চা উৎপাদন বাড়াতে মেগা প্রজেক্ট হাতে নেওয়া হচ্ছে by সাজিদুল হক সাজু

চায়ের অভ্যন্তরীণ চাহিদা মেটানো এবং রপ্তানি পরিসর বর্তমান হারে ধরে রাখার জন্য চায়ের উৎপাদন আরও ৪ কোটি কেজি বাড়ানোর উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে। বর্তমানে দেশে চা উৎপাদন হয় ৬ কোটি কেজি। উৎপাদন ১০ কোটি কেজিতে নেওয়ার জন্য ৭৬১ কোটি ৬০ লাখ টাকা ব্যয়ে ১২ বছর মেয়াদী উন্নয়ন প্রকল্প প্রণয়ন করা হচ্ছে।

গত বৃহস্পতিবার বাণিজ্য মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির ৩০তম বৈঠকে এ সংক্রান্ত এক প্রতিবেদন উপস্থাপন করে বাংলাদেশ চা বোর্ড।

সংসদীয় কমিটি চা চাষকে আরো সম্প্রসারণ করতে ৬০ বছরের অধিকে পুরনো গাছ উৎপাটন করে নতুন চারা রোপন করার সুপারিশ করেছে।

ওই প্রতিবেদনে বাংলাদেশ চা বোর্ড জানিয়েছে, সরকারের নীতি এবং ভিশনকে সামনে রেখে পরিকল্পনাটি তিন পর্যায়ে বাস্তবায়িত হবে। প্রথম পযার্য়ে পাঁচ বছর, দ্বিতীয় পর্যায়ে আরও পাঁচ বছর এবং তৃতীয় পর্যায়ে দুই বছর মেয়াদে তা বাস্তবায়ন করা হবে।

এরইমধ্যে এ প্রকল্পের বিষয়ে পরিকল্পনা কমিশন নীতিগত সম্মতি দিয়েছে। চা শিল্পের জন্য কৌশলগত উন্নয়ন পরিকল্পনার অংশ হিসাবে ষষ্ঠ পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনায় অর্ন্তভুক্তির জন্য অগ্রাধিকার ভিত্তিতে তিনশ ৫০ কোটি টাকা ব্যয়ে দশটি উন্নয়ন প্রকল্প প্রস্তাব বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ে পেশ করা হয়েছে।

চা বোর্ডের দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, দেশে প্রায় ৬ কোটি কেজি (৫৭ দশমিক ৬৩ মিলিয়ন কেজি) চা অভ্যন্তরীণ ভোগে ব্যবহৃত হয়। যা বিদেশ থেকে আমদানি করতে হলে এক হাজার ৫৭ কোটি ২৭ লাখ টাকার প্রয়োজন হত। চায়ের অভ্যন্তরীণ ভোগ্য ব্যাপকহারে বেড়ে চলায় রপ্তানি কমে যাচ্ছে।

২০১০ সালের হিসাব অনুযায়ী, চা শিল্পের বাৎসরিক মোট আয় এক হাজার ২৭৮ কোটি ৬৪ লাখ টাকা। এর মধ্যে রপ্তানি আয় মাত্র ১৭ কোটি ৬৭ লাখ টাকা।
   
কৌশলগত উন্নয়ন এবং ৬ষ্ঠ পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনায় অর্ন্তভুক্ত প্রকল্প 

চা শিল্পের উন্নয়নে নেওয়া পদক্ষেপগুলোর বিবরণ দিয়ে চা বোর্ড জানায়, কৌশলগত উন্নয়ন পরিকল্পনা ভিশন, ২০২১ এ সাত শ’ ৬১ কোটি ৬০ লাখ ৪০ হাজার টাকা ব্যয়ে যে দশটি প্রকল্প নেওয়া হয়েছে সেগুলো হচ্ছে- চার শ’ এক কোটি ২৪ লাখ সাত হাজার টাকা ঋণ সহায়তায় চা বাড়ানের উন্নয়ন ও দক্ষতা বৃদ্ধি, ৩৪ কোটি ৯৪ লাখ টাকা ঋণে অনুন্নত চা বাগানের উন্নয়ন, এক শ’ কোটি টাকা ঋণে ক্ষুদ্রায়তন চা চাষ সম্প্রসারণ, ৭৭ কোটি ৮৬ লাখ ৫৫ হাজার টাকা ঋণে চা বাগানের কারখানা সুষমকরণ ও আধুনিকীকরণ, এক কোটি ৯৮ লাখ ৩২ হাজার টাকা অনুদানে প্রকল্প ইউনিট জোরদারকরণ ও দক্ষতা বৃদ্ধি, দুই কোটি ৯৮ লাখ ৭৭ হাজার টাকা অনুদানে বাংলাদেশ চা গবেষণা ইনস্টিটিউট জোরদারকরণ এবং দক্ষতা বৃদ্ধি, ২০ কোটি ১৭ লাখ টাকা অনুদানে অবকাঠামো উন্নয়ন, ১৪ কোটি ৯৯ লাখ ৯৫ হাজার টাকা ঋণে চা বাগানে সেচ সুবিধা বর্ধিতকরণ, এক শ’ দুই কোটি ৪১ লাখ ৮৩ হাজার টাকা অনুদানে চা বাগানের শ্রমিক কল্যাণ এবং চার কোটি ৯৯ লাখ ৮১ হাজার টাকা অনুদান সহায়তায় চা বাগান ব্যবস্থাপনা ও মানবসম্পদ উন্নয়ন।

আর ৩৫০ কোটি টাকা ব্যয়ের যে দশটি প্রকল্প ষষ্ঠ পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনায় অর্ন্তুভুক্তির জন্য চা বোর্ড থেকে মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয়েছে সেগুলো হচ্ছে- চা বাগানে অব্যবহৃত চা চাষযোগ্য জমিতে চা চাষ সম্প্রসারণ, চা চাষাধীন অলাভজনক জমি পুনরাবাদ, অনুন্নত চা বাগানের উন্নয়ন, চা বাগানের কারখানা সুষমকরণ ও আধুনিকীকরণ, প্রকল্প ইউনিট জোরদারকরণ ও দক্ষতা বৃদ্ধি, বাংলাদেশে চা বাগানে ইনস্টিটিউট জোরদারকরণ ও দক্ষতা বৃদ্ধি, অবকাঠামো উন্নয়ন, চা বাগানে সেচ সুবিধা বর্ধিতকরণ, চা বাগানের শ্রমিক কল্যাণ এবং চা বাগান ব্যবস্থাপনা ও মানবসম্পদ উন্নয়ন।
  
এর মধ্যে সবচেয়ে বড় দুই শ’ পাঁচ কোটি টাকা ব্যয়ের চা বাগানে অব্যবহৃত চা চাষযোগ্য জমিতে চা চাষ সম্প্রসারণ প্রকল্পটি গত ২০ এপ্রিল পরিকল্পনা কমিশনে পাঠানো হয়েছে। এ প্রকল্পের ডিপিপির ওপর পরিকল্পনা কমিশন কিছু মতামত দিয়ে গত ২০ জুলাই বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ে পাঠিয়েছে।

শ্রীমঙ্গলে চা নিলাম কেন্দ্র স্থাপন করা প্রয়োজন উল্লেখ করে চা বোর্ডের দেওয়া ওই প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, দেশের মোট এক শ’ ৬৩টি চা বাগানের মধ্যে মৌলভীবাজারের শ্রীমঙ্গলের আশেপাশেই রয়েছে এক শ’ ১৩টি চা বাগান। চট্টগ্রামের পাশাপাশি শ্রীমঙ্গলে আরেকটি নিলাম কেন্দ্র স্থাপন করা প্রয়োজন।

প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, সিলেট এলাকার চা উৎপাদনকারী ও ব্যবসায়ীরা শ্রীমঙ্গলে চায়ের একটি নিলাম কেন্দ্র স্থাপন করতে প্রশাসনের বিভিন্ন পর্যায়ে আবেদন করেছে। যদিও চট্টগামে স্থাপিত টি ট্রেডার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (টিটিএবি) এ বিষয়ে আপত্তি জানিয়েছে।

এক্ষেত্রে টিটিএবির যুক্তি, দীর্ঘদিন ধরে চট্টগ্রামে চায়ের নিলাম অনুষ্ঠিত হচ্ছে। কোটি কোটি টাকা ব্যয়ে নিলামের সাথে সম্পর্কিত বন্ডেড ওয়্যার হাউজ, অকশন ফ্লোর, ব্রোকার ও বিডারদের অফিস, টেস্টিং ল্যাব, বেন্ডারদের প্যাকেজিং ফ্যাক্টরি ইত্যাদি চট্টগ্রামে গড়ে উঠেছে।

এদিকে বোর্ড বলছে, শ্রীমঙ্গলে চায়ের নিলাম কেন্দ্র স্থাপন করা সম্ভব। বোর্ড এ বিষয়ে সমীক্ষাও করেছে। প্রয়োজনীয় অবকাঠামো নির্মান করতে এক থেকে দুই বছর লাগবে বলেও উল্লেখ করা হয়েছে।

সংসদীয় কমিটির এ বিষয়ে আগামী ৩১তম বৈঠকে আলোচনা করবে বলে জানিয়েছে।

চা উৎপাদন পরিস্থিতির বর্ণনা দিয়ে বাংলাদেশ চা বোর্ড জানিয়েছে, দেশে মোট এক শ ৬৩টি চা বাগান রয়েছে। ২৮৭টি ক্ষুদ্রায়তন চা চাষী ও খামারের আওতায় মোট এক লাখ ১৫ হাজার ৯৫৬ হেক্টর জমি রয়েছে। চা চাষাধীন জমির পরিমান ৫৬ হাজর ৮০৭ দশমিক ০৫ হেক্টর যা মোট জমির ৪৮ দশমিক ৯০ শতাংশ এবং চা চাষযোগ্য জমির পরিমান ৯০ দশমিক ৩৫ শতাংশ।

দেশে ২০১০ সালে মোট ৬০ দশমিক ০৪ মিলিয়ন কেজি চা উৎপাদন হয়েছে। গড় উৎপাদনের পরিমান হেক্টর প্রতি এক হাজার ২৪০ কেজি। দেশে চা উৎপাদন বৃদ্ধির অনেক সুযোগ রয়েছে। আরও ছয় হাজার ৯০ দশমিক ৪৪ হেক্টর চা চাষযোগ্য জমি রয়েছে। ওইসব এলাকায় চা চাষ সম্প্রসারণ করা হচ্ছে।

তাছাড়া ৯ হাজার ৭০৪ দশমকি ৮০ হেক্টর চা এলাকার চা গাছ ৬০ বছরেরও বেশি বয়স্ক। ফলে তা অর্থনৈতিকভাবে অলাভজনক হয়ে পড়ছে। ওই এলাকার হেক্টর প্রতি গড় উৎপাদন মাত্র ৪৮২ কেজি। ওই এলাকাগুলোতে পুরানোগুলো উৎপাটন করে নতুন করে রোপণ করা হচ্ছে।

সংসদীয় কমিটির বৈঠকের পরে কমিটির সভাপতি সাংবাদিকদের বলেন,‘বাংলাদেশের চা শিল্পকে আরো লাভজনক করতে প্রয়োজনীয় সকল পদক্ষেপ নেওয়ার সুপারিশ করেছে কমিটি।’

তিনি বলেন,‘৬০ বছরের পুরনো সকল চারা সরিয়ে ফেলে নতুন চারা রোপন করার জন্য কমিটি সুপারিশ করেছে।’

No comments

Powered by Blogger.