীর থেকে রক্ত ঝরিয়েছে স্রোতরূপ। পর্তুগিজ, ওলন্দাজ, ফরাসি, ব্রিটিশ ও পাকিস্তানি সবাই আতিথ্য গ্রহণ করেছে, আর শেষে তারা এ দেশের মাটি ও মানুষের ওপর হিংস্র থাবা দিয়েছে এবং


তাদের তাড়াতে এ জাতিকে রক্ত দিতে হয়েছে; হারাতে হয়েছে অসংখ্য মানুষ। প্রতিবেশী দেশ ভারতের সঙ্গে আমরা সুসম্পর্ক বজায় রাখার চেষ্টা করছি বহু আগে থেকেই। বাংলাদেশের ভাষা ও সংস্কৃতির সঙ্গে ভারতের একটি বৃহৎ জনগোষ্ঠীর অভিন্ন সম্পর্ক রয়েছে এবং সেই নিবিড় সম্পর্কের সূত্রে এপার-ওপারের সেতুবন্ধ বহু বছরের। বাংলাদেশের মহান মুক্তিযুদ্ধে ভারতের সহযোগিতাকে বাংলাদেশ সবসময় কৃতজ্ঞতার সঙ্গে স্মরণ করেছে এবং করছে। স্বাধীনতা-উত্তর দু'দেশের বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ককে সুদৃঢ় করার মধ্য দিয়ে দক্ষিণ এশিয়ার রাজনীতিতে আঞ্চলিক সহযোগিতা বৃদ্ধির জন্য সব চেষ্টাই বাংলাদেশ আন্তরিকভাবে করে যাচ্ছে। কিন্তু সবসময় সেই বন্ধুত্বের পথ মসৃণ ছিল না। ফারাক্কা বাঁধ, গঙ্গার পানি বণ্টন, করিডোর ও ছিটমহল, দক্ষিণ তালপট্টি দ্বীপ, সীমান্তে হত্যা, কাঁটাতারের বেড়া, তিস্তার পানি বণ্টন প্রভৃতি বিষয় নিষ্পত্তিতে ভারতের উদাসীনতা এ দেশের মানুষের মধ্যে হতাশার জন্ম দিয়েছে।
আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন মহাজোট সরকার বিপুল সমর্থন নিয়ে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় আসার পর দু'দেশের সম্পর্ক জোরদারের মাধ্যমে দীর্ঘদিনের অমীমাংসিত বিষয়গুলোর সমাধান হবে বলেই আশা করেছিল এ দেশের মানুষ। সম্পর্ক উন্নয়নে বাংলাদেশের পক্ষ থেকে উদ্যোগ ও চেষ্টা ছিল আন্তরিক। গত বছর ও এ বছর দু'দেশের শীর্ষ পর্যায়ের বৈঠক অনুষ্ঠিত হলো যথাক্রমে দিলি্ল এবং ঢাকায়। ভারতের মূল লক্ষ্য ট্রানজিট অনুমোদন, যা ভারতের আসাম, ত্রিপুরা ও মণিপুর অঞ্চলের অর্থনৈতিকে শক্তিশালী করবে। বাংলাদেশের মূল চাওয়া ছিল তিস্তার পানির ন্যায্য হিস্যা ও বাণিজ্য ঘাটতি হ্রাসের লক্ষ্যে বাংলাদেশি পণ্যের শুল্কমুক্ত প্রবেশের অনুমোদন। তিস্তা অভিন্ন নদী, আন্তর্জাতিক নদী; এর অববাহিকায় দুটি স্বাধীন দেশ আছে। তাই পানি আমাদের অধিকার। কিন্তু দুর্ভাগ্য যে, আমাদের পানির জন্য ভারতের মুখাপেক্ষী হয়ে থাকতে হচ্ছে। পানি বণ্টন চুক্তি স্বাক্ষরে ভারত এখনও বিভিন্ন অজুহাত দিচ্ছে। ভারত ঐতিহাসিকভাবেই যৌথ নদীগুলোর ওপর প্রভাব বিস্তার করছে। পদ্মার উজানে ফারাক্কা বাঁধের কারণে ভাটির বরেন্দ্র অঞ্চলের অনেক নদ-নদী শুকিয়ে গেছে। সে অঞ্চলের কৃষি উৎপাদনে ব্যাপক ক্ষতিকর প্রভাব পড়েছে। তিস্তা নদীর উজানে বাঁধ করা হয়েছিল বাংলাদেশের সঙ্গে আলোচনা না করেই। ফেনী নদীর পানি বণ্টন নিয়ে সুরাহা হয়নি এখনও। এরই মধ্যে গত ২২ অক্টোবর ভারতের বিদ্যুৎমন্ত্রী ও মণিপুরের মুখ্যমন্ত্রীর উপস্থিতিতে বরাক নদীর ওপর টিপাইমুখে বাঁধ ও বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণের লক্ষ্যে চুক্তি স্বাক্ষরের খবর প্রকাশিত হওয়ায় বাংলাদেশের মানুষ উদ্বিগ্ন হয়ে পড়ে। মনমোহন সিং তার বাংলাদেশ সফরেও টিপাইমুখে একতরফা বাঁধ তৈরির উদ্যোগ গৃহীত হবে না বলেই প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন। কিন্তু আমাদের সঙ্গে কেউ কথা রাখে না!
অর্থনীতিবিদ বিনায়ক সেন সম্প্রতি তার এক নিবন্ধে ভারতের ভৌগোলিক ও মানসিক কাঁটাতারের কথা উল্লেখ করেছেন। কাঁটাতার উপড়ে না ফেললে ভারতের উদারতা নিয়ে আমাদের মনে সংশয় থেকেই যাচ্ছে। বন্ধুত্বের অন্তরালে ভারত যেন তার আগ্রাসনের মূর্তিকেই প্রকাশ না করে। তাহলে বন্ধুত্বের পথ হবে বন্ধুর আর দক্ষিণ এশীয় শান্তি প্রতিষ্ঠার স্বপ্ন হবে দুঃস্বপ্ন।
য় স্টকহোম বিশ্ববিদ্যালয়ে জৈবরসায়নে গবেষণারত
redoxrouf@yahoo.com

No comments

Powered by Blogger.