দ্বীপচর : এখনও গেল না আঁধার by মাহবুবুর রহমান ভঁূইয়া

দীবেষ্টিত বাংলাদেশের একটি বড় অংশজুড়ে দখল করে আছে 'চর'। কোনো কোনো চর মূল খণ্ডের সঙ্গে জড়ানো আবার কোনোটা মূল ভূখণ্ড থেকে বিচ্ছিন্ন। যে চরগুলো মূল ভূখণ্ড থেকে বিচ্ছিন্ন তাদের বলা হয় 'দ্বীপচর'। এ রকম অসংখ্য দ্বীপচর বাংলাদেশের পশ্চিম ও উত্তর অংশে রয়েছে। পাবনা, রাজশাহী, চাঁপাইনবাবগঞ্জ, রংপুর, গাইবান্ধা, লালমনিরহাটে এ ধরনের দ্বীপচরের সংখ্যা তুলনামূলক বেশি। এসব দ্বীপচর মূলত দুর্গম এবং যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন।


শীতকালে পা, আর বর্ষাকালে নৌকা ছাড়া তাদের আর বিকল্প গত্যন্তর থাকে না। তবে রাজশাহীর বাঘা চরে যেতে মোটরবাইক ব্যবহার করা হয়। এই ব্যবস্থায় চরবাসী বেকার যুবকদের কিছুটা আয়ের পথ দেখালেও চরের অবহেলিত নারীরা কিন্তু এই সুযোগটা গ্রহণ করতে পারছেন না; যতটা না আর্থিক সঙ্গতির কারণে তার চেয়ে বেশি পুরুষশাসিত দৃষ্টিভঙ্গির কারণে। প্রাকৃতিক দুর্যোগ, জোতদারদের উৎপীড়ন, সম্পদের অপ্রতুলতা, ভূমি মালিকানা না থাকা এবং তীব্র দারিদ্র্যের ভেতরে বসবাসরত মানুষগুলোর সঙ্গে লতার মতো জড়িয়ে আছে দৃষ্টিভঙ্গির দরিদ্রতা। তার মূল কারণ নিরক্ষরতা। ২০০১ সালের আদমশুমারি অনুযায়ী 'উত্তরাঞ্চলের ৫১টি দ্বীপচরের ওপর পরিচালিত গবেষণার ফলাফলে দেখা যায়, চরে সাক্ষরতার হার মাত্র ২৫ শতাংশ, যেখানে নারীরা আরও পেছনে। নারী সাক্ষরতার হার মাত্র ২০ শতাংশ। দ্বীপচরবাসীদের ৭৭ শতাংশই হতদরিদ্র এবং প্রায় ৮৬ শতাংশ দারিদ্র্যসীমার নিচে বসবাস করেন, যা মূল ভূমির দারিদ্র্য হারের তুলনায় অনেক বেশি, প্রায় ৩ গুণ।
এ অনগ্রসরতার পেছনে আরও একটি লক্ষণীয় বিষয় হলো, সরকারিভাবে হতদরিদ্র নির্ণয়ের মাপকাঠি। মূল ভূখণ্ডে অর্থাৎ সমতল ভূমিতে যারা হতদরিদ্র হিসেবে চিহ্নিত এবং স্থানীয় সরকারের সুযোগ-সুবিধা পায় ঠিক একই শ্রেণী বা অনেকাংশে আরও নিচু আয়ের মানুষগুলো চর এলাকায় মধ্যম শ্রেণী হিসেবে চিহ্নিত; এ ক্ষেত্রে হতদরিদ্র নির্ণায়ক এ যন্ত্রটি যতটা না সমতল ভূমির অনুকূলে তার চেয়ে ঢের চরবাসীর প্রতিকূলে। ফলে সমতল ভূমির হতদরিদ্র বলে চিহ্নিত মানুষগুলোর মধ্যে কেউ কেউ দরিদ্রতার উঁচু দেয়াল ডিঙাতে সরকারের সহযোগিতা পেলেও হতদরিদ্র নির্ণায়ক যন্ত্রটির ত্রুটির কারণে চরের প্রায় ৪০ শতাংশ লোক আবার একেই দেয়ালের নিচে চাপা পড়তে দেখা যায়। চর অধ্যুষিত ইউনিয়নগুলোতে সরকারি সুযোগ-সুবিধা চর ও সমতলের জন্য সমান। কিন্তু বাস্তবে হতদরিদ্রের সংখ্যা সমতল ভূমির চেয়ে বিচ্ছিন্ন দ্বীপচরে বহুগুণ বেশি; তারপরও উভয়ের জন্য বরাদ্দ সমান।
চরাঞ্চলের এ দুরবস্থার কথা বিবেচনায় রেখে দারিদ্র্য বিমোচন কৌশলপত্রে (পিআরএসপি) চরাঞ্চলে বসবাসরত দরিদ্র জনগোষ্ঠীর মাঝে নিয়মিত ও জরুরি স্বাস্থ্যসেবা প্রদান, চর এলাকায় নিরাপত্তা বেষ্টনী সম্প্রসারণ, শিক্ষাব্যবস্থার উন্নয়ন, কৃষি উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধি, বন্যাজনিত ঝুঁকি হ্রাস, ভূমি ব্যবহার নীতিমালা, ভূমি সংস্কার, পানিসম্পদ উন্নয়ন ও ব্যবস্থাপনার জন্য একটি কাঠামো তৈরি ইত্যাদি পদক্ষেপের কথা উল্লেখ আছে। তবে তার বাস্তবায়ন কতটুকু হচ্ছে তা আজ প্রশ্নের সম্মুখীন। তার পরও আমরা বুঝি সরকারের একার পক্ষে চরবাসীর বুকের জগদ্দল পাথর সরানো সম্ভব নয়। সরকারের উপজেলা ও ইউনিয়ন পর্যায়ে অবস্থিত স্থানীয় প্রতিষ্ঠানগুলোর প্রত্যক্ষ সহযোগিতা ছাড়া অক্টোপাসের মতো খামছে ধরা চরবাসীর চতুর্মুখী সমস্যা শুধু আন্তর্জাতিক উন্নয়ন সংস্থাগুলোর পক্ষে দূরীভূত করা সম্ভব নয়।
য় বাজিতপুর, কিশোরগঞ্জ

No comments

Powered by Blogger.