দিনাজপুরে সুগন্ধি ধান চাষে আগ্রহ হারাচ্ছেন কৃষকরা by সানি সরকার

‘আমার বাড়ি যাইও বন্ধু বসতে দিব পিড়ে, জলপান যে করতে দিব শালি ধানের চিড়ে’। কবির কাব্যে স্থান পাওয়া আবহমান বাংলার ঐতিহ্যবাহী সেই শালি ধানের চিড়ার দিন শেষ হতে চলেছে। শুধু শালি ধান আর চিড়াই নয়, হাইব্রিড ধানের উৎপাতে স্থানীয় জাতের যাবতীয় সুগন্ধি ধানের উৎপাদন কমে যাচ্ছে। হারিয়ে যেতে বসেছে বাংলার নিজস্ব ধানের চিড়া, খই, মুড়ি, মুড়কি আর ঐতিহ্যবাহী পিঠা-পুলির স্বাদ।

কারণ, দিনে দিনে স্থানীয় সুগন্ধি জাতের ধান চাষের প্রতি আগ্রহ হারাচ্ছেন দিনাজপুরের কৃষকরা। ফলে জেলার ঐতিহ্যবাহী কাটারিভোগ, চিড়া ও সুগন্ধি চালের অতীত ঐতিহ্য হারিয়ে যেতে বসেছে।

সুগন্ধি জাতের অন্যান্য ধানের চাষ বাড়লেও তা পাওয়া যাচ্ছে না ঐতিহ্যবাহী স্বাদ আর সুগন্ধ।

হাইব্রিড ধানের চাষাবাদ, রাসায়নিক সার ব্যবহার, গুণগত মানসম্পন্ন বীজের অপ্রতুলতা, উৎপাদন খরচসহ নানা প্রতিকূলতায় এসব ধানের আবাদ ক্রমেই কমছে। এ জনপদের কৃষকরা এখন সুগন্ধি ধান চাষাবাদ নিয়ে উদ্বেগ ও নিরাশায় ভুগছেন। এ কারণে গুণে-মানে, স্বাদে-গন্ধে ভরা এই ধানচাষে আগের মতো আর উৎসাহ-উদ্দীপনা দেখা যায় না তাদের মধ্যে।

উত্তর জনপদের জেলাগুলোর মধ্যে দিনাজপুর অঞ্চলেই বেশি মাত্রায় কাটারিভোগ ও সুগন্ধি ধানের চাষাবাদ হয়। সদর উপজেলার খানপুর, কাউগা, ছোট বাউল, বড় বাউল, করিমুল্লাপুর, কাহারোল উপজেলার উঁচু জমিসহ চিরিরবন্দর উপজেলার তালপুকুর, মুকুন্দপুর, ভিয়াইল, পশ্চিম বাউল ও দুর্গাডাঙ্গায় এবং কাহারোল উপজেলার কিছু স্থানে এই জাতের ধান চাষাবাদ হয় সবচেয়ে বেশি।

এছাড়া দিনাজপুরের অন্যান্য উপজেলায় কম-বেশি এসব ধানের চাষ হয়। জেলার অন্যান্য উপজেলায় সাধারণত বেলে-দোঁআশ মাটিতে এসব ধানের আবাদ হয়। কিন্তু অন্য এলাকার মাটিতে উৎপাদিত এসব ধান তেমন সুগন্ধি হয় না।

জানা যায়, কাটারিভোগ ধান প্রতি একরে ২৪/২৫ মণ উৎপন্ন হয়। এখন এই উৎপাদন আরো অনেক কমে গেছে। গোবর সার এ ধান চাষের জন্য উত্তম। উৎপাদন কম, শ্রম লাগে বেশি তাই সবার পক্ষে পুষিয়ে নেওয়া সম্ভব হয় না। তাই কাটারিভোগ ধানচাষে উৎসাহ হারাচ্ছে কৃষকরা।

জনশ্রুতি আছে, আদিকালের হিন্দুদের দেবতার ভোগে এ চাল ব্যবহার হতো। তাই কাটারির সাথে ভোগ কথাটি যোগ হয়। কালের বির্বতনে তা দেবতার ভোগ থেকে অভিজাত শ্রেণীর আচার অনুষ্ঠানে স্থান পায়। আজো দিনাজপুরের কাটারিভোগ  ও সুগন্ধি চাল দেশি-বিদেশি অতিথি আপ্যায়নে সুনাম বজায় রেখেছে।
এ চালের পোলাও ছাড়া বিরিয়ানি, জর্দ্দা, পায়েশ ও ফিরনি বেশ চমৎকার ও সুস্বাদু- যা জিভে জল আনে।

দাম বেড়ে যাওয়ায় দিনাজপুরে আজ আর কৃষকরা নতুন ধান ঘরে তুলে উৎসবে লক্ষ্মী-নারায়ণ পূজায় এবং মসজিদে মিলাদ দিয়ে উৎসবের আয়োজন করে না।

কাটারিভোগ চাল মাথার দিকে ছুরির মতো একটুখানি চোখা ও বাঁকা। যেমন সুগন্ধি তেমনি খেতেও সুস্বাদু।
ইতিহাস থেকে জানা যায়, আর্যদের আগমনের পূর্ব থেকেই দিনাজপুরে কাটারিভোগ ধানের চাষ হয়ে আসছে। এরপর একে একে অন্যান্য সুগন্ধি ধানও এ এলাকায় চাষাবাদ শুরু হয়।

কথিত আছে, দিনাজপুরের রাজা প্রাণনাথের বিরুদ্ধে দুর্নীতি ও রাষ্ট্রদ্রোহের অভিযোগে রাজাকে ডেকে পাঠানো হয়েছিল মোগল সম্রাট আওরঙ্গজেবের দরবারে। রাজা প্রাণনাথ সম্রাটের সাথে দেখা করতে হীরা, পান্না, স্বর্ণমুদ্রা ছাড়াও কাটারিভোগ চাল সঙ্গে নিয়ে যান। সম্রাট হীরা, পান্না উপঢৌকন হিসেবে পেয়ে যতটা না খুশি হয়েছিলেন, তার থেকে বেশি খুশি হয়েছিলেন কাটারিভোগ চাল পেয়ে। এই খুশিতে সম্রাট প্রাণনাথকে ‘মহারাজা’ উপাধিতে ভূষিত করেন।

দিনাজপুর কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের উপপরিচালক আনোয়ারুল হক বাংলানিউজকে জানান, দিনাজপুরে চলতি মৌসুমে ১৬ হাজার ৫৫১ হেক্টর জমিতে সুগন্ধি ধানচাষ হয়েছে। এর মধ্যে কাটারিভোগ ৬ হাজার ১৯৭, জিরা কাটারি ৪ হাজার ৩৮৩, বাদশাভোগ ৮৫০, ফিলিপাইন কাটারি ৩ হাজার ৫৭৭, সম্পা কাটারি ২৯৫, কালোজিরা ৭০৯, বেগুণবিচি ২০০, জটা কাটারি ৫০, চিনিগুড়া ২৩৭, কালোনেনিয়া ৪৩ ও বোল্ডার কাটারি ১০ হেক্টর জমিতে আবাদ করা হয়েছে।

তিনি জানান, গত মৌসুমে দিনাজপুর জেলায় স্থানীয় জাতের সুগন্ধি ধান আবাদ হয়েছিল ১৬ হাজার ৮৫৩ হেক্টর জমিতে। উৎপাদনে কম হয় বলেই কৃষকরা সুগন্ধি ধানচাষে আগ্রহ হারিয়ে ফেলছে। পূর্বে প্রতি একরে ৩২/৩৩ মণ কাটারিভোগ ধান উৎপাদন হতো। পরবর্তী সময়ে জমির উর্বরাশক্তি শক্তি কমে যাওয়ায় ২৪/২৫ মণ ধান উৎপাদন হয়ে আসছে বলে তিনি মন্তব্য করেন।

দিনাজপুরের সদর উপজেলার কৃষক সেলিম রেজা বাংলানিউজকে জানান, কাটারিভোগ তথা সুগন্ধি ধান চাষে রাসায়নিক সার ব্যবহার করতে উৎপাদন বাড়লেও সেই ধান থেকে উৎপাদিত চালের তেমনটি সুগন্ধ থাকে না। সুগন্ধি ধানচাষের জন্য একমাত্র গোবর সারের প্রয়োজন। বর্তমানে গোবর সার কিনতেও পয়সা লাগে। তাছাড়া এই ধান উৎপাদনে পরিশ্রম ও অধিক যত্নেরও প্রয়োজন হয়। সে অনুপাতে এই ধানচাষ করতে গিয়ে কৃষকদের লোকসানও গুণতে হয়।এ কারণে অনেক কৃষক সুগন্ধি ধান চাষ করতে চান না।

চিরিরবন্দর উপজেলার কৃষক নিরঞ্জন দাস বাংলানিউজকে জানান, সুগন্ধি ধান চাষে আগ্রহ হারানোর আরও একটি কারণ হলো, গুণগতমানের বীজের সংকট। দীর্ঘদিন ধরে কৃষকদের ঘরে তৈরি করা বীজ প্রক্রিয়ার জন্য আগের মত সুগন্ধি জাতের ধানচাষে আশানুরূপ উৎপাদন হয় না। বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে বীজ সংগ্রহ করা হলে সুগন্ধি জাতের ধানচাষে কৃষকদের আগ্রহ বাড়বে।

দিনাজপুর চালকল মালিক গ্রুপের সাবেক সভাপতি মোসাদ্দেক হুসেন বাংলানিউজকে জানান, স্থানীয় জাতের সুগন্ধি চাল তথা কাটারিভোগ ধান এখন বিলুপ্তির পথে। দিনাজপুরের ঐতিহ্য রক্ষা ছাড়াও আর্ন্তজাতিক বাজারে কাটারিভোগ চাল ও চিড়া রফতানি করতে সরকারের পরিকল্পিত উদ্যোগ নেওয়া উচিত। গুণগতমানের কাটারিভোগ চাল বিশ্ববাজারে স্থান দখল করতে সক্ষম। এছাড়া কৃষকদের সহযোগিতা করার জন্য সকলকে এগিয়ে আসতে হবে।

হরেক রকম সুগন্ধি ধানের আবাদ হচ্ছে দিনাজপুরে
আগে সুগন্ধি ধান বলতে শুধু কাটারিভোগ ধানকেই বোঝানো হলেও দেশে সুগন্ধি চালের চাহিদা বেড়ে যাওয়া ও মূল্যবৃদ্ধির ফলে দিনাজপুরে কাটারিভোগ ধানের পাশাপাশি অনেক সুগন্ধি ধানচাষ শুরু হয়েছে। শুধু আমন মৌসুমে সুগন্ধি ধান উৎপাদনের প্রচলন থাকলেও এখন ইরি-বোরো মৌসুমেও সুগন্ধি চালের আবাদ হচ্ছে। এছাড়া বিজ্ঞানীদের গবেষণার ফলে সুগন্ধি চালের উৎপাদনও অনেকাংশে বেড়ে গেছে। তবে স্থানীয় জাতের ধানের মতো ওগুলো সুগন্ধি নয়।

কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতর বলছে, শুধু জৈব সারের মাধ্যমে চাষাবাদ করা হলে সুগন্ধি চাল তার নিজস্ব সুঘ্রাণ ধরে রাখতে সক্ষম হবে।

স্বাধীনতার পরবর্তী সময়ে কাটারিভোগ ধান উৎপাদনে ভাটা পড়ে। এ সময় কৃষকরা কাটারিভোগ ধান চাষে আগ্রহ হারিয়ে ফেলেন। ৯০ দশকে কৃষকদের উৎপাদন বাড়িতে দিতে বিজ্ঞানীরা কৃষকদের হাতে পৌঁছে দেয় ফিলিপাইন কাটারি। পাশাপাশি জিরা কাটারি, বোল্ডার কাটারি, সম্পা কাটারি, জটা কাটারি, বাদশাভোগ, কালজিরা, চিনিগুড়া, কালোনেনিয়া, ফিলিপাইন কাটারি ও বেগুণবিচি ধান চাষাবাদ শুরু হয়।

কদর বাড়ছে উফশী জাতের ধানের
দিনাজপুরে স্থানীয় জাতের সুগন্ধি ধানের আবাদ কমলেও বাড়ছে ধান গবেষণা ইনস্টিটিউটের উদ্ভাবিত উফশী (উচ্চ ফলনশীল) জাতের ধান চাষ। ফলন বেশি হওয়ার কারণে এই জাতের ধান চাষে কৃষকরা উৎসাহিত হচ্ছেন বলে অভিমত প্রকাশ করেছে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতর।

কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের মতে, জেলায় উফশী (উচ্চ ফলনশীল) জাতের ব্রি-৩৪ সুগন্ধি ধান আবাদ হয়েছে ১৭ হাজার ৭৪৯ হেক্টর জমিতে। গত বছরে এর আবাদ হয়েছিল ২২ হাজার ৮৩৯ হেক্টর জমিতে। আর তার আগের বছর আবাদ হয়েছিল ১২ হাজার ৭২৪ হেক্টর জমিতে।

এ বছর উফশী জাতের ধান চাষ গতবারের তুলনায় কম হলেও দিনে দিনে এই জাতের ধান চাষ বাড়বে বলে মন্তব্য করেন কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের উপপরিচালক আনোয়ারুল হক।

এ ব্যাপারে সদর উপজেলার কৃষক স্বপন চন্দ্র বাংলানিউজকে জানান, উফশী জাতের ধান চাষে খরচ কম এবং ফলন বেশি। তাই এ ধান চাষে কৃষকরা উৎসাহী হচ্ছে। তিনি উফশী জাতের ও স্থানীয় জাতের সুগন্ধি ধান আবাদ করে এই সুফল পেয়েছেন।

No comments

Powered by Blogger.