প্রস্তাবিত ভৈরব জেলা নিয়ে জটিলতাঃ শ্যাম রাখি না কুল রাখি

শ্যাম রাখি, না কুল রাখি অবস্থায় পড়েছেন রাষ্ট্রপতি, স্পিকারসহ কিশোরগঞ্জ অঞ্চলের এমপি-মন্ত্রীরা। বিগত নির্বাচনের সময় ভৈরবকে জেলা করার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন প্রবীণ আওয়ামী লীগ নেতা জিল্লুর রহমান। রাষ্ট্রপতি হওয়ার পর তার ছেলে উপনির্বাচনে জয়ী হয়ে এমপি হয়েছেন। কিছুদিন আগে সরকার ভৈরবসহ কিশোরগঞ্জের কুলিয়ারচর, নিকলী, বাজিতপুর, কটিয়াদী উপজেলা নিয়ে দেশের ৬৫তম জেলা হিসেবে ভৈরব জেলা গঠনের নীতিগত সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে। নিশ্চয়ই আগপিছ ভেবেই সরকার এগিয়েছিল।
কিন্তু এখন যে মহাজটিলতা সৃষ্টি হয়েছে তাতে কোথায়ও যে বড় ধরনের ভুল হয়েছে এতে সন্দেহ নেই। অবশ্য মহাজোট সরকার অনেক বিষয়েই মহাভুল করার বদঅভ্যাস ভালোভাবেই রপ্ত করেছে বলা যায়। ভৈরব জেলা ঘোষণা এরকম একটা ভুল বলে প্রমাণিত হতে যাচ্ছে। নতুন জেলা ঘোষণার সরকারি সিদ্ধান্ত কানে যেতে না যেতেই কিশোরগঞ্জবাসী সমস্বরে ফুঁসে উঠেছে। ঐতিহ্যবাহী জেলা হিসেবে কিশোরগঞ্জের অখণ্ডতা রক্ষায় সোচ্চার হয়ে উঠেছে সেখানকার আমজনতা। দলমত, শ্রেণী-পেশা নির্বিশেষে সবার মুখে এক কথা, ‘ভৈরব জেলা হলে জ্বলবে আগুন ঘরে ঘরে।’ আন্দোলনের ১৫তম দিনে গত সোমবার সর্বদলীয় নাগরিক সংগ্রাম কমিটির ডাকে জেলাব্যাপী পালিত হয়েছে দিনভর সর্বাত্মক হরতাল। ১৯৭০-এর পর এমন স্বতঃসম্ফূর্ত ও সফল হরতাল দেখেনি সেখানকার মানুষ। ক্ষুব্ধ কিশোরগঞ্জবাসী রাষ্ট্রপতির কুশপুত্তলিকা নিয়ে বিক্ষোভ করেছে। জুতো-স্যান্ডেল মেরে তাতে অগ্নিসংযোগ করেছে। জাতীয় সংসদে বিরোধ ও বর্জন থাকলেও জেলা রক্ষার আন্দোলনে ঐক্যের অভাব হয়নি। সেখানে গ্রাম-পাড়া থেকে উপজেলা-জেলা সদরে কিশোরগঞ্জবাসী একাট্টা সরকারি সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে। ফলে জেলার এমপিরা পড়েছেন মহাবিপদে। তারা সবাই যে সরকারদলীয়! অবস্থা যে এমন বেগতিক হয়ে উঠবে, সেটা সম্ভবত তারা আগে টের পাননি। মাত্র দশ মাসে এতটা গণবিচ্ছিন্নতা, ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের পক্ষে মেনে নেয়া কঠিন বৈকি!
এখন ঢাকায় বসে কিশোরগঞ্জের এমপিরাও সক্রিয় হয়ে উঠেছেন। স্পিকার এবং এলজিআরডিমন্ত্রীর নেতৃত্বে তারা প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে দেখা করেছেন। তাদের সঙ্গে ছিলেন পার্শ্ববর্তী নরসিংদীর এমপি, ডাক ও টেলিযোগাযোগমন্ত্রীও। তার নির্বাচনী এলাকা রায়পুরার একাংশও নতুন জেলা ভৈরবে অন্তর্ভুক্তির আপত্তি জানাতে তিনিও ভৈরব জেলা গঠনের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়েছেন। যদিও তার এলাকায় বিপরীত হাওয়া বইতে শুরু করেছে। প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে সাক্ষাত্কালে তার এলাকা বিচ্ছিন্ন করা হলে তিনি জাতীয় সংসদের সামনে গায়ে পেট্রোল ঢেলে আত্মহত্যার স্লমকি দিয়েছেন বলে জানা গেছে। ঘটনার এখানেই শেষ নয়। আরও খবর হলো, প্রস্তাবিত ভৈরব জেলার অন্তর্ভুক্ত নিকলী ও কটিয়াদী উপজেলা কিশোরগঞ্জের পক্ষে থাকলেও বাজিতপুর উপজেলায় শুরু হয়েছে স্বতন্ত্র জেলা প্রতিষ্ঠার আন্দোলন। সোমবার সেখানেও জেলা গঠনের দাবিতে আধাবেলা হরতাল পালিত হয়েছে। বাজিতপুর জেলা গঠনের দাবিসংবলিত সিল্টকার বুকে নিয়ে এক মুক্তিযোদ্ধা মিছিলে বিক্ষোভকালে হঠাত্ করে মারা যান। ফলে সে আন্দোলনও এখন তুঙ্গে। এ অবস্থায় কিশোরগঞ্জ অঞ্চলের আওয়ামী লীগ এমপিরা নিজেদের অবস্থান ধরে রাখতে দলবেঁধে রাষ্ট্রপতির সঙ্গেও সাক্ষাত্ করেছেন। তার ফলাফল অবশ্য জানা যায়নি।
ক্ষমতায় যাওয়ার জন্য জনগণের সমর্থন পেতে অবস্থা বুঝে কথা বলা রাজনীতিকদের পুরনো রীতি হলেও এক্ষেত্রে আওয়ামী লীগ সবাইকে টেক্কা দিয়েছে সবসময়ই। বিগত নির্বাচনে দশ টাকা সের চাল, বিনা পয়সায় সার, সারাদেশে বিদ্যুত্ ও গ্যাস সরবরাহের পাশাপাশি ছিল ভৈরবকে নতুন জেলা করার নির্বাচনী প্রতিশ্রুতি। অন্যগুলো সম্ভব না হলেও এ প্রতিশ্রুতির বাস্তবায়ন রাষ্ট্রপতির জন্য ইজ্জতের ব্যাপার মনে করেই সম্ভবত এর বাস্তবায়নে হাত দিয়েছে মহাজোট সরকার। কিন্তু হাতে যে এমন মহাছ্যাঁকা লাগবে, কে জানত! এখন চারদিকেই আগুন জ্বলে উঠেছে। ভৈরব জেলা ঘোষণায় সেখানে আনন্দ-উত্সব, মিষ্টি বিতরণ চললেও কিশোরগঞ্জ জেলাব্যাপী যে বিক্ষোভ দানা বেঁধেছে তাতে ভবিষ্যত্ নিয়ে বিচলিত স্থানীয় এমপিরা। তারা এখন একযোগে সস্তা রাজনৈতিক ও ব্যক্তিগত স্বার্থে কিশোরগঞ্জ ভাঙার বিরোধিতা করছেন। রাষ্ট্রপতি ও তার পুত্র দলীয় এমপির বিরুদ্ধে আকাশ ফাটানো স্লোগানের মুখেও তাদের নিশ্চুপ থাকতে হচ্ছে। এভাবে তেতো গেলার দশা অন্য এমপিদের জন্যও অপেক্ষা করছে, বলাটা মোটেই অত্যুক্তি হবে না। প্রস্তাবিত ভৈরব জেলা নিয়ে যে পরিস্থিতি ক্রমেই বিপজ্জনক হয়ে উঠছে, সেটা সাধারণ মানুষের মনের উত্তাপ থেকে আঁচ করা যায়। আত্মতৃপ্ত ক্ষমতাসীনরা সেটা বুঝতে দেরি করলে সৃষ্ট পরিস্থিতির দায় এড়ানো কঠিন হবে।

No comments

Powered by Blogger.