কুড়িয়ে পাওয়া সংলাপ-ভ্রান্তবীক্ষণের উল্লম্ফন by রণজিৎ বিশ্বাস

মাদের নামে এক গ্রাস ভাত আপনি বেশি গেলেন। আমাদের বিরুদ্ধে একটি অভিযোগ আপনি সব সময় তোলেন। সম্প্রতি খুব বেশি তুলেছেন। ভালো লাগে না। এত অভিযোগ আর ভালো লাগে না। যে অভিযোগ আমি আপনাদের বিরুদ্ধে তুলি, তুলি অনেকটা নিরুপায় হয়েই, তাকে আপনি ভ্রান্তবীক্ষণ বলতে পারেন, বলতে পারেন ইচ্ছাকৃত অপব্যাখ্যাও। ধরুন, আপনি আমার প্রতিপক্ষ। ধরুন, আমি সব সময় ন্যায়, সততা, উদারতা, মানবতা,


অসাম্প্রদায়িকতা, মুক্তিযুদ্ধের আদর্শ, সুবিচার, সুরুচি ও নিরপেক্ষতার পক্ষে থাকি। আর আপনি থাকেন তার ঘোর বিপরীত এক অবস্থানে। উত্তর মেরু আর দক্ষিণ মেরুর মতো বিপরীত।
এমন আপনাকে থাকতে হয় দুটো কারণে। শব্দগুলো আপনার অভিধানে নেই। দ্বিতীয়ত, অস্তিত্বের কারণেও আপনাকে তেমন থাকতে হয়। চাইলেই আপনি বা আপনারা ওয়ার ক্রিমিনাল, কমিউনাল, হাইপার কমিউনাল, এঙ্ট্রা কমিউনাল, ডিসগাইজড কমিউনাল, মৌলবাদী, মানবতাবিরোধী কিংবা বাইচান্স মুক্তিযোদ্ধা ও তাদের বেনিফিশিয়ারিদের ছেড়ে আসতে পারেন না।
আপনি নিজে মানবেতর ও কখনো কখনো পাশবেতর পক্ষে গান গাইলেও, আমি বলব না যে ততটাই মন্দ বা তার চেয়ে বেশি মন্দ_এমন কিন্তু আমি কখনো বলছি না। বলতে চাচ্ছিও না। এমন বলার ইচ্ছাও আমার নেই। যুক্তির কথা বলতে গিয়ে অকারণ বিবাদে নেমে পড়া, আমার রুচিতে বাধে। আমি যা বলছি, আপনাকে ম্যালাইন করার জন্য বলছি না। একটা যুক্তিকে ভিত্তির ওপর স্থাপন করার জন্য পরিচিত ও অনুভবগ্রাহ্য একটি উদাহরণ টানছি। আপনি সেভাবেই এটি নেবেন।
: ঠিক আছে। নেওয়া যাবে। আপনি আপনার আর্গুমেন্ট এস্টাবলিশ করুন।
: থ্যাঙ্ক য়্যু। আমি বলতে চাচ্ছি, আমরা যেহেতু দুজন দুই মেরুর, একজন মানবের পক্ষে, আরেকজন পাশবের, আমাদের মধ্যে ডিফারেন্স যেহেতু খুব শার্প, আমাদের একজনের প্লাস পয়েন্ট কিন্তু অন্যজনের মাইনাস পয়েন্ট। একটি দিকে আমি যতটা দুর্বল, আপনি ততটা সবল। আমার একটি ভুলের ওজন আপনার একটি গুরুত্বপূর্ণ অর্জনের সমান। এটুকু তো আপনি পরিষ্কার বুঝতে পারছেন?
: আপনি বলে যান, বোঝা না বোঝা আমার ব্যাপার।
: তেমন হলে তো আমি আর কথা বলব না!
এখানেই আমি থেমে পড়ব। সংসারের যাবতীয় যুক্তি জড়ো করে আমি কথা বলব, আর বোঝা না বোঝা আপনার ব্যাপার হবে, আপনি শুনবেন কিন্তু বুঝবেন না, আপনি দেখবেন কিন্তু লক্ষ করবেন না, আপনি খাবেন কিন্তু গিলবেন না_এমন তো হবে না! এমন খেলায় কিন্তু আমি থাকব না। আপনাকেও অ্যাকটিভলি খেলতে হবে। যুক্তির কথা যুক্তি দিয়ে খণ্ডাতে হবে। পারুন না পারুন, চেষ্টা করতে হবে, নিষ্ক্রিয় গ্যাসের মতো বসে থাকলে চলবে না।
: ঠিক আছে, ঠিক আছে, অত ভ্যাজরভ্যাজর না করে আমাকে কী করতে হবে বলুন! আমার সময়ের দাম আছে।
: কথা আপনি আবার লম্বা করতে যাচ্ছেন। আমার সময় আপনার সময়ের চেয়ে সস্তা নয়, নাম্বার ওয়ান। নাম্বার টু হচ্ছে, কথা আপনি তুলেছেন, আমি শুধু জবাবের মালিক। থার্ড কথা হচ্ছে, আমি ভ্যাজরভ্যাজর করছি, এই অযৌক্তিক, অপমানজনক ও ইডিয়টিক মন্তব্য আপনাকে প্রত্যাহার করতে হবে। যুক্তির ভিতে দাঁড়িয়ে কথা বলার নাম ভ্যাজরভ্যাজর করা নয়। আপনাদের সঙ্গে কথা বলার সমস্যা হচ্ছে, আপনাদের ভাবনায় গলদ আছে, আপনাদের সঙ্গে কোনো যুক্তিবাদী ও মেরিটরিয়াস লোক নেই। আপনাদের গ্রুপে আনফরচ্যুনেটলি, কোনো সুশিক্ষিত, সুুরুচিসম্পন্ন ও সফিশটিকেটেড লোক নেই। আপনাদের কিছু করারও নেই। ভাগ্য। ভাগ্যক্রমে আপনারা শুধু কখনো মিথ্যা কখনো অসত্যের ওপর নির্ভর করে গলা ফাটিয়ে চিৎকার করেন, কিন্তু যুক্তির ত্রিসীমানায় ঢোকেন না।
: এখন আমাকে কী করতে হবে, তাই বলুন।
: আমার কথা মনোযোগ দিয়ে শুনতে হবে। কথা যখন শুরু করেছেন, আমাকে শেষ করতে দিতে হবে। তারপর বোঝার ভারটা আপনার ওপর ছেড়ে দিয়ে বড় বিমর্ষ বদনে আমি চলে যাব। যে ফ্যাক্টরিতে আমি কাজ করি, সেখানে আমার সময়ের বড় উচ্চমূল্য।
: আপনার যখন খুশি, তখন যাবেন; কিন্তু বিমর্ষ বদনে আপনাকে যেতে হবে কেন?!
: বলতে পারেন, এটিও ভাগ্য। যখনই আপনার সঙ্গে কথা বলি বা আপনাদের গ্রুপের ও মাইন্ডসেটের কারো সঙ্গে বাহাস করি, আমাকে তেমন অবস্থাতেই স্থান ত্যাগ করতে হয়। কারণ যুক্তির কথা তো আপনাদের বোঝাতে পারি না! আপনাদের মস্তিষ্ক প্রকোষ্ঠে তা যে আমি প্রবিষ্ট করাতে পারি না_সেটি তো আমারই অক্ষমতা! আর যখন খুশি যেতে চাইলে আমি তো অনেক আগেই চলে যেতাম! আমি তো চাইছি আপনাকে ও আপনার মতো সবাইকে আমি কিছু বুঝিয়ে যেতে! হতাশ হয়ে মাঝপথে ছেড়ে যাওয়ার কম্ম তো আমার নয়! ট্রাই টু আন্ডারস্ট্যান্ড মাই ফ্রেন্ড!
: আমি নিচে দাঁড়াচ্ছি, আপনি কথা শেষ করুন।
: নিচে দাঁড়াচ্ছেন মানে?!
: আপনার কথামতো আন্ডারস্ট্যান্ড করছি।
আন্ডার মানে নিচে, স্ট্যান্ড মানে দাঁড়ানো!
: মন্দ নয়। ওপরে যাওয়ার স্বপ্ন পোষণের আগে নিচে দাঁড়িয়েই কথাগুলো শুনুন এবং মাথার খোঁপে কিছু ঢোকে কি না দেখুন। আমি যদি আমার কোনো সহযোগী বা সহকর্মীকে বলি_ভাই, এমন কোনো কাজ আমরা করব না যাতে শত্রুর হাতে অস্ত্র তুলে দেওয়ার মতো কাজ হয়। আমি কি এমন কথা আমার সহযোগীদের বলতে পারি না!
: পারেন না, কে বলল?!
: সে আপনি খুঁজে দেখবেন, আমাকে কথাটা শেষ করতে দিন। আমার সময় বড় মহার্ঘ। তাহলে আপনি মেনে নিচ্ছেন যে এমন আমি বলতে পারি, এমন অনুরোধ আমি আমার সহকর্মীদের করতে পারি, এমন পরামর্শ আমি দিতে পারি, এমন সতর্কবাণী আমি উচ্চারণ করতে পারি।
: অবশ্যই পারেন! পারাই উচিত! আপনি কেন, এমন ভালো কাজ আমিও করতে পারি!
: পারেন, কারণ আপনার একটি 'ভুল', আমার একটি শুদ্ধ। আমি নিজের একটি দুর্বলতার জোরে কেন আপনাকে সবল করে রাখব! আমি না করলেও আপনি তো নিঃশ্বাসে নিঃশ্বাসে আমার বিনাশ কামনা করেন! আমার নিপাত কামনা করেন! আপনি কি চাইবেন, আপনার কোনো সহকর্মীর দ্বারা আপনার অপকার হোক, আর আমার উপকার?
: কেন চাইব! আমার মাথা খারাপ নাকি?! আমার জীবন যেতে পারে, তার পরও আমি মানবতা ও মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের মানুষকে সমর্থন করব নাকি! তাদের কোনো কল্যাণ এ জীবনে আমার দ্বারা বা আমাদের দ্বারা হবে নাকি?!
: আমার আনন্দ, আমি আপনাকে যুক্তির কিছু কথা বোঝাতে পারছি। তাহলে আপনি এটিও মানবেন যে 'শত্রুর হাতে অস্ত্র তুলে দিতে হয় না'_এটি একটি পরিচিত সুবচন। এর অর্থ, কাউকে শত্রু বানানো নয়, অথবা বারবার দুশমনির শিকার হলেও কাউকে দুশমন হিসেবে সম্বোধন নয়।
: অবশ্যই নয়! ওটি তো একটি সাধারণ কথা!
একটি 'জেনেরিক' উচ্চারণ। সাধারণ কথা সাধারণই, তা কাউকে টার্গেট করে হয় না।
এমনকি দুশমনকেও নয়!
: তাহলে আপনি মানছেন যে ভ্রান্তবীক্ষণে আমরা কখনো কখনো এবং কেউ কেউ প্রায় সব সময়ই লাফিয়ে ওঠে। লাফিয়ে লাফিয়ে ও অকারণ ঝাঁপিয়ে ঝাঁপিয়ে সরলসোজা ও শান্তসুবোধ মানুষকে কাঁপিয়ে কাঁপিয়ে তোলে।
: মানলাম। এটি আবার না মানার কথা নাকি?!
: আমার আজ আর কথা নেই। যা প্রতিষ্ঠা করার, তা আমি প্রতিষ্ঠা করলাম। এবার আমি যাব। আমার সময়ের মূল্য আছে।
লেখক : কথাসাহিত্যিক

No comments

Powered by Blogger.