চারদিক-আমাদের ইশ্কুল


৩-২৪ ডিসেম্বর। ঢাকার গভর্নমেন্ট ল্যাবরেটরি হাইস্কুলের সুবর্ণজয়ন্তী উৎসব। যতটুকু বয়স হলে অনায়াসে ‘ঐতিহ্যবাহী’ বলা যায়, এই স্কুল হয়তো ততটা পুরোনো নয়। বয়স মাত্র ৫০। কিন্তু এর মধ্যেই এটি বিশিষ্ট এবং এই বিশিষ্টতা অর্জন করতে এ স্কুলটি বেশি সময় নেয়নি। জন্মের কয়েক বছরের মধ্যেই জানান দিয়েছিল, ‘এসেছি, দেখেছি এবং জয় করেছি।’ ২৩ ডিসেম্বর ল্যাবরেটরি স্কুলের জন্মদিন নয়। উৎসবটা শুরু হল নানান কারণে। এই স্কুলের ভর্তি


পরীক্ষার প্রথম বিজ্ঞপ্তি পত্রিকায় ছাপা হয়েছিল ১৯৬১ সালের জুলাই মাসে। ভর্তি পরীক্ষা নেওয়া হয় আগস্টের প্রথম দিকে। তারপর ফলাফল ঘোষণা। ক্লাস শুরু হয় ২৮ আগস্ট। তবে আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন হয়েছিল ৩ সেপ্টেম্বর। উদ্বোধন করেছিলেন তখনকার গণশিক্ষা পরিচালক শামস উল হক হক (পরবর্তী সময়ে বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী)। আমি ‘প্রতিষ্ঠাতা ছাত্র’দের অন্যতম।
স্কুল যখন শুরু হয়, তখন এটা ছিল প্রথম থেকে অষ্টম শ্রেণী পর্যন্ত। একসঙ্গে প্রাথমিক এবং মাধ্যমিক পর্যায় নিয়ে ঢাকায় তখন কোনো সরকারি স্কুল ছিল না। এ ক্ষেত্রে আমরাই প্রথম। প্রথম ব্যাচ মাধ্যমিক পরীক্ষা দিল ১৯৬৪ সালে। দ্বিতীয় ব্যাচ অর্থাৎ ১৯৬৫ থেকে শুরু হলো জয়যাত্রা। ঢাকা বোর্ডে সম্মিলিত মেধাতালিকায় দুজন প্রথম হলেন। দুজনই এই স্কুলের। টানা চার বছর প্রথম স্থানটি দখল করে ল্যাবরেটরি স্কুল ইতিহাস তৈরি করল। সার্বিক ফলাফলের মানদণ্ডেও এই স্কুল ছিল এক নম্বরে।
তখন ‘নতুন ঢাকায়’ মতিঝিল সেন্ট্রাল গভর্নমেন্ট হাইস্কুল আর ইন্টারমিডিয়েট টেকনিক্যাল কলেজ (বর্তমানে তেজগাঁও বিজ্ঞান কলেজ) ছাড়া ছেলেদের জন্য আর কোনো সরকারি স্কুল ছিল না। তাই ল্যাবরেটরি স্কুলের ওপর চাপ ছিল যথেষ্ট। অনেক প্রতিযোগিতার মধ্য দিয়ে ভর্তি হতে হতো।
স্কুলটির নামের মধ্যে ‘ল্যাবরেটরি’ শব্দটির একটি অন্য রকম অর্থ আছে। আমরা ছিলাম টিচার্স ট্রেনিং কলেজের ছাত্রছাত্রীদের ল্যাবরেটরি। তাঁরা তাঁদের শিক্ষার অনুশীলনে আমাদের নিয়মিত ব্যবহার করতেন। অর্থাৎ আমাদের নিয়মিত শিক্ষকমণ্ডলীর অতিরিক্ত শিক্ষানবিস শিক্ষকদের অঢেল মনোযোগ পেতাম। স্কুলের আরেক দিকে ছিল শিক্ষা সম্প্রসারণ কেন্দ্র। এর পরিচালক ছিলেন আবদুল্লাহ আল-মুতী শরফুদ্দিন। তাঁর ওখানে বিভিন্ন স্কুলের শিক্ষকেরা নানা বিষয়ে প্রশিক্ষণ নিতে আসতেন। আমরা প্রায়ই তাঁদের ‘ল্যাবরেটরি’ হিসেবে ব্যবহূত হতাম। এত মনোযোগের পর পরীক্ষার ফল খারাপ হওয়াটা ছিল নিতান্তই দুর্ঘটনা। যত দূর মনে পড়ে, প্রথম বছর একজন ছাত্র তৃতীয় বিভাগ পেয়েছিলেন। অকৃতকার্য হননি কেউ। তারপর থেকে তৃতীয় বিভাগ উধাও।
জন্মলগ্ন থেকে এই স্কুলের প্রধান শিক্ষকের দায়িত্ব নিয়েছিলেন খান মুহাম্মদ সালেক। তাঁর কথা বলে শেষ করা যাবে না। শিক্ষা, নিয়মানুবর্তিতা আর সৌজন্যবোধের তিনি ছিলেন প্রতীক। বেছে বেছে দেশের সেরা শিক্ষকদের তিনি সংগ্রহ করেছিলেন। আবু হাম্মাদ আবুল বাসেত, সিরাজুল হক খান, মোহাম্মদ জাফরউল্লাহ, মোহাম্মদ মতিউল্লাহ, কাজি নুরুল হক, সিদ্ধেশ্বর সরকার, আনিস চৌধুরী, আবুল হোসেন মিয়া, জহিরুল হক, এ বি এম নুরুল ইসলাম, মোহাম্মদ নুরুল ইসলাম, শরিফুল ইসলাম—এই গুণী শিক্ষকদের সান্নিধ্য পেয়েছিলাম আমরা। আরও অনেকেই ছিলেন, যাঁদের কথা এই মুহূর্তে মনে করতে পারছি না।
আমাদের স্কুলে আলাদা কোনো গ্রন্থাগার ছিল না। প্রতিটি শ্রেণীকক্ষে একটা আলমারিতে বোঝাই থাকত নানা রকম বই। সপ্তাহে এক দিন আমরা ওই বই সংগ্রহ করতাম, একটা বই পড়ে শেষ করতে আর কতক্ষণ লাগে? আমরা নিজেদের মধ্যে বইগুলো অদলবদল করে পড়তাম।
বিজ্ঞান গবেষণাগারে ছিল সব রকমের আয়োজন। আমি এখানেই প্রথম মাইক্রোস্কোপ দেখি। একটা কঙ্কালও ছিল। ওর পাশ দিয়ে হাঁটাচলা করার সময় শার্টের বোতাম খুলে বুকে ফুঁ দিতাম।
স্কুল শুরুর কয়েক মাসের মধ্যেই চালু হয় ইউনিফর্ম। সাদা শার্ট আর নেভি ব্লু প্যান্ট। ওই সময় ঢাকায় আমরা ছাড়া ছেলেদের অন্য কোনো স্কুলে ইউনিফর্ম চালু ছিল কি না জানি না। বিশাল একটা খেলার মাঠ ছিল। এখনো আছে। তবে আমরা খেলাধুলায় ততটা সময় দিতাম না। মাধ্যমিক টেস্ট পরীক্ষায় কেউ কোনো বিষয়ে পঞ্চাশের নিচে নম্বর পেলে তাদের আলাদা করে স্কুলে বিশেষ কোচিংয়ের ব্যবস্থা করা হতো। এ জন্য অতিরিক্ত কোনো ফি দিতে হতো না। শিক্ষকদের এত যত্ন, এত আদর, এত আয়োজন, তা ব্যর্থ হয়নি। আমরা পরীক্ষার ফলাফল দিয়ে তাঁদের মুখে হাসি এনে দিতাম। তার পরও বলব, এই ঋণ শোধ হওয়ার নয়।
আমি ভর্তি হয়েছিলাম পঞ্চম শ্রেণীতে। সেবার আমাদের ব্যাচ থেকে তিনজনকে নির্বাচিত করা হলো বৃত্তি পরীক্ষা দেওয়ার জন্য। আমরা তিনজনই উত্তীর্ণ হলাম। ১০ জন দিলে ১০ জনই হতাম। কিন্তু হেড স্যার কোনো ঝুঁকি নিতে চাননি। প্রথম বছর, তাই কেউ পরীক্ষা দিয়ে বৃত্তি পাবে না, এটা তিনি চাননি। স্কুলের সম্মান নিয়ে তাঁর এই অতিসাবধানতার সুফল এই স্কুলের ছাত্ররা ধারাবাহিকভাবে বছরের পর বছর ভোগ করেছে।
স্কুলের চৌহদ্দি পেরিয়ে, দেয়াল ডিঙিয়ে আমরা অধিকাংশই ঢাকা কলেজে পড়েছি। তারপর ছিটকে পড়েছি এদিক-সেদিক। কেউ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে, কেউ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ে, কেউ বা ঢাকা মেডিকেল কলেজে, তারপর কে কোথায় গেছে, কোথায় আছে, তার হদিস রাখা খুব কঠিন। ৫০ বছর পূর্তির অনুষ্ঠানে হয়তো অনেকের সঙ্গে দেখা হবে। অনেক প্রিয় শিক্ষককে আর কখনোই দেখতে পাব না। তাঁরা আর এ জগতে নেই। এই মুহূর্তে বিশেষ করে মনে পড়ছে সিরাজুল হক খান স্যারের কথা। তিনি ক্লাস ফাইভে আমাদের ইংরেজি পড়িয়েছিলেন। তারপর বিলেত থেকে একটা প্রশিক্ষণ নিয়ে এসে যোগ দিয়েছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা ও গবেষণা ইনস্টিটিউটে। একাত্তরের ১৪ ডিসেম্বর আরও অনেকের সঙ্গে তাঁকেও ঘাতকেরা ধরে নিয়ে যায়। তিনি আর ফিরে আসেননি।
মহিউদ্দিন আহমদ
mohi2005@gmail.com

No comments

Powered by Blogger.