বর্ষীয়ান জননেতা আবদুর রাজ্জাক আর নেই

মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক, বর্ষীয়ান জননেতা, বঙ্গবন্ধুর বিশ্বস্ত সহযোগী, সাবেক মন্ত্রী ও আওয়ামী লীগের উপদেষ্টা পরিষদ সদস্য আবদুর রাজ্জাক এমপি আর নেই। লন্ডনের কিংস কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় শুক্রবার বাংলাদেশ সময় রাত ৯টা ৪৬ মিনিটে (লন্ডন সময় বিকেল ৩টা ৪৬ মিনিটে) শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন তিনি (ইন্নালিল্লাহি ... রাজিউন)। পানিসম্পদ মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সভাপতি আবদুর রাজ্জাককে এর আগে থেকে ওই


হাসপাতালের আইসিইউতে লাইফ সাপোর্ট দিয়ে বাঁচিয়ে রাখা হয়েছিল। শুক্রবার বাংলাদেশ সময় সন্ধ্যায়ই বাঁচার আর
কোনো আশা না থাকায় তার লাইফ সাপোর্ট খোলার অপেক্ষায় ছিলেন চিকিৎসকরা। পরে তার স্ত্রী ফরিদা রাজ্জাক চিকিৎসকদের অনুরোধ করেছিলেন একজন মৌলভী ডেকে তওবা পড়ানোর পরই লাইফ সাপোর্ট খুলে দেওয়ার জন্য। পরে তার শয্যাপাশে কোরআন তেলাওয়াতও শুরু হয়।
লন্ডন থেকে রাজ্জাকের ভাতিজা আবদুল কাদের রতন শুক্রবার বাংলাদেশ সময় রাত ১০টায় সমকালকে জানান, লন্ডন সময় বিকেল ৩টা ৪৬ মিনিটে আবদুর রাজ্জাকের মৃত্যু নিশ্চিত হয়ে যাওয়ায় চিকিৎসকরা ভেন্টিলেশন সিস্টেম খুলে আনুষ্ঠানিকভাবে মৃত ঘোষণা করেন তাকে।
তার বয়স হয়েছিল ৬৯ বছর। তিনি স্ত্রী ফরিদা রাজ্জাক, দুই ছেলে নাহিম রাজ্জাক ও ফাহিম রাজ্জাক, পুত্রবধূ মালিহা হোসাইন ও একমাত্র নাতি চায়াফ এমডি রাজ্জাকসহ বহু আত্মীয়স্বজন, রাজনৈতিক সহকর্মী ও অসংখ্য গুণগ্রাহী রেখে গেছেন।
আবদুর রাজ্জাকের মৃত্যুতে রাজনৈতিকসহ সর্বমহলে শোকের ছায়া নেমে এসেছে। তার মৃত্যুর খবর ছড়িয়ে পড়ার সঙ্গে সঙ্গেই বিভিন্ন দল ও সংগঠনের নেতাসহ তার রাজনৈতিক সহকর্মী, আত্মীয়স্বজন, শুভাকাঙ্ক্ষী ও সর্বস্তরের মানুষ রাজধানীর গুলশানের তার বাসায় ছুটে যান। আওয়ামী লীগের ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদক মাহবুবউল আলম হানিফ এবং তথ্য ও গবেষণা সম্পাদক অ্যাডভোকেট আফজাল হোসেন রাতেই ওই বাসায় গিয়ে শোকসন্তপ্ত পরিবারের সদস্যদের প্রতি গভীর সমবেদনা জানান। তার নিজ এলাকা শরীয়তপুরেও শোকের ছায়া নেমে এসেছে।
আবদুর রাজ্জাকের মরদেহ বাংলাদেশ বিমানের ফ্লাইটযোগে আগামীকাল রোববার সকাল ১১টায় দেশে আসার কথা রয়েছে। বিমানের একটি ফ্লাইট আজ শনিবার সকালে লন্ডনে যাবে এবং লন্ডন সময় বিকেল ৫টায় মরদেহ নিয়ে ঢাকার উদ্দেশে রওনা হবে।
এর আগে আবদুর রাজ্জাক দীর্ঘদিন থেকেই কিডনি, লিভার ও ফুসফুসের জটিলতাসহ বিভিন্ন রোগে ভুগছিলেন। সাবেক এই মন্ত্রী দেশ-বিদেশের বিভিন্ন হাসপাতালে চিকিৎসাও নিয়েছেন। গুরুতর অসুস্থ হয়ে পড়ায় গত সেপ্টেম্বর মাসে লন্ডনের কিংস কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করা হয় তাকে। তার দেহে লিভার প্রতিস্থাপনের জন্য ১১ ডিসেম্বর দিন ঠিক হলেও পরীক্ষার পর চিকিৎসকরা জানান, তার কিডনিও প্রতিস্থাপন করতে হবে। তারা দুটি অঙ্গই এক সঙ্গে প্রতিস্থাপন করার পক্ষে মত দেওয়ায় অস্ত্রোপচার পিছিয়ে যায়। এ অবস্থায় শারীরিক অবস্থার অবনতির কারণে তাকে ওই হাসপাতালের আইসিইউতে নেওয়া হয়। গত তিনদিন ধরে লাইফ সাপোর্টে রাখা হয়েছিল তাকে।
শরীয়তপুর প্রতিনিধি জানান, আবদুর রাজ্জাকের মৃত্যুর খবর ছড়িয়ে পড়লে রাতেই শরীয়তপুরের সর্বস্তরের মানুষের মধ্যে শোকের ছায়া নেমে আসে। তার দীর্ঘদিনের রাজনৈতিক সহকর্মীরা শোকে মাতম করতে থাকেন। কান্নায় ভেঙে পড়েন আওয়ামী লীগ ও সহযোগী সংগঠনের নেতাকর্মী-সমর্থক এবং তার ভক্ত-অনুরাগীরাও।
তার জন্মস্থান ডামুড্যায় তার পৈতৃক বাড়িতেও শোকের মাতম চলছে। রাজনৈতিক সহকর্মী ও সহমর্মীদের অনেকেই ছুটে যান এ বাড়িতে। তার নির্বাচনী এলাকা ভেদরগঞ্জ, ডামুড্যা ও গোসাইরহাট উপজেলা সদরের সব দোকানপাট ও ব্যবসা প্রতিষ্ঠান বন্ধ করে শোক প্রকাশ করেন স্থানীয়রা।
রাষ্ট্রপতি, প্রধানমন্ত্রী ও বিরোধীদলীয় নেতার শোক : আবদুর রাজ্জাকের মৃত্যুতে গভীর শোক প্রকাশ করেছেন রাষ্ট্রপতি মোঃ জিল্লুর রহমান, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এবং বিরোধীদলীয় নেতা খালেদা জিয়া। পৃথক শোক বিবৃতিতে মরহুমের রুহের মাগফেরাত কামনা ও শোকসন্তপ্ত পরিবারের প্রতি সমবেদনা জানিয়েছেন তারা।
আরও শোক জানিয়েছেন জাতীয় পার্টি চেয়ারম্যান সাবেক রাষ্ট্রপতি হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ, আওয়ামী লীগ সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য সংসদ উপনেতা সৈয়দা সাজেদা চৌধুরী, স্পিকার আবদুল হামিদ অ্যাডভোকেট, ডেপুটি স্পিকার কর্নেল (অব.) শওকত আলী, আওয়ামী লীগের ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদক মাহবুবউল আলম হানিফ, বিএনপির ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর, পাটমন্ত্রী আবদুল লতিফ সিদ্দিকী, যোগাযোগমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের, শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদ, বেসামরিক বিমান পরিবহন ও পর্যটনমন্ত্রী লে. কর্নেল (অব.) ফারুক খান, তথ্যমন্ত্রী আবুল কালাম আজাদ, পানিসম্পদমন্ত্রী রমেশ চন্দ্র সেন, মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক প্রতিমন্ত্রী ক্যাপ্টেন (অব.) এবি তাজুল ইসলাম, এলজিআরডি প্রতিমন্ত্রী অ্যাডভোকেট জাহাঙ্গীর কবির নানক, গণফোরাম সভাপতি ড. কামাল হোসেন, সাধারণ সম্পাদক মোস্তফা মহসীন মন্টু, বাংলাদেশের ওয়ার্কার্স পার্টির সভাপতি রাশেদ খান মেনন এমপি, সাধারণ সম্পাদক আনিসুর রহমান মলি্লক, জেএসডি সভাপতি আসম আবদুর রব, সাধারণ সম্পাদক আবদুল মালেক রতন, বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজসম্পদ বিষয়ক মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সভাপতি মেজর জেনারেল (অব.) সুবিদ আলী ভূঁইয়া, আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক বিএম মোজাম্মেল হক এমপি, কমিউনিস্ট কেন্দ্রের যুগ্ম আহ্বায়ক ডা. অসীত বরণ রায়, যুবলীগ চেয়ারম্যান ওমর ফারুক চৌধুরী, সাধারণ সম্পাদক মির্জা আজম এমপি, ঢাকার সাবেক মেয়র সাদেক হোসেন খোকা, সাবেক পানিসম্পদমন্ত্রী মেজর (অব.) হাফিজ উদ্দিন আহমেদ, জয়বাংলা সাংস্কৃতিক ঐক্যজোট সভাপতি সালাউদ্দীন বাদল, সাধারণ সম্পাদক শেখ আবদুল কাদের, যুক্তরাষ্ট্র আওয়ামী লীগ সভাপতি ড. সিদ্দিকুর রহমান, সাধারণ সম্পাদক সাজ্জাদুর রহমান সাজ্জাদ, নিউইয়র্ক সিটি আওয়ামী লীগ সভাপতি নূরুন্নবী, যুক্তরাষ্ট্র যুবলীগ সভাপতি মিসবাহ আহমেদ, সাধারণ সম্পাদক ফরিদ আলম, যুক্তরাষ্ট্র স্বেচ্ছাসেবক লীগ সভাপতি মহিউদ্দিন দেওয়ান, সাধারণ সম্পাদক নুরুজ্জামান সরদার, যুক্তরাষ্ট্র ছাত্রলীগ সভাপতি জেড আলম জয়, বরিশাল জেলা আওয়ামী লীগ ভারপ্রাপ্ত সভাপতি জেলা পরিষদের প্রশাসক ডা. মোখলেসুর রহমান, সাধারণ সম্পাদক সাবেক চিফ হুইপ আবুল হাসানাত আবদুল্লাহ, মহানগর আওয়ামী লীগ আহ্বায়ক সিটি মেয়র শওকত হোসেন হিরন, সাংসদ তালুকদার মোঃ ইউনুস, মনিরুল হাসান খান, অ্যাডভোকেট আফজালুল করিম, শরীয়তপুর জেলা আওয়ামী লীগ সভাপতি আবদুর রব মুন্সি, সাধারণ সম্পাদক অনল কুমার দে, জেলা পরিষদের প্রশাসক মাস্টার মজিবুর রহমান, জেলা যুবলীগ সভাপতি জাহাঙ্গীর হোসেন মৃধা, সাধারণ সম্পাদক নুহুন মাদবর, ভেদরগঞ্জ পৌর মেয়র মান্নান হাওলাদার, ডামুড্যা পৌর মেয়র হুমায়ুন কবির বাচ্চু ছৈয়াল, উপজেলা চেয়ারম্যান আলমগীর হোসেন মাঝি, ভেদরগঞ্জ উপজেলা চেয়ারম্যান হুমায়ুন কবির মোল্লা, গোসাইরহাট উপজেলা চেয়ারম্যান ফজলুর রহমান, নড়িয়া উপজেলা চেয়ারম্যান আবদুল ওহাব বেপারী, পৌর মেয়র হায়দার আলী, জাজিরা উপজেলা চেয়ারম্যান অধ্যক্ষ মোশাররফ হোসেন, পৌর মেয়র আবুল খায়ের ফকির, কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগের উপ-ধর্ম বিষয়ক সম্পাদক ভবেশ্বর রোয়াজা নিকি, শরীয়তপুর সাহিত্য একাডেমী সভাপতি মফিজুল ইসলাম, খাগড়াছড়ি জেলা আওয়ামী লীগ সভাপতি যতীন্দ্রলাল ত্রিপুরা এমপি, সহ-সভাপতি জেলা পরিষদ চেয়ারম্যান কুজেন্দ্রলাল ত্রিপুরা, সাধারণ সম্পাদক জাহেদুল আলম, খাগড়াছড়ি পৌর মেয়র রফিকুল আলম, সদর উপজেলা চেয়ারম্যান শানে আলম এবং জেলা যুবলীগ সাধারণ সম্পাদক দিদারুল আলম।

আবদুর রাজ্জাকের বর্ণাঢ্য রাজনৈতিক জীবন : শুক্রবার জীবনাবসানের মধ্যদিয়ে মহান মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম সংগঠক ও বর্ষীয়ান আওয়ামী লীগ নেতা আবদুর রাজ্জাক এমপির বর্ণাঢ্য রাজনৈতিক জীবনেরও ইতি ঘটেছে।
আওয়ামী লীগের উপদেষ্টা পরিষদের অন্যতম সদস্য আবদুর রাজ্জাকের জন্ম ১৯৪২ সালের ১ আগস্ট শরীয়তপুর জেলার ডামুড্যা উপজেলার দক্ষিণ ডামুড্যা গ্রামের এক মধ্যবিত্ত পরিবারে। তার বাবার নাম ইমাম উদ্দিন এবং মার নাম বেগম আকফাতুন্নেছা।
তিনি ১৯৫৮ সালে ডামুড্যা মুসলিম উচ্চ বিদ্যালয় থেকে এসএসসি এবং ১৯৬০ সালে ঢাকা কলেজ থেকে এইচএসসি পাস করেন। এরপর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়ে ১৯৬৪ সালে রাষ্ট্রবিজ্ঞানে অনার্স এবং পরে মাস্টার্স পাস করেন। ১৯৬৭ সালে এলএলবি পাস করার পর ১৯৭৩ সালে আইনজীবী হিসেবে বার কাউন্সিলে নিবন্ধিত হন।
সাবেক এ মন্ত্রীর বর্ণাঢ্য রাজনৈতিক জীবনের শুরু পঞ্চাশের দশকের শেষদিকে। ছাত্রাবস্থায়ই তিনি আওয়ামী লীগের ভাতৃপ্রতিম সংগঠন ছাত্রলীগের রাজনীতির সঙ্গে সম্পৃক্ত হন। তিনি ১৯৬০-৬২ সালে পূর্ব পাকিস্তান ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য ছিলেন। ১৯৬৩-৬৫ সাল পর্যন্ত তিনি ছাত্রলীগের সহসাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৬৩ সালে তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফজলুল হক হলের সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন। ১৯৬৫-৬৭ সাল পর্যন্ত তিনি পরপর দু'বার পূর্ব পাকিস্তান ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন। ১৯৬২-৬৩ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফজলুল হক হল ছাত্রছাত্রী সংসদের নির্বাচনে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় সহ-সাধারণ সম্পাদকও নির্বাচিত হন।
১৯৬৯-৭২ সাল পর্যন্ত তিনি আওয়ামী লীগের স্বেচ্ছাসেবক বিভাগের প্রধান ছিলেন। ১৯৭২-৭৫ সাল পর্যন্ত দলের সাংগঠনিক সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেছেন। ১৯৭৫-৭৮ সাল পর্যন্ত তিনি বাকশালের সম্পাদক ছিলেন। ১৯৭৮-৮১ সাল পর্যন্ত পরপর দু'বার আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেন। এরপর ১৯৮৩ সালে বাকশাল গঠন করে ১৯৯১ সাল পর্যন্ত বাকশালের সাধারণ সম্পাদক ছিলেন। পরে ১৯৯১ সালে বাকশাল বিলুপ্ত করে আওয়ামী লীগে ফিরে আসেন। ১৯৯১-২০০৯ সাল পর্যন্ত তিনি আওয়ামী লীগের সভাপতিম মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম এ সংগঠক বাষট্টির শিক্ষা আন্দোলন, ছেষট্টির ছয় দফা আন্দোলন ও ঊনসত্তরের গণঅভ্যুত্থানে অগ্রণী ভূমিকা পালন করেছেন। একাত্তরের স্বাধীনতা সংগ্রাম এবং মহান মুক্তিযুদ্ধে অসামান্য অবদান রয়েছে তার। ওই সময় গঠিত মুজিব বাহিনীর একজন সংগঠক ও রূপকারও ছিলেন। মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে ভারতের মেঘালয়ে মুজিব বাহিনীর সেক্টর কমান্ডারের (মুজিব বাহিনীর চার সেক্টর কমান্ডারের একজন) দায়িত্ব পালন করেছেন। দেরাদুনে ভারতের সেনাবাহিনীর জেনারেল উবানের কাছে প্রশিক্ষণ নেওয়া এ বীর যোদ্ধা মুক্তিযোদ্ধাদের প্রশিক্ষকও ছিলেন।
স্বাধীনতার পর সামরিক স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনসহ সব গণতান্ত্রিক আন্দোলন-সংগ্রামের পুরোভাগে থেকে নেতৃত্ব দিয়েছেন আবদুর রাজ্জাক। অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার স্বপ্ন নিয়ে মৌলবাদ, সাম্প্রদায়িকতা ও যাবতীয় প্রতিক্রিয়াশীলতার বিরুদ্ধে সারাজীবন সংগ্রাম করেছেন তিনি। নব্বই দশকের শুরুতে শহীদ জননী জাহানারা ইমামের নেতৃত্বে একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটির ব্যানারে স্বাধীনতাবিরোধী রাজাকার ও যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের দাবিতে গড়ে ওঠা গণআন্দোলনে অগ্রণী ভূমিকা পালন করেন তিনি। মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বাস্তবায়ন ও একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল জাতীয় সমন্বয় কমিটির অন্যতম সদস্য ছিলেন।
ছাত্র রাজনীতির সময় থেকেই আবদুর রাজ্জাক আন্দোলন-সংগ্রামে যুক্ত হয়ে পড়ায় তখন থেকেই অত্যাচার-নির্যাতন ও জেল-জুলুমও ভোগ করেন। রাজনৈতিক জীবনে বহুবার গ্রেফতার হন তিনি। আইয়ুব খানের শাসনামলে ১৯৬৪ সালে প্রথম গ্রেফতার হয়ে ১৯৬৫ সাল পর্যন্ত জেল খাটেন। কারাগার থেকেই মাস্টার্স পরীক্ষায় অংশ নেন। এরপর ৬ দফা আন্দোলন করতে গিয়ে ১৯৬৭-৬৯ সাল পর্যন্ত কারারুদ্ধ ছিলেন তিনি। ১৯৭৫ সালে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে সপরিবারে হত্যার পর আবারও গ্রেফতার হয়ে ১৯৭৮ সাল পর্যন্ত কারাবন্দি ছিলেন। এরশাদের শাসনামলে সামরিক স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনের সময় ১৯৮৭ সালে তাকে গ্রেফতার করা হয়।
আবদুর রাজ্জাক ১৯৭০ সালের নির্বাচনে প্রাদেশিক পরিষদ সদস্য নির্বাচিত হন। এরপর স্বাধীন বাংলাদেশে আওয়ামী লীগের মনোনীত প্রার্থী হিসেবে ১৯৭৩, ১৯৯১, ১৯৯৬, ২০০১ ও ২০০৮ সালে জাতীয় সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। তার নির্বাচনী এলাকা শরীয়তপুর-৩ (ডামুড্যা-গোসাইরহাট)।
১৯৯৬ সালে শেখ হাসিনার নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর আবদুর রাজ্জাক ওই সরকারের পানিসম্পদমন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করেন। তার মন্ত্রী থাকাকালেই ১৯৯৭ সালে ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের ঐতিহাসিক গঙ্গার পানিবণ্টন চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। এর আগে পঞ্চম জাতীয় সংসদে স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় মন্ত্রণালয় এবং যোগাযোগ মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সদস্য ছিলেন। গত জোট সরকারের সময় অষ্টম জাতীয় সংসদে তিনি পানিসম্পদ মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত স্থায়ী কমিটির সদস্য হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। বর্তমান নবম জাতীয় সংসদে তিনি ছিলেন পানিসম্পদ মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সভাপতি। এ পদে থেকে তার নেতৃত্বেই ২০০৯ সালের জুলাই-আগস্টে একটি সংসদীয় প্রতিনিধি দল ভারতে টিপাইমুখ বাঁধ প্রকল্প পরিদর্শন করে।
বঙ্গবন্ধুর আদর্শের সোনার বাংলা এবং সন্ত্রাস-দুর্নীতিমুক্ত অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশ গড়ায় আজীবন লড়াই-সংগ্রামের পাশাপাশি শান্তি আন্দোলনেও অবদান রেখেছেন তিনি। মৃত্যুর আগ পর্যন্ত বাংলাদেশ শান্তি পরিষদের সভাপতির দায়িত্ব পালন করে গেছেন তিনি। আর্থ-সামাজিক-রাজনৈতিক ক্ষেত্রে অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ শেরেবাংলা জাতীয় পুরস্কার, নেতাজী সুভাষ বোস আন্তর্জাতিক শান্তি পুরস্কার এবং দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাস আন্তর্জাতিক পুরস্কারপ্রাপ্ত হন তিনি। রাষ্ট্রীয় ও ব্যক্তিগত প্রয়োজনে বিশ্বের বহু দেশ সফর করেছেন।
আবদুর রাজ্জাকের স্ত্রী ফরিদা রাজ্জাক। দুই পুত্র নাহিম রাজ্জাক ও ফাহিম রাজ্জাক।

No comments

Powered by Blogger.