নিখিলের আপন ভুবন by মনোজ সাহা

গোপালগঞ্জের কোটালীপাড়ার আত্মপ্রত্যয়ী নিখিল বাড়ৈ কঠোর পরিশ্রম, মেধা আর একাগ্রতায় কারুশিল্পকে অবলম্বন করে নিজের ভাগ্যের পরিবর্তন ঘটিয়েছেন। কোটালীপাড়া উপজেলার রাধাগঞ্জ বাজারের একটি ছোট ঘরে বসে তিনি হাতুড়ি ও বাটালির স্পর্শে একখণ্ড কাঠকে শিল্পকর্মে রূপান্তরিত করেন। শিল্পমনস্ক নিখিল তৈরি করছেন হাতি, ঘোড়া, নৌকা, মহিষ ছাড়াও নিত্যব্যবহার্য বাসন-কোসন। তার শিল্পকর্ম ঢাকা, খুলনা, রাজশাহী,
বরিশাল,সিলেট, চট্টগ্রামসহ দেশের বিভিন্ন শহরের অভিজাত এলাকার আড়ংয়ের শোরুমে বিক্রি হচ্ছে। ইতিমধ্যে বাংলাদেশ চারু ও কারুশিল্প পরিষদ এবং বিসিক আয়োজিত দুটি প্রদর্শনীতে অংশ নিয়ে জাতীয় স্বীকৃতি পেয়েছেন নিখিল বাড়ৈ। এলাকার যুবকদের কর্মসংস্থান সৃষ্টিতে কাজ করে যাচ্ছেন তিনি।
গোপালগঞ্জের জেলা প্রশাসক তার শিল্পকর্মে অভিভূত হয়ে রাধাগঞ্জ বাজারে আধা শতাংশ জমি দিয়েছেন। এ জমিতেই তিনি একটি বিশাল শোরুম ও কারখানা স্থাপন করতে চান।
শুরুর কথা : কোটালীপাড়া উপজেলার দীঘলিয়া গ্রামের দরিদ্র ও মেধাবী যুবক নিখিল বাড়ৈ ছোটবেলা থেকেই ভালো ছবি আঁকতেন। মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের গণ্ডি পার হওয়ার আগেই তাকে ১৯৮৬ সালে কাজের সন্ধানে ঢাকা যেতে হয়। সেখানে তিনি একটি কাঠের ফার্নিচারের দোকানে কাজ নেন। ফার্নিচারের নতুন নতুন নকশা তৈরি করে নিখিল সেখানে চমক সৃষ্টি করেন। ১৯৮৮ সালে তিনি ভারতের পশ্চিমবঙ্গের রামচন্দ্রপুরে গিয়ে রডভাই সুনীল বাড়ৈর কাছে কাঠের হাতি ও ঘোড়া তৈরির কাজ শেখেন। ১৯৯০ সালে তিনি দেশে ফেরেন। '৯১ সালে ঢাকা আড়ংয়ের শোপিস তৈরির কাজ নেন। '৯৮ সালে কোটালীপাড়ায় ফিরে এসে রাধাগঞ্জ বাজারে একটি ঘর নিয়ে নিজেই কারখানা গড়ে তোলেন। স্থানীয় উৎসাহী যুবকদের প্রশিক্ষণ দিয়ে কাঠের শিল্পকর্ম তৈরির কাজে লাগান তিনি। বর্তমানে তার কারখানায় এলাকার ১৫ শ্রমিক পালা করে কাজ করছেন। তারা এখানে কাজ করে পরিবার-পরিজন নিয়ে ভালো আছেন।
কারখানার বর্ণনা : রাধাগঞ্জ বাজারের ছোট একটি টিনের ঘরে নিখিলের শিল্পকর্মের কারখানা। কাঠের কাজে চাইনিজ কুড়াল, হাতুড়ি, ছোট-বড় বাটালি যন্ত্রপাতি হিসেবে ব্যবহার করা হয়। মূল কাঁচামাল শিরিষ ও কড়ই কাঠ। যন্ত্রপাতির সাহায্যে কাঠ কেটে ও খোদাই করে বিভিন্ন সাইজের হাতি, ঘোড়া, কুমির, মহিষ, হরিণ, হাঁস, ময়ূরপঙ্খি নৌকা, বাটি ও দৈনন্দিন ব্যবহার্য পণ্য তৈরি হয় তার কারখানায়। এরপর শিরিষ কাগজ দিয়ে ঘষে মোম, গালা, রঙ, স্পিরিট ও বার্নিশ দিয়ে উজ্জ্বল করা হয়। ১৫ জন শ্রমিক পালা করে এখানে কাজ করে মাসে ১৫০ পিস পণ্য তৈরি করেন।
কাঁচামাল সংগ্রহ : নিখিলের কারুশিল্পের মূল উপকরণ কাঠ। ভালোমানের শিরিষ ও কড়ই কাঠ সংগ্রহ করে পানিতে ভিজিয়ে রাখতে হয়। তারপর রোদে শুকিয়ে স'মিলে সেই কাঠ খণ্ড খণ্ড করতে হয়। এ কাঠ কারখানায় এনে খোদাই করে তৈরি হয় শিল্পকর্ম।
শ্রমিকের পারিশ্রমিক : এখানে সাইজভেদে একটি হাতি তৈরির জন্য শ্রমিককে ৩০০ থেকে ৬০০ টাকা পারিশ্রমিক দেওয়া হয়। এখন হাতির চাহিদা বেশি। তাই হাতি তৈরি করা হয় বেশি। নিখিলের কারখানার শ্রমিক অমর চন্দ্র বাড়ৈ বলেন, কাজ শেষ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে আমাদের মজুরি বুঝিয়ে দেওয়া হয়। দৈনিক আমরা একটি হাতি তৈরি করতে পারি। মাসে ৮ হাজার টাকা আয় হয়। এটি শৈল্পিক কাজ। এখানে কাজ করে আনন্দ ও টাকা দুই-ই পাই।
দিনবদল : এক সময়ের ভূমিহীন নিখিল এখন প্রতি মাসে এ কারখানা থেকে ২০-৩০ হাজার টাকা আয় করছেন। কয়েক বিঘা জমি, চিংড়ি ঘের ও বড় কৃষি খামারের মালিক হয়েছেন। সন্তানদের স্কুলে পড়াচ্ছেন। কারুশিল্পের কারখানা করে সুদিন ফিরিয়ে এনেছেন।
স্বীকৃতি ও সম্মাননা : নিখিল বাড়ৈ ১৯৯৫ সালে ঢাকায় বিসিক আয়োজিত চারু ও কারুশিল্প প্রদর্শনীতে অংশ নিয়ে জাতীয় পুরস্কার এবং সম্মাননা পান। এ ছাড়া ২০০০ সালে বাংলাদেশ চারু ও কারুশিল্প পরিষদ আয়োজিত প্রদর্শনীতে অংশ নিয়ে তৃতীয় পুরস্কার এবং সনদপত্র পান।
নিখিলের ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা : নিখিল বাড়ৈ বলেন, জেলা প্রশাসন ও সচিবালয়ের কাজ করেছি। তারা রাধাগঞ্জ বাজারে একটু জায়গার ব্যবস্থা করেছেন। সেখানে আমি একটি বিশাল শোরুম ও কারখানা স্থাপন করে এলাকার স্বল্প শিক্ষিত ও নিরক্ষর তরুণদের কাজ শেখাতে চাই। আমি এ শিল্পকে দেশের গণ্ডি পেরিয়ে বিদেশে পরিচিত করতে বড়মাপের শিল্পী তৈরি করতে চাই।
গোপালগঞ্জের জেলা প্রশাসকের বক্তব্য : গোপালগঞ্জের জেলা প্রশাসক শেখ ইউসুফ হারুন বলেন, নিখিলের শিল্পকর্ম বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয়েছে। তার শিল্পকর্ম সেখানে সমাদৃত হয়েছে। তার এ কাজ সম্প্রসারণ ও কর্মসংস্থান সৃষ্টির জন্য তাকে রাধাগঞ্জ বাজারে আধা শতাংশ জমি বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে।

No comments

Powered by Blogger.