মুক্তিযোদ্ধা আ. ওয়াদুদ আমাদের ক্ষমা করবেন by শামীম মমতাজ

৭ ডিসেম্বর ২০১১ 'কালের কণ্ঠের' শেষের পাতায় জনাব নাসরুল আনোয়ারের লেখা 'বিজয়ের দিনে মুক্তিযোদ্ধার অন্য মুক্তির যুদ্ধ' খবরটিতে ৬৮ বছরের মুক্তিযোদ্ধা আবদুল ওয়াদুদের এক অমানবিক ঘটনা আমাকে খুব বেশি বিচলিত, হতবাক, হতাশাগ্রস্ত করে তুলেছে। কী ভয়ংকর ঘটনা! কত বড় সাংঘাতিক ব্যাপার। ভীষণ লজ্জিত হয়ে পড়ি। সাংবাদিক লিখেছেন, 'এক দরিদ্র মুক্তিযোদ্ধার মুক্তির যুদ্ধ' ক্ষুধা, অনশন, দারিদ্র্য থেকে ৬৮ বছরের এক মুক্তিযোদ্ধার


মুক্তির যুদ্ধ। সংক্ষেপে ঘটনাটি হচ্ছে জহুরুল ইসলাম মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন কিশোরগঞ্জ বাজিতপুর পৌরশহরের মধ্য ভাগলপুরের ৬৮ বছরের দরিদ্র এক মুক্তিযোদ্ধা আবদুল ওয়াদুদের চিকিৎসার পুরো টাকা জোগাড় করতে না পারায় হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ 'ছাড়পত্র' দিয়েও তাঁর খাওয়া বন্ধ করে দিয়েছে। এটাই নাকি হাসপাতালের নিয়ম। ফলে গত শুক্রবার বিজয় দিবসের ৪০তম দিনটিতে এই অসহায় মুক্তিযোদ্ধা অর্ধাহারে ও অনাহারে বিজয় দিবস উদ্যাপন করেছেন। এতে সারা দেশবাসীর লজ্জা। খবরটি চোখে পড়ার মুহূর্তে বিজয়ের সব আনন্দ নিঃশেষ হয়ে যায়। আমরা কী জাতি? কত বড় বর্বর, নির্মম, পাষণ্ড অমানুষ!
বিবেকের দংশনে জর্জরিত হয়ে আমার কলম হাতে মনে পড়ে যায় এক অন্য রকম ঘটনার কথা। সময়টি ১৯৮৯, স্বামীর সঙ্গে প্যারিস 'এয়ার শো' দেখার আমন্ত্রণে দুজনেই প্যারিসে। সরকারি ভ্রমণে, কাজেই প্রটোকল খুব বেশি। এক বিকেলে ফ্রান্সের বিমানবাহিনী প্রধানের নৈশভোজে আমরা যাচ্ছি। পথে ঘটল এক মজার ঘটনা। প্যারিসের কেন্দ্রবিন্দুর রাস্তাগুলো খুব একটা প্রশস্ত নয়। আমার গাড়িবহরের আগে-পিছে মোটরসাইকেলে মিলিটারি পুলিশ হুইসেল বাজিয়ে রাস্তার একপাশ খালি করার চেষ্টা করছে। হঠাৎ দেখি বেশ কিছু সময় ধরে একটা লাল রঙের গাড়ি পুলিশের শত নিষেধ সত্ত্বেও ধীরগতিতে এগিয়ে যাচ্ছে। আমাদের গাড়িবহরকে জায়গা দিচ্ছে না। উপায়ান্তর না দেখে মিলিটারি পুলিশের মোটরসাইকেল আরো দ্রুতগতিতে এগিয়ে গাড়িটিকে দাঁড় করায়। কয়েক মিনিটের কথাবার্তা, কিন্তু আবার সেই একই গতিতে গাড়িটি এগিয়ে চলল। আমরা উৎসুক মনে দোভাষীকে জিজ্ঞেস করায় উত্তর পেলাম ওই গাড়ির চালক একজন গর্বিত মুক্তিযোদ্ধা, যুদ্ধ করে ফ্রান্সকে স্বাধীন করেছেন। কাজেই তিনিই দেশের সবচেয়ে বড় ভিআইপি, অন্য কেউ তাঁর চেয়ে বড় হতে পারে না, বিদেশি মেহমানও নন।
সেদিন আমরা যেমন একজন মুক্তিযোদ্ধার বীরোচিত সম্মান দেখে অতি মুগ্ধ হয়েছিলাম, আজ জহুরুল ইসলাম মেডিক্যাল কলেজে চিকিৎসারত এক মুক্তিযোদ্ধার অর্ধাহারে-অনাহারে, খাদ্যাভাবে কাতরানো যন্ত্রণায় তেমনি করে হতবাক হয়ে পড়েছি। নিজের বিবেকের কাছে আজ লজ্জিত। প্যারিসেই আরো একটি বিরল ঘটনা না বলে থাকতে পারছি না। শহরের কেন্দ্রবিন্দুতে একটি স্কয়ার আছে নাম �ARC de Triomphe� (আর্ক ডি ট্রাইওম্ফ) প্রতিদিন বিকেলে সেই স্কয়ারের ওপরে দাঁড়িয়ে থাকেন অনেক বীর যোদ্ধা। দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের সেসব সাহসী সৈনিক যাঁরা আজও বেঁচে আছেন। তাঁরা এখন বৃদ্ধ; কিন্তু যখন তাঁরা সামরিক পোশাকে বুকে যুদ্ধ জয়ের মেডেল নিয়ে অতি গর্বভরে দাঁড়িয়ে থাকেন। তখন সারা দেশের নানা বয়সী নারী-পুরুষ শিশু তাঁদের দেখে ফুল উপহার দেন। অনেক সময় বীর সেনারা শিশুদের কাছে তাঁদের বীরত্বের কাহিনী শুনিয়ে থাকেন। প্রতি বিকেলের এই অতি আশ্চর্য অনানুষ্ঠানিক দৃশ্য আমাদের আজও অভিভূত করে তোলে_আমরাও মনেপ্রাণে তাঁদের শ্রদ্ধা ও সম্মান জানাই। আজ ভাবছি, আমরা কত দীন, চেতনা ও বিবেকহীন। দীর্ঘ ৯ মাসের মুক্তিযুদ্ধে বাংলার দামাল ছেলেরা অকাতরে বুকের রক্ত ঢেলে দিয়ে যাঁরা লাল-সবুজ পতাকা ছিনিয়ে এনেছে, তাঁদের আজ কী করুণ পরিণতি। দেশের বীর যোদ্ধারা কি কখনো দরিদ্র? তাঁরা তো এ দেশের সোনার সন্তান। এই সাহসী বীর যোদ্ধা যাঁরা নিজের বুকের রক্তে এ দেশ স্বাধীন করেছেন, আজ ৪০ বছর পরে এ কী দুরবস্থা! কী করুণ চিত্র, কী নিষ্ঠুর ব্যবহার! আমরা লজ্জিত মুক্তিযোদ্ধা আবদুল ওয়াদুদের কাছে_আমরা ক্ষমাপ্রার্থী।

লেখক : কালের কণ্ঠের পাঠক

No comments

Powered by Blogger.